মহিউদ্দিন তাহের
ইতিহাস সত্যি যেন এক গহীন অরণ্য, যেন অতল সাগর, যেন অসীম আকাশ। কারণ সৃষ্টির ইতিহাস, মানব জাতির ইতিহাস, সভ্যতার ইতিহাস—কত যে দীর্ঘ, কত লক্ষকোটি বছরের পথ পরিক্রমা তার-তা এখনো মানব জাতির জন্যে এক অনন্ত গবেষণার আধার।
মনে পড়ে একদিন চীনে ছিলাম। প্রায় সাড়ে ন'বছরের চীনা জীবনের অগুনতি স্মৃতি বুকের ভেতর দেদীপ্যমান দীপ হয়ে থাকে। আমি এবং আমার চীনা জীবন দুই-ই এখন ইতিহাস।স্বাভাবিক নিয়মেই। যে দিনটিকে আমরা ' আজ বলছি, আগামীকাল তা' গতকাল হয়ে যাবে। এভাবেই গত হয় জীবন, গতায়ু হয় মানুষ। আমিও তার ব্যতিক্রম নই। তবে আমার চীনা জীবনের স্মৃতি চির-অমলিন, চির-জাগরুক।
চীনা সভ্যতার লিখিত ইতিহাস পাঁচ হাজার বছরের হলেও তা আরও দীর্ঘ আরও পুরনো হতে পারে, হওয়াটাই স্বাভাবিক। মানুষ কবে থেকে লিখতে শুরু করলো, তারও কতো আগে তার সভ্যতাই বা শুরু হলো, তা নিয়ে কি কোনো প্রমাণিত দলিল আছে?
আমার প্রতিপাদ্য চীনের ইতিহাস নয়। স্বল্প পরিসরে আমি শুধু এক অসাধারণ বৈশিষ্ট্যমন্ডিত শহরের খন্ডিত চিত্র তুলে ধরার চেষ্টা করবো আমার প্রিয় শ্রোতাবন্ধুদের জন্যে। তার জন্যে আমার স্মৃতির পাতা উল্টাতে গিয়ে মনে পরলো এখন শীতকাল। আর শীতকাল মানেই বরফের শুভ্র গালিচায় ঢাকা উত্তরপূর্ব চীনের হেইলোং চিয়াং প্রদেশের রাজধানী হারবিন।
চলুন তাহলে দু'দন্ডের জন্যে শব্দচিত্রের খেয়ায় ভেসে বেড়িয়ে আসি শীত নগরী হারবিন থেকে।
কনকনে শীতের তীব্রতায় সারা পৃথিবী যখন জবুথবু, তখন পৃথিবীর অন্যতম শীতলতম শহর হারবিন যৌবনের হীরক দ্যুতিতে জ্বলজ্বল করে। ডিসেম্বর-জানুয়ারীর দিকে তার তাপমাত্রা হিমাঙ্কের নিচে ২০-৪০ ডিগ্রী সেলসিয়াসে উঠানামা করে। তখন সারা হারবিন জুড়ে গাছে গাছে তুষারের আস্তরণ জমে ফিতার মতো ঝুলতে থাকে, এক অপূর্ব দৃশ্যের অবতারণা হয় তখন। আবহাওয়া বিজ্ঞানের ভাষায় একটিকে বলে Soft Rime বা প্রস্তরায়িত তুয়ার। এ সময় হারবিন নড়রীর কেন্দ্রস্থলে ইউরোপীয় স্টাইলের ত্রিভূজাকৃতির কিংবা কোণাকার দালানগুলো আর সেগুলোর চারলোর চারপাশে চকচকে তুষার আর বরফের আচ্ছাদন চোখ ঝলসানো সৌন্দর্যে ফুটে ওঠে।
গভীর শীতের সময় হারবিন নগরীর রাজপথ ধরে হাটতে শুরু করলে রাস্তার দু'পাশের দালানগুলোর জানালার শার্শীর ওপর জমে থাকা বরফের নানান বৈচিত্রময় দৃশ্য চোখে পড়বে। তুষারের অসাধারণ শিল্পকর্ম দেখে মনে হয় কোনোটা পাখির পালকের মতো, কোনোটা বা যেনো বন, কোনোটা প্রবাল, কোনোটা প্রাচীন দুর্গ, কোনো কোনোটা আবার যেনো গ্রামের আকার ধারণ করেছে।
সবকটা দালানের ব্যালকনি কাঁচের দেয়াল দিয়ে ঢাকা, যাতে ধূলা থেকে রক্ষা পাওয়া যায় এবং ভেতরটাও ঊষ্ণ রাখা যায়। ওখানকার অধিবাসীরা এসময় তাদের সংরক্ষনযোগ্য খাবার, তরিতরকারি, মাছ-মাত্স ব্যালকনিতে ফেলে রাখেন। কারণ তখন ব্যালকনিটাই বড়োসড়ো এক প্রাকৃতিক রেফ্রিজারেটর । শীতের মওসুমে এটি উত্তর চীনের একটি নৈমিত্তিক দৃশ্য।
তাপমাত্রা যতই কমতে থাকে, ততই এখানকার লোকেরা আইসক্রিম খেতে পছন্দ করেন। আর তাপমাত্রা মাইনাস ৩০ ডিগ্রীতে গিয়ে ঠেকলেই লোকেরা ভারী গরম কাপড় পরে আইসক্রিম খেতে শুরু করেন। রাজপথে তখন ফেরিওয়ালারা বিপুল উদ্যমে বৈঁচি ফলের মিঠাই বিক্রি করে।
হারবিনের সাধারণ মানুষ হিমায়িত নামপাতি, চীনা গাব(পারসিমন) আর আপেল খুবই ভালবাসেন । তারা খাওয়ার আগে এ সব ফল উষ্ণ পানিতে চুবিয়ে বরফের আন্তরণ পরিস্কার করেন। ফলগুলো তখন শীতল এবং সু-স্বাদু।
হারবিনের প্রধান নদী সংহুয়া যখন হিমায়িত হয়ে পড়ে, তখন লোকেরা নদীতে নেমে বরফ কেটে কেটে বরফের টুকরো বয়ে শহরে নিয়ে গিয়ে বরফের পার্ক বানান। এমন কি কয়েক মিটার উঁচু বরফের স্লাইড বা স্লিপার তৈরি করে গড়াগড়ি খেলতে থাকে। যে সব শিশু-কিশোর ততটা সাহসী নয়, তারা নানা ধরণের পুতুল বা অন্যান্য বস্তু স্লাইডের উপর থেকে ছেড়ে দিয়ে আনন্দ লুটে নেয়। সুংহুয়া নদীতে স্কেটিং পর্যটকদের জন্যে একটি অপরিহার্য অভিজ্ঞতা।
শীতকালীন হারবিনের আরও একটি অসাধারণ আকর্ষণ আছে। তা হচ্ছে বরফের স্থাপত্য প্রদর্শনী। ওখানকার লোকেরা বরফের ওপর নানান শিলালিপি এঁকে বা বরফের লন্ঠন বানিয়ে একটিকে শিল্পরুপ দিয়েছেন। বরফের তৈরি জীবজন্তু, ফুল, গাছপালা, দালান, বাগান, প্যাতিলিয়ন, সেতু, এমন কি পৃথিবীর বিখ্যাত প্রাচিন সপ্তশ্চর্য যেমন চীনের মহাপ্রচীর, ফ্রান্সের আইফেল টাওয়ার, ভারতের তাজমহল পর্যন্ত এ সবই এখানকার অনন্য আকর্ষণ। ১৯৮৫ সাল থেকে হারবিনে বার্ষিক তুষার ও বরফ উত্সব উদযাপিত হচ্ছে, যেখানে দেশী-বিদেশী বহু চারু ও তাস্কর্যশিল্পী অংশ নিয়ে থাকেন।
অন্য কথায় বলতে গেলে বলতেই হয়, গভীর শীতের হিমেল ছোঁয়ায় হারবিন যেন পূর্ণ যৌবন লাভ করে। তখন তার অঙ্গময় হীরক-দ্যুতি ঝলমল করতে থাকে।
শিল্পরসিক পর্যটকদের অন্তত একবার হলেও শীতের হারবিন দেখতে যাওয়া উচিত। |