২০০৯ সালের জানুয়ারী মাসের একটি দিন । তিব্বত সমাজ বিজ্ঞান একাডেমীর একটি অফিসে ৬১ বছর বয়স্ক তিব্বত বিষয়ক বিশেষজ্ঞ কালজান জেশে একাগ্রচিত্তে বই পড়ছেন । তিনি সম্প্রতি তিব্বত প্রাচীন গ্রন্থ প্রকাশনালয়ের অধ্যক্ষ পদ থেকে অবসর নেন । কিন্তু তিনি এখনো প্রতি দিন কাজে ব্যস্ত আছেন । তিনি সারা জীবন তিব্বত বিষয়ক গবেষণার কাজে নিয়োজিত রয়েছেন । তিনি বলেন , এ ক্ষেত্রের কাজের শেষ নেই । সুতরাং এ ক্ষেত্রে নিরলস প্রচেষ্টা চালাতে হবে । তিব্বত বিষয়ক তার গবেষণার কাজের কথা বলতে গিয়ে তিনি বলেন ,
১৯৪৮ সালে লাসা শহরের উপকন্ঠের একটি গ্রামে কালজান জেশের জন্ম । ছোট বেলায় তার বাবা মা মারা যান । তিনি দিদির লালন পালনে বড় হয়ে উঠেন । তার পূর্বপুরুষরা ছিলেন ভূমি দাস , প্রভুদের জন্য বাধ্যতামূলকভাবে কৃষি কাজ করতেন । যখন তিনি অল্পবয়সী ছিলেন , তখন তার পরিবার অত্যন্ত গরীব ছিল , বাড়িতে নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যেরও অভাব ছিল ।
ভূমি দাস ব্যবস্থা ও পুরনো তিব্বত সম্পর্কে তিনি বলেন ,
পুরনো তিব্বতে ভূমি দাস এবং গরীব কৃষক ও পশুপালকদের অত্যাচার ও নির্যাতনের জন্য ৫০টি আইন কার্যকর করা হতো । এর মধ্যে দু'টি আইন কয়েক শ' বছর প্রচলিত ছিল । এ দুটো আইন অনুযায়ী বিভিন্ন মানুষকে বিভিন্ন পর্যায়ে বিভক্ত করা হতো । অভিজাত সম্প্রদায় , মন্দিরের জীবিত বৌদ্ধ , লামা ও সরকারী কর্মকর্তা ছিলেন তিব্বতের শাসক ও শোষক । তাদেরকে তিব্বতের উচ্চবংশ সম্প্রদায় বলে মনে করা হতো । তিব্বতে ভূমি দাসকে শাসক ও শোষকদের জীবিত হাতিয়ার বলে চোখে দেখা হতো ।
১৯৫৯ সালে তিব্বতে গণআন্ত্রিক সংস্কার চালু করা হয় । সামন্ততান্ত্রিক ভূমি দাস ব্যবস্থা বাতিল করা হয় । এতে অল্পবয়সী কালজান জেশে সমাজের পরিবর্তন অনুভব করেন এবং স্কুলে লেখাপড়ার সুযোগ পান ।
শান্তিপূর্ণ মুক্তি পাওয়ার আগে তিব্বতে শিক্ষা ব্যবস্থা অত্যন্ত অনুন্নত ছিল । ভূমি দাসের বংশধরদের পড়াশুনার সুযোগ পাওয়া যেতো না । ১৯৫৮ সালে কালজান জেশে লাসা দুই নং প্রাথমিক স্কুলে ভর্তি হন । খাওয়া , পরা ও থাকাসহ লেখাপড়ার যে সব খরচ লাগতো , সে সব খরচ সরকার বহন করতো ।
উচ্চ মাধ্যমিক স্কুল থেকে স্নাতক হওয়ার পর তাকে কেন্দ্রীয় সংখ্যালঘু জাতি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার সুযোগ দেয়া হয় । তিনি ওখানে প্রাচীন তিব্বতী ভাষা পড়াশুনা করতেন । ১৯৭৮ সালে কালজান জেশে পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে চীনের সমাজ বিজ্ঞান একাডেমীতে ভর্তি হন । তিনি মাস্টার্স ডিগ্রি নিয়ে প্রাচীন তিব্বতী ভাষা অধ্যয়ন করতেন । ওখান থেকে পাস করার পর চাকরি করার জন্য তিনি তিব্বত সমাজ বিজ্ঞান একাডেমীতে ফিরে এসেছেন ।
তিব্বত সমাজ বিজ্ঞান একাডেমীতে তিনি তিব্বতী জাতির প্রাচীন গ্রন্থ বিষয়ক গবেষণায় নিয়োজিত রয়েছেন । তিনি পর পর তিব্বতী সাহিত্য ইতিহাসের নতুন অধ্যায় এবং তিব্বতী জাতির সাহিত্য কর্ম সম্পর্কে বেশ কয়েকটি প্রবন্ধ রচনা করেছেন এবং তিব্বতী ভাষা থেকে হান ভাষায় তিব্বতের ইতিহাস শিরোনামে বই অনুবাদের কাজেও যোগ দেন ।
তিব্বতী প্রাচীন গ্রন্থ সংগ্রহ ও প্রকাশনার জন্য গত শতাব্দির শেষ নাগাদ তিব্বতে প্রাচীন গ্রন্থ প্রকাশনালয় গঠিত হয় । এ প্রকাশনালয়ের মাধ্যমে তিব্বতের নানা ধরনের প্রাচীন গ্রন্থ সংগ্রহ ও সংরক্ষণ করা হয়েছে । ২০০৩ সালে কালজান জেশে প্রকাশনালয়ের প্রধান নিযুক্ত হন । গত কয়েক বছর ধরে তিনি নিরলসভাবে তিব্বতী প্রাচীন গ্রন্থের রচনা ও অনুবাদের কাজে তত্পর রয়েছেন । বিবিধ মূল্যবান গ্রন্থ সংগ্রহের জন্য তাকে এখনো সর্বত্রই ঘুরে বেড়াতে হচ্ছে । তিনি আনন্দের সঙ্গে বলেন , তিনি তিব্বতী সংস্কৃতিকে উত্তরাধিকার সূত্রে গ্রহণের জন্য যথাসাধ্য চেষ্টা করেছেন ।
এ পর্যন্ত তার প্রকাশনালয়ের মাধ্যমে ৫০ ধরনের গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে । প্রাচীনকালে হাতের লেখা বা কাঠ খোদাই করার মাধ্যমে বই লেখা হতো । সুতরাং তখন গ্রন্থ জনপ্রিয় করে তোলা সম্ভব ছিল না । কিন্তু শিল্পকলা ও মূল্যের দিক থেকে এ সব বই দুর্লভ । সেগুলো তিব্বত ও তিব্বতী ভাষা বিষয়ক বিশেষজ্ঞদের সাদর পেয়েছে । যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় লাইব্রেরীতে এ সব বই সংরক্ষিত রয়েছে । এ ছাড়াও জাপান , ব্রিটেন ও নরওয়েসহ অন্যান্য দেশেও এ ধরনের বই পাওয়া যায় ।
কালজান জেশে বলেন , ১৯৫৯ সালে তিব্বতে গণতান্ত্রিক সংস্কারের পর চীন সরকার বরাবরই তিব্বতের সংস্কৃতি সংরক্ষণের ওপর গুরুত্ব দিয়ে আসছে । সাম্প্রতিক বছরগুলোতে চীন সরকার আরো বেশি অর্থ বরাদ্দ করার মাধ্যমে তিব্বতের বিভিন্ন অঞ্চলের পুরাকীর্তি ও অবস্তুগত সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকার ভালভাবে সংরক্ষণ এবং উত্তরাধিকার সূত্রে গ্রহণ করা সম্ভব হয়েছে ।
কিং গেসারের জীবনী নামক তিব্বতের বিখ্যাত ঐতিহাসিক মহাকাব্য প্রসঙ্গে কালজান জেশে বলেন ,
পুরনো তিব্বতে কেউই কিং গেসার জীবনীর ওপর মনোযোগ দিতেন না । তখন এ অঞ্চলে শিক্ষা ব্যবস্থা অত্যন্ত অনুন্নত ছিল । কিং গেসারের জীবনী মহাকাব্য এক হাজার বছরেরও বেশি পুরনো । তার কোন লিখিত ভাষা নেই । প্রচার করা হয় মানুষের মুখের মাধ্যমে । এ মহাকাব্য যাতে উত্তরাধিকার সূত্রে গ্রহণ করা যায় , সেজন্য তিব্বত সমাজ বিজ্ঞান একাডেমীও উদ্যোগের সঙ্গে তথ্য সংগ্রহের চেষ্টা করে যাচ্ছে । লোক শিল্পীদের পরিবেশনার মাধ্যমে রেকর্ডিং করা হয়েছে এবং তা নিয়ে বই প্রকাশের চেষ্টা করা হয়েছে । বর্তমানে চীনে তিব্বত বিষয়ক গবেষণাগারের সংখ্যা পঞ্চাশটিরও বেশি । তিব্বতী ভাষার পত্র-পত্রিকার সংখ্যা দশ বারোটিতে দাঁড়িয়েছে ।
(থান ইয়াও খাং) |