১৩ জুন হচ্ছে চীনের চতুর্থ সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকারসূত্রে প্রাপ্ত সম্পদ দিবস। ১১ জুন চীনের সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় তৃতীয় দফা জাতীয় পর্যায়ের অবৈষয়িক সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকার প্রকল্পের প্রতিনিধিত্বকারী বেঁচে থাকা ব্যক্তিদের নির্বাচন করেছে। ২০০৬ সালে চীন সরকারের "সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকার দিবস" স্থাপনের পর থেকে অবৈষয়িক সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকারের ওপর জনসাধারণের দৃষ্টি রাখার মাত্রাও ধাপে ধাপে উন্নত হয়েছে। অবৈষয়িক সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকারের প্রতিনিধিত্বকারী বেঁচে থাকা ব্যক্তি এই ধারণা জনগণের কাছে ধীরে ধীরে সুপরিচিত হচ্ছে। আধুনিক সমাজে অবৈষয়িক সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকারকে কীভাবে বংশানুক্রমে বাঁচিয়ে রাখা যায় তা চীনের বিভিন্ন মহলের
৭০ বছর বয়সী সুই চু ছু হচ্ছে ফু চিয়ান প্রদেশের চাং চৌ পুতুল তৈরী পরিবারের ষষ্ঠ বংশোদ্ভূত। তিনি ছুরি দিয়ে কাঠে নানা ধরণের ব্যক্তির প্রতিবিম্ব খোদাই করেন এবং তার তৈরী পুতুল খুব প্রাণবন্ত। সুই চু ছু'র শিল্পকর্মের প্রদর্শনী যুক্তরাষ্ট্র, সিঙ্গাপুর, দক্ষিণ কোরিয়া, জাপান এবং অস্ট্রেলিয়াসহ অনেক দেশ ও অঞ্চলে অনুষ্ঠিত হয়েছে এবং ৫০টিরও বেশি দেশ ও অঞ্চলের জাদুঘর ও আর্ট গ্যালারীতে তা সংরক্ষণ করা হয়েছে। এ ছাড়াও, তাঁর শিল্পকর্ম দেশের মূল্যবান উপহার হিসেবে অনেক দেশের শীর্ষনেতা ও অতিথিদেরকে দেয়া হচ্ছে।
২০০৭ সালে চীনের দ্বিতীয় "সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকার" দিবসের সময় সুই চু ছু এবং তাঁর ছাত্র সুই ছিয়াং পেইচিংয়ে চীনের অবৈষয়িক সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকার সংক্রান্ত এক প্রদর্শনীতে অংশ নেন। প্রধানমন্ত্রী ওয়েন চিয়া পাও তাঁদের শিল্পকর্ম উপভোগ করেছেন এবং প্রশংসা করে বলেছেন যে, তাঁদের খোদাই শিল্প হচ্ছে জাতীয় সংস্কৃতির মর্ম। তা ছাড়া, প্রধানমন্ত্রী তাঁদেরকে এই শিল্প বংশানুক্রমে বাঁচিয়ে রাখার অনুরোধ করেছেন।
সুই চু ছু মনে করেন, পূর্বপুরুষের শিল্পকে বাঁচিয়ে রাখা সহজ কাজ নয়। তাঁর এ সুপ্রাচীন নৈপুণ্য বাঁচিয়ে রাখার প্রয়োজন রয়েছে। তাই তিনি চাং চৌ-এর খোদাই করা পুতুল মাত্র ছেলেদেরর জন্য মেয়েদের জন্য নয় এ সুপ্রাচীন ব্যবস্থা ভেঙ্গে দিয়েছেন। তিনি বলেন,
আগে আমাদের নৈপুণ্য শুধুমাত্র ছেলেদেরই শেখানো হতো। এখন আমার মেয়েও খোদাই করতে পারেন। আমি ছেলেমেয়ের কাছে তা পৌঁছে দিয়েছি। আমি মনে করি, আগের চেয়ে এখন যুগ পাল্টে গেছে। আগে আমাদের উদ্বেগ ছিল নিজের নৈপুণ্য অন্য মানুষকে শেখালে নিজের অর্থনৈতিক স্বার্থ প্রভাবিত হতে পারে। কিন্তু এখন সরকারের নীতি খুব ভালো। আমাদের স্থায়ী বেতন আছে।
১৯৯৬ সালে সুই চু ছু এবং তাঁর ছেলে সুই ছিয়াং চাং চৌ শহরে একটি পুতুল তৈরী শিল্প কেন্দ্র স্থাপন করেছেন। শিল্প কেন্দ্রের আয়তন মাত্র দু'শ বর্গমিটার। তা সত্ত্বেও অনেক দেশ ও অঞ্চলের পুতুল অনুরাগীরা আকৃষ্ট হয়ে সেখানে পরিদর্শনে যাচ্ছেন।
সুই চু ছু এবং তাঁর ছেলে সুই ছিয়াং স্কুলে পুতুল তৈরীর নৈপুণ্য জনপ্রিয় করে তোলা এবং পুতুলের প্রতি শিশুদের আগ্রহ সৃষ্টির জন্য প্রচেষ্টা চালাচ্ছেন। তাঁদের তৈরী পুতুলে এখন অনেক বেশি আধুনিক উপাদান যোগ করা হয়েছে। সুই ছিয়াং প্রায় এক যুগ ধরে বাবার কাছে পুতুল তৈরী শিখে আসছেন। তিনিই সেই পুতুল তৈরী পরিবারের সপ্তম বংশোদ্ভূত। পুতুল শিল্পের প্রতি তাঁর গভীর ভালোবাসা রয়েছে। তিনি বলেন,
আমি ৯ বছর বয়স থেকেই বাবার কাছে পুতুল তৈরী করা শিখতে শুরু করি। শুরুতে আমি বাবাকে সাহায্য করতাম। ধীরে ধীরে আমার আগ্রহ আরো গভীর হয়ে ওঠে। আমি মনে করি, এত ভালো শিল্প গড়ে তুলতে আমাকে অবশ্যই কাজ করতে হবে।
সুই চু ছু এবং সুই ছায়াংয়ের মতো চীনের ঐতিহ্যবাহী লোক নৈপুণ্য বংশানুক্রমে বাঁচিয়ে রাখার দায়িত্ব প্রধানতঃ পরিবারের নির্ভর করে। তবুও আধুনিক সমাজে জীবনের গতি দ্রুত হওয়ার পাশাপাশি কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রে তরুণ-তরুণীদের বেশি বাছাই করার সুযোগ আছে। তাই ঐতিহ্যবাহী পরিবারের বংশানুক্রমে টিকিয়ে রাখার পদ্ধতি প্রভাবিত হয়েছে। পুরোনো শিল্পীদের বয়স দিন দিন বাড়ছে কিন্তু তরুণ-তরুণীদের আগ্রহ তেমন বেশি নয়। ফলে কিছু ঐতিহ্যবাহী লোক নৈপুণ্য ধাপে ধাপে হারিয়ে যেতে বসেছে। আসলে এটা হচ্ছে এক ধরণের সাংস্কৃতিক সংকট। সরকারের এক যুগের প্রচেষ্টার মাধ্যমে সাংস্কৃতিক ধ্বংসাবশেষ সুরক্ষা ক্ষেত্রে জনগণের চেতনা সৃষ্টি হয়েছে। কিন্তু "সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকার" এই শব্দটির ব্যাপারে জনগণের ধারণা স্পষ্ট নয়।
২০০৬ সালে সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকার সংরক্ষণের কাজ জোরদার করা সম্পর্কিত চীন সরকারের সংশ্লিষ্ট দলিলপত্রে প্রথমবারের মতো প্রায় এক যুগ ধরে ব্যবহার করা "সাংস্কৃতিক ধ্বংসাবশেষের" পরিবর্তে "সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকার"এ শব্দটি লিপিবদ্ধ করা হয়েছে। দলিলপত্রে এভাবে লেখা হয়েছে যে, সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকারের মধ্যে রয়েছে বৈষয়িক সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকার ও অবৈষয়িক সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকার। অবৈষয়িক সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকার মানে অবস্তুগত আকারের উপায়ে থাকা জনগণের জীবনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে সম্পর্কিত এবং বংশানুক্রমে টিকে থাকা ঐতিহ্যবাহী সংস্কৃতি। এর মধ্যে রয়েছে ঐতিহ্যবাহী পরিবেশন শিল্প, ঐতিহ্যবাহী হস্তশিল্প এবং দিবসসহ অন্যান্য। চীন সরকার প্রতি বছর জুন মাসের দ্বিতীয় শনিবার সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকার দিবস নির্ধারণ করেছে।
চীন সরকার ধারাবাহিক নীতি প্রণয়ন করে সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকারীদেরকে উত্সাহ ও সমর্থন দিয়ে আসছে। তা ছাড়া, চীন অব্যাহতভাবে অবৈষয়িক সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকার সংরক্ষণ বিষয়ক সংশ্লিষ্ট আইন পূর্ণাঙ্গ করে তুলছে। জাতীয়, প্রাদেশিক, শহর ও জেলা এ চার পর্যায়ের সংরক্ষণ ব্যবস্থাও গঠিত হচ্ছে। এর পাশাপাশি আধুনিক সমাজে ঐতিহ্যবাহী নৈপুণ্যকে কার্যকরভাবে বাঁচিয়ে রাখা বিভিন্ন মহলের দৃষ্টি রাখার কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছে।
পোং হুই হেং হো পেই প্রদেশের একটি পেশাগত কলেজে স্থানীয় ঐতিহ্যবাহী অপেরা হো পেই বাং চি শিক্ষাদান করছেন। আগে তিনি হো পেই বাং চি'র বিখ্যাত শিল্পীদের কাছে শিখছিলেন এবং অনেক বছর ধরে পেশাগত অপেরা দলে পরিবেশন করেছেন। এখন তিনি নিজের পরিবেশনার অভিজ্ঞতা ও তত্ত্ব শিক্ষাদানের ক্ষেত্রে ব্যবহার করছেন। তিনি বলেন, এখন ঐতিহ্যবাহী অপেরা শেখা তরুণ-তরুণীদের সংখ্যা বেশি নয়। পুরোনো শিল্পীদের বয়স বৃদ্ধি পাওয়ার পাশাপাশি শ্রেষ্ঠ আদর্শ অপেরাও হারানোর হুমকির সম্মুখীন হচ্ছে। পোং হুই হেং সরকারকে অপেরার শিক্ষা ও শ্রেষ্ঠ অপেরার সৃষ্টির প্রতি সমর্থনের মাত্রা বাড়ানোর প্রস্তাব দিয়েছেন। তিনি বলেন,
আমি মনে করি, অপেরা শিক্ষা যেন পানির উত্স্যের মতো। শিক্ষকদের যোগ্যতা অর্জন এবং শ্রেষ্ঠ ছাত্রছাত্রীদের প্রশিক্ষণের ক্ষেত্রে সমর্থনের মাত্রা আরো বাড়ানো উচিত্। কিছু বৃদ্ধ শিল্পীদের আদর্শ অপেরাকে ভালোভাবে বাঁচিয়ে রাখলে অপেরার শিক্ষার জন্য একটি অবদান।
বিশেষজ্ঞরা এবং পন্ডিতগন মনে করেন, উন্নত দেশগুলোর চেয়ে চীনের অবৈষয়িক সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকার সংরক্ষণ একটু দেড়ীতে শুরু হয়েছে। সংরক্ষণের কাজও অব্যাহতভাবে পূর্ণাঙ্গ করতে হবে। চলতি বছর চীনের সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকার দিবসের প্রতিপাদ্য হলো "সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকার সুরক্ষা এবং বিজ্ঞানসম্মত উন্নয়ন ত্বরান্বিত"। কোন কোন বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, কয়েক বছরের প্রচেষ্টার মাধ্যমে চীনের অবৈষয়িক সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকার সংরক্ষণ কাজ সুষ্ঠু উন্নয়নের পথে প্রবেশ করবে। অনুমাণ করা যাচ্ছে যে, ভবিষ্যতে এসব সুপ্রাচীন শিল্প প্রাণশক্তি আবার উন্মুক্ত করবে। (লিলি)
|