v চীনের বিশ্ব কোষv চীন আন্তর্জাতিক বেতারv বাংলা বিভাগ
সাফারিনির চোখের চীন
2009-01-09 21:10:23

    আমি এবং চীন সম্পর্কের গল্প সুদীর্ঘ এবং খুব মজার । চীনে আমি ৪০ বছরের অভিজ্ঞতার একজন প্রত্যক্ষদর্শী। আমি চীনের উন্নয়নও অনুভব করেছি।

    আপনারা যে কথা শুনছেন , তা হল প্রায় ৬০ বছর বয়সী একজন বিদেশী বৃদ্ধর মনের কথা । তিনি নয়া চীনের সমবয়সী । নয়াচীনের উন্নয়ন ও পরিবর্তনের সঙ্গে তার জীবনের খুব ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে। তিনি হলেন চীনে নিযুক্ত ফিলিস্তিনের সাবেক রাষ্ট্রদূত মুস্তফা আল সাফারিনি।

    সকালে সংবাদদাতা সাফারিনির সাক্ষাত্কার নিয়েছেন । যখন তার অফিসে ঢুকেন , তখন সংবাদদাতা দেখেছেন যে তার অফিসের স্টাইল একদম চীনের । চীনের পুরোনো স্টাইলের রেডিও , চীনের বৈচিত্রময় চেয়ার ও টেবিল। টিভিতে চীনের সকালের সংবাদ অনুষ্ঠান প্রচার হচ্ছে । এসব কিছু থেকে বোঝা যায় , তিনি চীন সম্পর্কে খুব ভালো জানেন ।

    সাক্ষাত্কালে সাফারিনির অনেক কথা সংবাদদাতাকে অবাক করেছে। যেমন , পরিকল্পনা অর্থনীতি , বাজার অর্থনীতি , আকাশ পাতাল পরিবর্তন , সময় মানুষের জন্য অপেক্ষা করে না এবং সংস্কার ও উন্মুক্তকরণ । তার কথা থেকে বুঝা যায় , তিনি চীনের পরিবর্তনের ওপর সবসময় নজর রাখেন ।

    চীনের যুবকদের দেখে তিনি সবসময় বলেন , আমি তোমার চেয়ে কম বয়সে চীনে এসেছি । তিনি এভাবেই চীনের প্রতি তার ভালোবাসা প্রকাশ করেন । ১৯৬৮ সালে ১৮ বছর বয়সী সাফারিনির সাহসের কারণে ফিলিস্তিন মুক্তি সংস্থার নেতা আরাফাতের নজরে পড়েন। পরে সাফারিনিকে চীনে লেখাপড়া করতে পাঠানো হয়। দু'বছর পর একটি সুযোগে তিনি আবার চীনে এসে কূটনীতিকের কাজ শুরু করেন । এরপর চীনের শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের ব্যবস্থাপনায় তিনি চাকরির পাশপাশি পেইচিং বিশ্ববিদ্যালয়ে লেখাপড়া করেন । তখন তিনি একটি কালো রঙের সাইকেল চালিয়ে পেইচিংয়ের সান লি থুন ও দূতাবাস এলাকায় যাতায়াত করতেন। তিনি স্মরণ করে বলেন, গত শতাব্দীর ৭০'র দশকে পেইচিংয়ের তৃতীয় রিং ও চতুর্থ রিংর মধ্যে প্রায় সব জায়গাই ছিল কৃষি ভূমি ও কৃষকদের বাসস্থান । কোনো উচ্চ ভবন ছিল না । এখন সেখানে প্রতিদিন সকালে দেখা যায় হাজার হাজার মানুষ সাইকেল চালিয়ে অফিসে যায় । যাত্রী ভরা বাসও অনেক বেশি । আগে এমন দৃশ্য দেখা যায় নি। এখন সেখানে বিশ্বের সবচেয়ে আধুনিক ও সমৃদ্ধ রাস্তার উন্নত স্থান।

    প্রায় ৪০ বছর পার হয়ে গেল। সাফারিনি সবসময় অতীতকে মনে পড়ে। তিনি গাড়ি চালিয়ে আগের স্মৃতিকে খুঁজতে পছন্দ করেন। তবে তিনি সবসময় পেইচিংয়ে পথ হারান। তিনি বলেন: কয়েক দিন আগে আমি গাড়ি চালিয়ে এশিয়ান গেমস পল্লী থেকে সান লি থুনে যাই। আমি তিনবার পথ ভুল করেছি। একটি ফ্লাইওভার থেকে নেমে অন্য জায়গায় পৌঁছেছি । আমি খুব অবাক হয়েছি যে একটি ফ্লাইওভার আমাকে ভুল জায়গায় নিয়ে গেছে। তা হল পেইচিং। প্রতিদিন আমি তার পরিবর্তন দেখছি।

    সাক্ষাত্কালে সাফারিনি সংবাদদাতাকে জানান , তার প্রথমে চীনে আসা , বিশেষ করে শীতকালের কথা স্মরণ করতে ভয় লাগে । তখন চীন সবেমাত্র পরিকল্পনা অর্থনীতির সময়পর্বে রয়েছে। দ্রব্য সামগ্রীর সরবরাহের খুব অভাব। দৈনন্দিন জিনিস-পত্র কিনলে টিকেট লাগে। তিনি বলেন: তখনকার জীবন ছিল খুব কঠিন। তখন আমি শীতকালকে পছন্দ করতাম না। এখন শীতকালে আমরা বিভিন্ন রকমের গরম কাপড় পরতে পারি , শীতকালের ঠান্ডা তেমন অনুভব করতে পারি না ।তখন শুধু সরকারের বিতরণ করা টিকেট নিয়ে শীতকালের গরম কাপড় কিনতে পারতাম ।

    আসলে তখনকার চীনে গরম কাপড় ছাড়া দৈনন্দিন সব জিনিস কিনলে টিকেট লাগত। সাফারিনি বলেন , তখন জিনিস কেনা তার জন্য একটি সমস্যা মনে হতো। তিনি বলেন: তখন দোকানে জিনিস কিনতে গেলে বিক্রেতা ক্রেতাদের সাথে কথা বলতে চাইতো না। তুমি কিনবে কী কিনবে না , তা নিয়ে বিক্রেতার কোন মাথা ব্যথা ছিল না ।

    ১৯৭৮ সালে চীনে সংস্কার ও উন্মুক্তকরণ নীতি চালু হয়। পরিকল্পনা অর্থনীতি আস্তে আস্তে বাজার অর্থনীতিতে পরিণত হয়েছে । এ নীতি কার্যকর হওয়ায় চীনের অর্থনৈতিক উন্নয়নকে প্রাণোজ্জ্বল করেছে। পণ্যদ্রব্যের সরবরাহও বেশি হয়েছে । সাফারিনি বলেন: এখন আপনি চীনের বাজারে গিয়ে দেখতে পারেন বিভিন্ন ধরনের অনেক পণ্যদ্রব্য । বিক্রেতারা ইংরেজী বা রুশ ভাষায় দেশ বিদেশি ক্রেতাকে পণ্যদ্রব্যের গুণগতমান সম্পর্কে অবহিত করে। আপনি তাদের কাছ থেকে ডিস্কাউন্ট জানতে পারেন। এটা হল চীনের আসল অবাধ বাজার ।

    এ ছাড়া চীনের সংস্কার ও উন্মুক্তকরণের পাশাপাশি চীন ও বিদেশের বিভিন্ন ক্ষেত্রের দ্বিপক্ষীয় ও বহুপক্ষীয় সম্পর্কও দিন দিন ঘনিষ্ঠ হচ্ছে । ১৯৭০ সালে সাফারিনি প্রথমবারের মত কূটনীতিকের চাকরিতে ঢোকেন । তিনি চীনে ফিলিস্তিনের কার্যালয়ের উপ পরিচালক ছিলেন । তিনি বলেন , তখন চীন ও আরব দেশগুলোর বিনিময় সম্পর্ক শুধু রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক ক্ষেত্রের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। দু'পক্ষের আর্থ-বাণিজ্যিক বিনিময় ছিল খুব কম। ৭০ দশকের শেষ দিকে চীনের সংস্কার ও উন্মুক্তকরণ নীতি চালু হওয়ার পর চীন ও বিভিন্ন দেশের বিনিময় ও সহযোগিতা অব্যহতভাবে সম্প্রসারিত হতে থাকে। বিশেষ করে ২০০১ সালে চীন বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার সদস্য হওয়ার পর বহির্বিশ্বে চীনের বাজারের দরজা পুরোপুরিভাবে খুলেছে । চীন ও আরব দেশগুলোর আর্থ-বাণিজ্যিক সহযোগিতার ব্যাপক উন্নয়ন হয়েছে । তখন সাফারিনি চীনে নিযুক্ত ফিলিস্তিনের রাষ্ট্রদূত ছিলেন । তিনি দু'পক্ষের আর্থ-বাণিজ্যিক উন্নয়ন পর্যবেক্ষণ করেছেন। তিনি বলেন: ১৯৬৯ সালে চীন ও আরব দেশগুলোর বাণিজ্য বিনিময় মূল্য ছিল শুধু ৩০ লাখ মার্কিন ডলার । ১৯৭৯ সালে তা গিয়ে দাঁড়ায় ১ কোটি মার্কিন ডলারের কিছু কমে। তবে ২০০৭ সালে এ পরিমাণ ৮৬ কোটি মার্কিন ডলারে গিয়ে দাঁড়িয়েছে । আগে তা কল্পনাও করা যায় নি।

    ২০০০ সালে চীন-আফ্রিকা সহযোগিতা ফোরামের প্রথম মন্ত্রী পর্যায়ের সম্মেলন পেইচিংয়ে অনুষ্ঠিত হয় এবং তা সফলও হয়েছে। সাফারিনি বলেন, এ ফোরাম থেকে চীন ও আরব দেশগুলোর একটি ফোরাম গঠনের কথাও তখন আমি চিন্তা করেছি । চীনা ভাষা জানা সাফারিনির অনেক বন্ধু আছে । তিনি মনে করেন আরব দেশগুলো এবং চীন আর্থ-বাণিজ্যিক ক্ষেত্রে পরস্পরকে সাহায্য করতে পারে। আরব দেশগুলো চীনের সঙ্গে সহযোগিতা করতে প্রস্তুত। ২০০৪ সালে চীন ও আরব দেশগুলোর কাংক্ষিত ফোরাম গঠিত হয় এবং দু'পক্ষের প্রথম মন্ত্রী পর্যায়ের সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়েছে । এ ক্ষেত্রে সাফারিনি অনেক চেষ্টা করেছেন এবং অবদান রেখেছেন ।

    ২০০৪ সালে যখন সাফারিনি চীনে নিযুক্ত ফিলিস্তিনের রাষ্ট্রদূতের পদ থেকে অবসর নেন, তখন তিনি পেইচিংয়ে আরব তথ্য বিনিময় কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করেন। এ কেন্দ্র বিশেষ করে আরব দেশের ব্যবসায়ীদেরকে চীনের পুঁজি বিনিয়োগ পরিবেশসহ বিভিন্ন সহায়ক তথ্য দেয় এবং চীন ও আরব দেশগুলোর বেসরকারী বাণিজ্যিক সহযোগিতার জন্য সেঁতু তৈরি করে। তথ্য বিনিময়ের জন্য তিনি একটি ওয়েবসাইট স্থাপন করেছেন । চীনা ভাষা ও আরবী ভাষায় চীন ও আরব দেশগুলোর পুঁজি বিনিয়োগ তথ্য প্রকাশ করা হয়। তিনি সংবাদদাতাকে জানান: এখন চীনে বিভিন্ন ক্ষেত্রে চ্যালেঞ্জ ও প্রতিদ্বন্দ্ধতা দেখা যায়। আমার এ কেন্দ্র প্রতিষ্ঠার কারণ হল আমি জানি আরব দেশের ব্যবসায়ীরা চীন সম্পর্কে আরো বেশি জানতে চায় । তারা চীনে আসতে চায় । এখন চীনের ব্যবসায়ীরা আরব দেশগুলো এবং তার জনগণকে জানতেও আগ্রহী।

    সাফারিনি গত ৩০ বছরে চীনের উন্নয়ন ও পরিবর্তন লক্ষ্য করেছেন। তিনি চীনের উন্নয়নের জন্যও গর্বিত। (শুয়েন ফেই ফেই)

  • সাক্ষাত্কার
  • সর্বশেষ সংবাদ
  • অন-লাইন জরীপ
     
    © China Radio International.CRI. All Rights Reserved.
    16A Shijingshan Road, Beijing, China