২০০৯ সালের ১ জানুয়ারী হবে চীনের আন্তর্জাতিক বেতারের বাংলা অনুষ্ঠান চালু হওয়ার ৪০তম বার্ষিকী । গত ৪০ বছর ধরে বাংলা অনুষ্ঠানের কাজে নিয়োজিত একজন প্রবীণ কর্মী হিসেবে এ উপলক্ষে আমি উদ্বেলিত না হয়ে পারি না । অতীতের অনেক কথা হঠাত আমার মনে পড়ছে । বিশেষ করে বিংশ শতাব্দির আশির দশকের মাঝামাঝি সময় থেকে নব্বইয়ের দশকের প্রথম দিক পর্যন্ত বাংলাদেশের তত্কালীন প্রেসিডেন্ট ও প্রধানমন্ত্রীর সংগে আমার সাক্ষাত্কার আমার মনে এখনো জ্বলজ্বল করছে ।
১৯৮৫ সালের ৪ থেকে ৯ জুলাই পর্যন্ত বাংলাদেশর তত্কালীন প্রেসিডেন্ট হোসেইন মোহাম্মদ এরশাদ চীনে সরকারী ও শুভেচ্ছা সফর করেন । তখন তার সফরসূচী অত্যন্ত সংক্ষিপ্ত ছিল । পেইচিংয়ে তার অবস্থানের সময় ছিল মাত্র দেড় দিন । তবে চীন আন্তর্জাতিক বেতারের একজন সংবাদদাতা হিসেবে আমি উদ্যোগের সংগে চীনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের প্রটোকল বিভাগ ও এশিয় বিভাগের সংগে যোগাযোগ করে তাদের সহায়তা পেয়েছি । এর সুবাদে পেইচিং সফররত প্রেসিডেন্ট এরশাদের সংগে আমার বিশেষ সাক্ষাত্কারের সুযোগ ঘটে ।
৫ জুলাই বিকেল পাঁচটার দিকে আমি গাড়িতে করে তিয়ান ইয়ু থাই রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবনে যাই । আমি একটি ভবনের দুতলার একটি সম্মেলন কক্ষে বসলাম । কিছুক্ষণ পর জেনারেল এরশাদ হাসিমুখে সম্মেলন কক্ষে প্রবেশ করলেন । আমি দ্রুত সামনে এগিয়ে গিয়ে বাংলা ভাষায় তার সংগে কুশল বিনিময় করলাম । তিনি আমার হাত ধরে বললেন , " আপনার সংগে আমার কোথাও দেখা হয়েছে । " আমি তাকে বললাম , ১৯৮২ সালে বাংলাদেশের মন্ত্রিসভার সভাপতি হিসেবে চীন সফরের সময় পেইচিংয়ের মহা গণ ভবনে আমি তার বিশেষ সাক্ষাত্কার নিয়েছি । সবাই সোফায় বসার পর প্রেসিডেন্ট এরশাদ অন্তরংগ পরিবেশে আমার সংগে কথাবর্তা বলতে শুরু করলেন । তিনি জিজ্ঞেস করলেন , আমি কোথায় বাংলা ভাষা শিখেছি , কত সময় ধরে বাংলা শিখেছি এবং এ ভাষাকে ভালোবাসি কিনা । উত্তরে আমি তাকে বললাম , ১৯৬৫ থেকে ১৯৬৯ সাল পর্যন্ত আমি বাংলা একাডেমীতে বাংলা ভাষা শিখেছি । স্বেদেশে ফেরার পর আমি চীনের আন্তর্জাতিক বেতারে এসে বাংলা অনুষ্ঠানের কাজ করে যাচ্ছি। আমি বাংলা ভাষাকে ভীষণ ভালোবাসি । এ কথা শুনে তিনি আনন্দের সংগে বললেন , ভালো , খুব ভালো । আমি বললাম , " আমি চীন আন্তর্জাতিক বেতারের পক্ষ থেকে আপনাকে কিছু প্রশ্ন করতে পারি কি ?" তিনি বললেন , " অবশ্যই" । আমি প্রথমে তাকে ১৯৭৯ ও ১৯৮২ সালের তুলনায় এবারের চীন সফরে তার নতুন অভিজ্ঞতা সম্পর্কে কিছু বলার অনুরোধ করলাম । এরশাদ বলেন , " আড়াই বছর পর আবার আপনাদের রাজধানী পেইচিংয়ে এসে আমি দেখলাম , পেইচিংয়ে বিরাট পরিবর্তন ঘটেছে । এবারের সফরে আমি নিজের চোখে আধুনিকায়নের কাজে চীনের অসাধারণ সাফল্য দেখেছি । চীনের নেতৃবৃন্দের বিচক্ষণ ও দূরদর্শী নীতি এবং চীনা জনগণের পরিশ্রম আমাকে গভীরভাবে অভিভূত করেছে ।" যখন আমি তাকে চীন ও বাংলাদেশের সম্পর্ক উন্নয়নের ভবিষ্যত সম্ভাবনা সম্পর্কে কিছু বলার অনুরোধ করলে , তিনি বলেন , " আমাদের দু দেশের সম্পর্ক উন্নয়নের উজ্জ্বল সম্ভাবনা রয়েছে । আমি চীন ও বাংলাদেশের সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক ও সহযোগিতার ভবিষ্যত সম্পর্কে আশাবাদী । মনখোলা পরিবেশে আমাদের দু দেশের নেতাদের বৈঠকের মধ্য দিয়ে আমি এ সম্পর্কে আরো আস্থাবান হয়েছি । "
১৯৯২ সালের প্রথম দিকে বাংলাদেশ চীনের আন্তর্জাতিক বেতার শ্রোতা সংঘের জাতীয় কমিটির আমন্ত্রণে আমার নেতৃত্বে পরিচালিত চীন আন্তর্জাতিক বেতারের তিন সদস্যের একটি শুভেচ্ছা প্রতিনিধিদল বাংলাদেশ সফর করে । তারা বাংলা দেশের বিভিন্ন স্থানের অগণিত শ্রোতার প্রাণঢালা সম্বর্ধনা পেয়েছেন । সফরটি অত্যন্ত ফলপ্রসু হয়েছিল । এ সফরের ফাঁকে ফাঁকে আমরা বাংলাদেশের তত্কালীন আইন ও বিচার মন্ত্রী মীর্জা গোলাম হাফিজ এবং শ্রম ও সমাজ কল্যাণ মন্ত্রী মান্নান ভূঁয়াসহ বেশ কয়েকজন পদস্থ কর্মকর্তার সাক্ষাত্কার নিয়েছিলাম । তবে দু:খের বিষয় ছিল পূর্ব পরিকল্পনা অনুসারে আমরা যাওয়ার দিন বিকেল পর্যন্ত আমরা তত্কালীন প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার সাক্ষাত্কার নিতে পারি নি । বিকেল ৬টার দিকে যখন আমরা স্থানীয় একটি চীনা রেস্তোঁরায় খাচ্ছিলাম , ঠিক সে সময় আমরা বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী ভবনের টেলিফোন পেলাম । আমাদেরকে জানানো হলো , এখনই প্রধানমন্ত্রী ভবনে গিয়ে খালেদা জিয়ার সাক্ষাত্কার নিতে হবে । আমরা সংগে সংগে গাড়িতে করে প্রধানমন্ত্রী ভবনের দিকে রওয়ানা হলাম । যখন আমাদের গাড়ি প্রধানমন্ত্রী ভবনের প্রধান গেটে পৌঁছলো , তখন আমরা দেখতে পেলাম , প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিলার লম্বা গাড়িবহর সবেমাত্র প্রধানমন্ত্রী ভবনের ভেতরে প্রবেশ করছে । আমাদের গাড়িও সংগে সংগে তাদের গাড়িবহরের পিছু নিল । প্রধানমন্ত্রী ভবনের একটি বৈঠকখানায় বেগম খালেদা জিয়া প্রথমে আমার সংগে কুশল বিনিময় করেন । তিনি বলেন , "আপনার সংগে আমার হয়তো কোথাও দেখা হয়েছে ?" উত্তরে আমি বললাম , গত বছর আপনার চীন সফরের সময় আমি তিয়ান ইয়ু থাই রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবনে আপনার সাক্ষাত্কার নিয়েছি ।" বেগম জিয়া বলেন , : " ওহহো, আমার মনে পড়েছে । এর পর আন্তরিক ও বন্ধুত্বপূর্ণ পরিবেশে আমি প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়াকে কয়েকটি প্রশ্ন করলাম । উত্তরে তিনি চীন ও বাংলাদেশের সুপ্রতিবেশীসূলভ সম্পর্কের উচ্চ মূল্যায়ণ করেন এবং দু দেশের সুসম্পর্কের সুন্দর ভবিষ্যত সম্পর্কে আশাবাদ ব্যক্ত করেন । সাক্ষাত্কারশেষে বেগম জিয়া আমাদের প্রতিনিধিদলকে কিছু নাস্তা খাওয়ার জন্যে আমন্ত্রণ করেন । সাক্ষাত্কার শেষ করে যখন আমরা প্রধানমন্ত্রী ভবন থেকে বেরিয়ে আসলাম , তখন ঢাকা থেকে স্বদেশে যাওয়ার ফ্ল্যাইট ছাড়তে আর মাত্র তিন ঘন্টা সময় ছিল । আমরা তড়িঘড়ি করে হোটেলে গিয়ে আমাদের মালপাত্র নিয়ে বিমানবন্দরের উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিলাম ।সেই সাক্ষাত্কারটি আজও আমার মনে সুন্দর ছাপ হয়ে জড়িয়ে রয়েছে ।
চীন আন্তর্জাতিক বেতারের বাংলা অনুষ্ঠান চালু হওয়ার ৪০তম বার্ষিকী উপলক্ষে আমি এ অনুষ্ঠানের আরো বিরাট সাফল্য কামনা করি । |