v চীনের বিশ্ব কোষv চীন আন্তর্জাতিক বেতারv বাংলা বিভাগ
চীনের "মহাপ্রাচীর সংরক্ষণ প্রকল্প" পর্যায়ক্রমিক সাফল্য
2009-06-03 16:40:33
 বিশ্ববিখ্যাত চীনের মহাপ্রাচীর হচ্ছে বিশ্বের সবচেয়ে দীর্ঘতম প্রাচীনকালের একটি সামরিক স্থাপনা। কিন্তু মহাপ্রাচীরের আসল দৈর্ঘ্য কত? এখনো এর একটি সঠিক উত্তর পাওয়া যায়নি। সম্প্রতি চীনের জাতীয় সাংস্কৃতিক ধ্বংসাবশেষ ব্যুরো এবং জাতীয় সার্ভিং ও ম্যাপিং ব্যুরো যৌথভাবে প্রকাশ করেছে যে, মহাপ্রাচীরের দৈর্ঘ্য হলো ৮৮৫১.৮ কিলোমিটার। চীন প্রথমবারের মতো মহাপ্রাচীরের নির্দিষ্ট দৈর্ঘ্য প্রকাশ করে। মহাপ্রাচীরের দৈর্ঘ্য মাপ করা হচ্ছে চীনে চালানো মহাপ্রচীর সংরক্ষণ প্রকল্পের মধ্যে একটি প্রকল্প। এই সঠিক সংখ্যা মহাপ্রাচীর সংরক্ষণ বিষয়ক এ জাতীয় প্রকল্পের পর্যায়ক্রমিক সাফল্য অর্জনের একটি প্রতীক। তা ভবিষ্যতে মহাপ্রাচীর সুরক্ষার লক্ষ্যে পরিকল্পনা প্রণয়নের জন্যে শক্তিশালী প্রমাণ।

    চীনের মহাপ্রাচীরের নির্মাণ কাজ খৃষ্টপূর্ব সপ্তম বা অস্টম শতাব্দী থেকে শুরু হয়। এর নির্মাণ কাজ একটানা দু'হাজারেরও বেশি বছর ধরে চলেছে। প্রতিটি যুগেই মহাপ্রাচীর নির্মাণের ধ্বংসাবশেষ রয়েছে। এটি চীনের অনেক প্রদেশ, স্বায়ত্ত শাসিত অঞ্চল এবং কেন্দ্র-শাসিত অঞ্চলে বিস্তৃত। চতুর্দশ শতাব্দী থেকে ষোড়শ শতাব্দী পর্যন্ত নির্মিত মিং রাজবংশের মহাপ্রাচীর হচ্ছে ইতিহাসে বৃহত্ ব্যাপকতাসম্পন্ন এবং সবচেয়ে মজবুত মহাপ্রাচীরের একটি অংশ। এবারে মিং রাজবংশের মহাপ্রাচীরের দৈর্ঘ্য প্রকাশিত হয়েছে।

    মহাপ্রাচীরের দৈর্ঘ্য প্রসঙ্গে অনেক বছর ধরে কোন সঠিক পরিমাণ ছিল না। বেসরকারীভাবে লোকজন "দশ হাজার লি'র মহাপ্রাচীর" বলতে অভ্যস্ত ছিল। এখানে লি মানে হুয়া লি। দশ হাজার লি মানে পাঁচ হাজার কিলোমিটার। মৌখিক ভাষায় হাজার লি মানে অনেক অনেক লম্বা। মহাপ্রাচীরের গবেষণা বিষয়ক চীনের বিশেষজ্ঞ, মহাপ্রাচীর সমিতির সম্মানসূচক পরিচালক লুও চে ওয়েন "এক লাখ লি বিস্তৃত" মহাপ্রাচীরের কথা বর্ণনা করেন। তিনি বলেন,

    আমি আগে বলেছিলাম যে, দু'হাজারেরও বেশি বছর ধরে অব্যাহতভাবে মহাপ্রাচীর নির্মাণ করা বিশ্বে আর কখনও দেখা যায়নি। আগের তথ্য অনুযায়ী মহাপ্রাচীরের দৈর্ঘ্য ৫০ হাজারেরও বেশি কিলোমিটার। তা ছাড়া, মহাপ্রাচীরের অর্থও বৈচিত্র্যময়। এটি হচ্ছে চীনের সামন্ত সমাজের একটি প্রতিকী ইতিহাস। এতে চীনের সামন্ত সমাজের পরিবর্তন প্রতিফলিত হয়েছে এবং এটি চীনের বহুজাতির শ্রমজীবির কর্মের ফসল।

    দু'হাজারেরও বেশি বছর ধরে অব্যাহতভাবে নির্মাণ করার মাধ্যমে মহাপ্রাচীর চীনা জনগণের কাছে শুধুমাত্র সুপ্রাচীন একটি সহজ স্থাপনা নয়, এটি জাতীয় মর্মের অন্যতম প্রতীক। তাই মহাপ্রাচীরের সংরক্ষণে চীনা জনগণের অনেক উদ্বেগ মিশে রয়েছে। বর্তমানে ৮০ বছরের লুও চে ওয়েন গত শতাব্দীর ৫০ দশকের প্রথম দিক থেকেই মহাপ্রাচীরের জরিপ ও সংরক্ষণ কাজে অংশ নিয়ে আসছেন। তখন থেকেই নতুন-নির্মিত চীন গণ প্রজাতন্ত্র মহাপ্রাচীরের সঠিক সংরক্ষণের ব্যবস্থা নিতে শুরু করে।

    বর্তমান চীন মহাপ্রাচীরের সংরক্ষণ বিষয়ক সাধারণ কর্ম পরিকল্পনা কার্যকর করছে। ২০০৫ থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত দশ বছরের মধ্যে মহাপ্রাচীরের জ্বালানীসম্পদ জরীপ, মহাপ্রাচীরের সাংস্কৃতিক ধ্বংসাবশেষের ফাইল নির্মাণ, মহাপ্রাচীরের সংরক্ষণের আওতা নির্ধারণ এবং মহাপ্রাচীরের গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চল পুননির্ধারণ করা। এদের মধ্যে একটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ হলো মহাপ্রাচীরের জ্বালানীসম্পদ জরীপ।

    ২০০৭ সালে জাতীয় সার্ভিং ও ম্যাপিং ব্যুরো এবং জাতীয় সাংস্কৃতিক ধ্বংসাবশেষ ব্যুরো যৌথভাবে মিং রাজবংশের মহাপ্রাচীর পরিমাপ করতে শুরু করে। দু'বছরেরও বেশি সময় ধরে জরীপ দলের কয়েক'শরও বেশি সদস্য মিং রাজবংশের মহাপ্রাচীরবর্তী দশটি প্রদেশ, স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চল এবং কেন্দ্র-শাসিত মহানগরে অনেক উন্নত প্রযুক্তি নিয়ে মাঠ পর্যায়ে চালিয়ে মহাপ্রাচীরের নির্দিষ্ট দৈর্ঘ্য জরীপ করেন এবং এর পাশাপাশি সাংস্কৃতিক ও ঐতিহাসিক দিকগুলো পর্যবেক্ষণ করেন। পেইচিং সার্ভিং ও ডিজাইন গবেষণা বিভাগের প্রকৌশলী ওয়াং লেই পেইচিং অংশের মহাপ্রাচীরের জরীপে অংশ নিয়েছেন। তিনি বলেন,

    আমরা আধুনিক পদ্ধতিতে মহাপ্রাচীরের মাপ নিয়েছি। মাঠ পর্যায়ে মহাপ্রাচীরের সূচনা নির্ধারণ করা একটু কঠিন। মাঝখানে কোন কোন পাহাড়কে মহাপ্রাচীরের একটি অংশ হিসেবে নির্ধারণ করতে হবে। আমাদের পাহাড় বেয়ে ওঠতে হবে। কোন কোন পাহাড় খুবই দূর্গম।

    নির্দিষ্ট মাপের মাধ্যমে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী মিং রাজবংশের মহাপ্রাচীর পূর্বে লিয়াও নিং প্রদেশের হু শান থেকে শুরু হয়ে পশ্চিমে কান সু প্রদেশের চিয়া ইউ কুয়ান পর্যন্ত বিস্তৃত হয়। এটি পূর্ব থেকে পশ্চিম পর্যন্ত মোট ১০টি প্রদেশ, স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চল এবং কেন্দ্র শাসিত মহানগরের মধ্য দিয়ে যায়। এর মোট দৈর্ঘ্য হলো ৮৮৫১.৮ কিলোমিটার। এর মধ্যে কৃত্রিম অংশের দৈর্ঘ্য ৬২৫৯.৬ কিলোমিটার এবং প্রাকৃতিক পাহাড়ের দৈর্ঘ্য ২৫৯২.২ কিলোমিটার।

    জরীপের মাধ্যমে মিং রাজবংশের মহাপ্রাচীরের নানা ধরণের স্থাপনা ও সংশ্লিষ্ট সাংস্কৃতিক ধ্বংসাবশেষের নির্দিষ্ট তথ্য পাওয়া যায়। মহাপ্রাচীরের সঙ্গে সম্পর্কিত ৪৯৮টি নানা ধরণের ঐতিহাসিক ধ্বংসাবশেষ নতুনভাবে আবিষ্কার করা হয়।

    বিশেষজ্ঞরা আরো জানিয়েছেন, জরীপ দল দৈর্ঘ্য পরিমাপ করার পাশাপাশি মিং রাজবংশের মহাপ্রাচীরের সংরক্ষণ অবস্থা, প্রাকৃতিক ক্ষয়ক্ষতি এবং মানুষের দ্বারা নষ্ট হয়ে যাবার অবস্থাসহ নির্দিষ্টভাবে জরীপ করেছে এবং প্রচুর সঠিক তথ্য পেয়েছে। এসব তথ্য মহাপ্রাচীরের সংরক্ষণ বিষয়ক পরিকল্পনা প্রণয়ন এবং একটি ফাইল নির্মাণের জন্য যথেষ্ট সুযোগের সৃষ্টি করেছে।

    চীনের জাতীয় সাংস্কৃতিক ধ্বংসাবশেষ ব্যুরোর মহাপরিচালক শান চি সিয়াং বলেন, মহাপ্রাচীরের সঠিক পরিমাপ একটি সংখ্যা দিয়ে করা ছাড়াও, আমরা আরো শক্তিশালী ব্যবস্থা নিয়ে মহাপ্রাচীর সুরক্ষা করবো।

    লীর্ঘ ইতিহাস এবং সমাজের পরিবর্তনের কারণে মহাপ্রাচীর বরাবরই গুরুতর প্রাকৃতিক ও কৃত্রিমভাবে কলংকিত হওয়ার হুমকির সম্মুখীন হচ্ছে। ইতিহাসে যুদ্ধ ও বন্যা মহাপ্রাচীরকে বিনষ্ট করেছিল এবং মহাপ্রাচীরের কাছাকাছি বসবাস করা অধিবাসীরা এর ইট ও মাটি চুরি করে বাড়িঘর নির্মাণ করে মহাপ্রাচীরের ব্যাপক ক্ষতি সৃষ্টি করেছে। শান চি সিয়াং বলেন, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে মহাপ্রাচীরের নিরাপত্তার ওপর হুমকি সৃষ্টি করার উপাদানও পরিবর্তন হচ্ছে। তিনি বলেন

    বর্তমান আমাদের সম্মুখীন আরো বড় হুমকি হলো বিশ্বের জলবায়ুর পরিবেশের পরিবর্তন, অন্য দিকে মানুষের দ্বারা প্রকল্প নষ্ট করা। বিরাটাকারের অবকাঠামো, একসপ্রেস সড়কপথ, রেলগাড়ি এবং সংশ্লিষ্ট স্থাপনা মহাপ্রাচীর অতিক্রম করার সময় মহাপ্রাচীরের কিছু অংশে ক্ষয়ক্ষতির সৃষ্টি করেছে।

    ২০০৬ সালে চীনের জারি করা "মহাপ্রাচীর সংরক্ষণের নিয়মে" নির্ধারণ করা হয় যে, মহাপ্রাচীরের প্রতি কঠোর সুরক্ষা করতে হবে। কোন ইউনিট এবং ব্যক্তি প্রকল্পের নির্মাণের পাশাপাশি মহাপ্রাচীর নির্মূল ও অতিক্রম করবে না। মহাপ্রাচীর সংরক্ষণ বিষয়ক বিশেষজ্ঞ লুও চে ওয়েন বলেন, একটি সাংস্কৃতিক ধ্বংসাবশেষের জন্য বিশেষ নিয়ম প্রণয়ন করার ক্ষেত্রে মহাপ্রাচীর হচ্ছে একমাত্র একটি। তিনি মনে করেন, মহাপ্রাচীর সংরক্ষণের প্রকল্প সম্পর্কিত পরিকল্পনা কার্যকর করার ফলে মহাপ্রাচীর আরো ভালোভাবে সংরক্ষণ করা যাবে। তিনি বলেন,

    আমরা জরিপ ও সার্ভিং করছি। মহাপ্রাচীরের দৈর্ঘ্য কত? বর্তমানের সংরক্ষণের অবস্থা কেমন? পরিকল্পনা অনুযায়ী আগামী দু'বছরের মধ্যে মহাপ্রাচীরের দৈর্ঘ্য রপ্ত করতে পারবো। তারপর এই অবস্থা অনুযায়ী সুরক্ষা ও মেরামতের ব্যবস্থাপনার দিক প্রণয়ন করবো। এই ব্যবস্থাপনাও পর্যায়ক্রমিক।

    জানা গেছে, মিং রাজবংশের মহাপ্রাচীরের জ্বালানীসম্পদ জরীপ হচ্ছে সারা দেশে এ ধরণের জরীপের প্রথম পর্যায়। পরবর্তী পদক্ষেপ হলো ছিন ও হান রাজবংশসহ অন্যান্য যুগের মহাপ্রাচীরের জ্বালানীসম্পদের জরীপ কাজ চালানো। ছিন রাজবংশের মহাপ্রাচীর হচ্ছে চীনের প্রথম জন সামন্ত রাজা ছিন শি হুয়াংয়ের উদ্যোগে নির্মিত। ছিন রাজবংশের মহাপ্রাচীর এর আগে বিভিন্ন দেশের মহাপ্রাচীরের সঙ্গে সংযুক্ত হয়। এখন পর্যন্ত এর ২২০০ বছরের ইতিহাস রয়েছে।

    জানা গেছে, সংশ্লিষ্ট বিভাগের পরিকল্পনা অনুযায়ী আগামী বছরের শেষ দিকে মিং, ছিন ও হান রাজবংশসহ অন্যান্য রাজবংশের মহাপ্রাচীরের মৌলিক সংখ্যা ও জ্বালানীসম্পদের জরীপ কাজ শেষ হবে। এর ভিত্তিতে সংরক্ষণের ব্যবস্থা ও আইন প্রণয়নের কাজও ধাপে ধাপে চালোনা হবে। (লিলি)

  • সাক্ষাত্কার
  • সর্বশেষ সংবাদ
  • অন-লাইন জরীপ
     
    © China Radio International.CRI. All Rights Reserved.
    16A Shijingshan Road, Beijing, China