২০১০ সাংহাই বিশ্ব মেলার আয়োজক শহর সাংহাই হচ্ছে একটি ঝলমলে সমৃদ্ধ বড় নগর। তবে সাংহাইয়ের কাছাকাছি অনেক শান্তিপূর্ণ ও আরামদায়ক জায়গাও রয়েছে। আজকের অনুষ্ঠানে আমি আপনাদেরকে দক্ষিণ চীনের জে চিয়াং প্রদেশের উ জেন মহকুমায় নিয়ে গিয়ে সেখানকার জীবনযাপনের ধারা অনুভব করবো।
উ জেন মহকুমা জে চিয়াং প্রদেশের থোং সিয়াং শহরে অবস্থিত। এটা হচ্ছে দক্ষিণ চীনের বিখ্যাত প্রাচীন নগর। সাংহাই থেকে উ জেন নগর ১৪০ কিলোমিটার দূরে এবং সাংহাই—হাংচৌ ও সাংহাই—নিংবোসহ বেশ কয়েকটি এক্স প্রেস সড়কপথ আছে। গাড়িতে যেতে মাত্র ২ ঘন্টা লাগবে। যাতায়াত ব্যবস্থা খুবই সুবিধাজনক।
এক হাজারেরও বেশি বছরের ইতিহাস থাকা উ জেন হচ্ছে দক্ষিণ চীনের প্রতিনিধিস্থানীয় প্রাচীন নদী তীরের একটি নগর। একটি নদী সারা নগর জুড়ে বয়ে গেছে। নদীর দু'তীরের বাড়িঘর সবই নদীর দিকে মুখ রেখে নির্মাণ করা হয়। ফলে নদী তীরের মনোরম দৃশ্য গড়ে উঠেছে। ক্রস আকারের এ নদীর পানি সারা নগরটিকে পূর্ব, দক্ষিণ, পশ্চিম ও উত্তর চার অঞ্চলে ভাগ করেছে। ছোট ছোট নৌকা নদীতে যাতায়াত করার পাশাপাশি নদীর তীরে গড়ে উঠেছে একের পর এক দোকান। পেইচিংয়ের বৃদ্ধ ইয়াও বলেন,
প্রাচীনকালের আমেজ খুব গভীর। আমার জন্মস্থানে এ ধরনের বাড়িঘর আছে। তা সত্যিই আনন্দের। আমার বড় ছেলে বলেছে, উ জেন নগরে যেতে হবে।
বৃদ্ধ ইয়াও-এর বড় ছেলে উয়াও শি চিয়ে বলেন,
এবার উ জেনে তার আসা শুধুমাত্র নদী তীরের শহরকে দেখার জন্য। সত্যিই খুব সুন্দর। বলা যায়, নৌকা, পানি ও বাড়িঘর যেন মিলে মিশে একাকার। এর সৌন্দর্য্য হচ্ছে বাড়িঘরগুলোর পানিতে প্রতিবিন্বিত হয়ে ওঠা। ফলে এর প্রাচীনকালের স্বাদ আরো বেশি ফুটে ওঠে।
জাহাজঘাটা থেকে নেমে উ জেন নগরে প্রবেশ করলেই, জনতার হৈচৈ হঠাত্ ধীরস্থির হয়ে যায়। পাথরের পথে শুধু পদক্ষেপের শব্দ শোনা যায়। এমনকি মানুষভরা চা ঘর, দু'তীরের ছোট ছোট হোটেল এবং বাড়িঘর থেকেও হাল্কা স্বরে কথা বলার মতো শব্দ শোনা যায়। সুচৌর মেয়ে চাং কুয়ান ইউয়ান ছোট সেতু'র পাশের একটি অধিবাসীর বাসায় ২ দিন ছিলেন। দিনের বেলায় তিনি সেতু'র পাশে বসে ছবি আঁকেন। রাতে তিনি চা ঘরে চা খান। তিনি বলেছেন, উ জেন নগরের জীবনযাপনের ধারা তার মতো আস্তে আস্তে অনুভব করা সবচেয়ে ভালো। তিনি বলেন,
স্বর্গের শান্তির মতো। খুব ভালো। আমি মনে করি, এখানকার প্রশাসন ও পরিবেশ সংরক্ষণ ব্যবস্থা উভয়ই ভালো। মানুষ হাত দিয়ে এখানে নৌকাবিহার করে। এখানে গুঁড়ো সাবান দিয়ে কাপড় ধোয়া যায় না। সুতরাং রাসায়নিক দূষণ নেই। নদীর তীরের রেস্তোঁরাগুলোও উন্নত। খুব পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন।
চাং কুয়ান ইউয়ান বলেছেন, উ জেন নগরে ২ হাজার হেকটরেরও বেশী জলাভূমি আছে। গ্রীষ্মকালে তিনি আবার আসবেন।
উ জেন নগরে হাঁটলে, দৃশ্য খুঁজে বের করার বিশেষ কোন দরকার নেই। পথের পাশে বিভিন্ন ধরনের হস্তশিল্পের দোকান, উ জেন নগরে প্রাচীন সংস্কৃতি প্রদর্শনী করা যাদুঘর ছাড়াও পুরো সড়ক জুড়ে নানা রকমের দোকানও আছে। বলা যায়, প্রতিটি জায়গায় হাজারেরও বেশি বছরের প্রাচীন নগরের বৈশিষ্ট্যময় সাংস্কৃতিক নিদর্শন দেখা যায়। অবশ্য 'চাও মিং একাডেমী, বাই লিয়ান মন্দিরের টাওয়ারসহ বিভিন্ন ধরনের ঐতিহাসিক নিদর্শন এবং প্রতিটি জায়গার সুন্দর সুন্দর কিংবদন্তী ও গল্প রয়েছে। ফলে এক একজন পর্যটক প্রাচীন নগরের রীতিনীতিতে মুগ্ধ হয়ে যান। ক্লান্ত হলে, সড়কের পাশে যে কোন একটি রেস্তোঁরায় বসে মালিকের নিজ হাতে রান্না করা খাবার খাওয়া, অথবা নদী তীরে বসে ক্রিস্যান্থিম্যাম চা খাওয়া এবং বিকেলের আরামদায়ক জীবন সত্যিই প্রশংসনীয়।
মেই চু ওয়েন উ জেন নগরের একজন সাধারণ অধিবাসী। ছুটি কাটানো মানুষের জন্য তিনি এবং তার স্বামী বাড়ির সকল ঘর দোর পরিষ্কার করে প্রয়োজনীয় জীবনযাপনযোগ্য করে তুলে ছোট্ট একটি ব্যক্তিগত হোটেল খোলেন। তার জন্য সবচেয়ে গর্বের ব্যাপার হচ্ছে তার বাসা চাও মিং একাডেমী থেকে খুবই কাছে। তার বাসায় আসা অধিকাংশ পর্যটক হয় সাংবাদিক ও চিত্রকর না হয় অধ্যাপক বা পন্ডিত। তিনি বলেন,
আমার বাসায় ৬টি ঘর আছে। প্রতি দিন পূর্বনির্ধারিত পর্যটকরা আসেন। গতকাল ছিলেন শান তোং ও পেইচিংয়ের পর্যটক। তারপর জে চিয়াং, সাংহাই বা সিছুয়ানের পর্যটকই এখানে বেশি। আমার বাসা একাডেমীর কাছে থাকার কারণে সাংহাই ফু তান বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপকসহ সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রের অনেক পর্যটক নিয়মিত আসেন।
অন্তর্মঙ্গোলিয়ার ছি ফেংয়ের তরুণ ইয়ু হাই বো প্রথমবারের মতো উ জেন নগরের পাথরের পথে হেঁটে এখানকার বৈশিষ্ট্যময় আকর্ষণশক্তি ও দৃশ্যকে অনুভব করেছেন। তিনি কয়েকজন বন্ধুর সঙ্গে আবারও এখানে এসেছেন। কিন্তু এবার তারা পর্যটক নয়। বরং অধিবাসী।
ইয়ু হাই বো দর্শনীয় স্থানের সৃজনশীল অঞ্চলে একটি দোকান খুলে বিশেষ করে তারা খেলনা গাড়ি বিক্রি করেন। তার বন্ধুরাও নিজস্ব বৈশিষ্ট্যময় দোকান খুলেছেন। তারা বলেছেন, ব্যবসা করার জন্য নয়, তার ভালো লাগা উ জেনের জন্য কিছু সৃজনশীল অবস্থান বাড়ানোর জন্য। ইয়ু হাই বো বলেন,
আমার মনে হয় আয় করা খুব গুরুত্বপূর্ণ নয়। শুধু উ জেনকে পছন্দ করার জন্যই এ কাজ করা। এখানকার কয়েকজনই আমার মতো। তারাও এখানে কাজ করেন আনন্দের জন্য। আগে আমরা একটি কোম্পানিতে কাজ করেছিলাম। আমরা শান তোং ও ছোংছিংয়ের অধিবাসী। এখানকার ভালো বিষয় হচ্ছে নিজের বৈশিষ্ট্য থাকলে প্রতিটি দোকানই এক একটি সাজানো গোছানো দর্শনীয় স্থানের মত মনে হবে।
আগে উ জেন ছিল যাতায়াতের একটি গুরুত্বপূর্ণ সংযোগস্থল। এখান থেকে চার দিকে যাওয়া যায়। ভোরে পাশের জেলা বা শহরের অধিবাসীদের নৌকায় করে চা খাওয়ার পাশাপাশি নিজের বাসার সব্জী ও গৃহপালিত পশু বাজারে নিয়ে বিক্রি করেন। সুতরাং ক্রমে ক্রমে স্থানীয় বাজার গড়ে উঠেছে। খুব সরগরম। নদীর তীরে থাকা অধিবাসীরা জোরে ডাকলে তাদের বাড়ির কাছে নৌবিহার আসে। তারা বাড়ির বাইরে না গিয়ে টাটকা সব্জী কিনতে পারেন। খুব জনপ্রিয়। সুতরাং এখন পর্যন্ত তা একটানা চলছে।
উ জেন নগরের পশ্চিম অংশে রয়েছে একটি পানির বাজার। পানির বাজারের আয়তন প্রায় ৩৪০০ বর্গমিটার। এই পানি অঞ্চলের পূর্ব ও পশ্চিম দিকে নদীর তীরে বাড়িঘর আছে। অনেক ভোরে পানি বাজারটি সরগরম হয়ে উঠে। আট দিক থেকে আসা নৌকা পানির সব জায়গা দখল করে নেয়। নদী তীরের চা ঘর, মাংসের দোকান, হাল্কা খাবারের দোকান এমনকি তৌফুর দোকান সবই রয়েছে।
উ জেন নগরে থাকা মানে শহরে না দেখতে পাওয়া নদী তীরের ধীর জীবনযাপন অনুভব করা হচ্ছে পর্যটকদের এখানে আসার অন্যতম কারণ। উ জেন নগরের পর্যটন উন্নয়ন লিমিটেড কোম্পানির ব্র্যান্ড তথ্য বিভাগের উপ ব্যবস্থাপক ওয়াং চিয়া ছিং বলেন,
উ জেন নগরে আসলে পর্যটকরা পশ্চিম অংশের অধিবাসীদের বাসায় থাকতে পছন্দ করেন। জানালা খুললে বাইরের সি শি নদী দেখা যায়। দৃশ্যটি খুব সুন্দর। এখানে থাকলে আপনি নদীর তীরের অলিন্দে বসে চা খাওয়ার পাশাপাশি বই পড়ে মানসিক তৃপ্তি পাবেন। আপনার মোবাইল ফোন বন্ধ রাখুন, কম্পিউটার ও কাজের অসুবিধা বাদ দিয়ে পুরোপুরিভাবে এখানকার ধীর শান্তি, সৌম্য জীবনযাপন অনুভব করুন। বাইরের একাডেমীতে বই পড়া বা পিং থান স্থানে স্থানীয় সব রসানো গল্প শোনা অবসর বিনোদনের জন্য শ্রেষ্ঠ উপায়। |