আমি শুনেছি কোনো দম্পতির বিয়ের বয়স চার বছর হয়ে গেলে তাকে সিল্ক ওয়েডিং বা রেশম বিয়ে বলে, কারণ ততোদিনে দুজনের বন্ধন যেন রেশম দিয়ে বাঁধা হয়ে যায়। আর চল্লিশ বছর হয়ে গেলে সেই বিয়েকে বলে রুবি ওয়েডিং বা চুনি বিয়ে। দীর্ঘ ৪০ বছরের দাম্পত্য সম্পর্কেএতোই মূল্যবান বলে মনে করা হয় যে তাকে চুনি বা পদ্মরাগমনির সঙ্গে তুলনা করা হয়। আমার এখনো কোনো ব্যক্তির সাথে বিয়ে হয়নি, তবে একটি প্রতিষ্ঠানের সাথে বিয়ে হয়েছে। তার নাম বাংলা বিভাগ,চীন আন্তর্জাতিক বেতার। বাংলা বিভাগের সঙ্গে আমার সম্পর্কটা এরই মধ্যে রেশম দিয়ে বাঁধা হয়ে গেছে। এখন চার বছর আগের সেই দিনের কথা ভাবলে অবাক হয়ে যায়. যেদিন সিআরআইয়ের সঙ্গে চাকরির ৬ বছর মেয়াদি চুক্তিপত্র সই করেছিলাম। সে সময় মনে মনে ভেবেছিলাম, ছয় বছর! কতো লম্বা সময়! যেন সারা জীবনের জন্য বাঁধা পড়া। কিন্তু চোখের পলকে যেন চারটি বছর পার হয়ে গেল। এখন আমি সাহস করে বলতে পারি সিআরআই বাংলা বিভাগের সঙ্গে আমার রেশমে বাঁধা সম্পর্ক একদিন ৪০ বছর পেরিয়ে পদ্মরাগমণির মতোই অমূল্য হয়ে উঠবে।
২০০২ সালে আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আধুনিক ভাষা ইনস্টিটিউটে ১০ মাস বাংলা ভাষা শিখেছি। সেখানে আমার অনেক বাংলাদেশী বন্ধু আমাকে জিজ্ঞাস করতো , আমি কিভাবে চীনে বাংলা ভাষা শিখেছি। তাদেরকে আমি যে জবাবটা দিতাম সেটাই আবার বলছি।
**আমার শিক্ষকেরা**
মাদাম লিউ আই হাও আমার প্রথম বাংলা শিক্ষক। তার কাছ থেকেই আমার বাংলা ভাষা শেখার আগ্রহ গড়ে উঠে।
মাদাম লিউ আই হাও ভারতের পশ্চিম বাংলায় বড় হয়েছেন। ক্লাসে তিনি সব সময় ভারতে তার শৈশব অভিজ্ঞতার কথা বলতেন । কিভাবে তিনি হিন্দি ভাষার পরিবর্তে বাংলা ভাষা শিখেছেন, কিভাবে বাঘের মুখ থেকে বেঁচে এসেছেন , কীভাবে ভারত থেকে চীনে ফিরে এসেছেন- এসব তিনি গল্পের চেয়েও আকর্ষনীয় ঢঙে আমাদেরকে শোনাতেন। তার কাছে আমি বাংলা সংস্কৃতি সম্পর্কে একটু একটু করে জানতে শুরু করি।
আমাদের হোমওয়ার্ক খাতাগুলো মাদাম লিউ এখনো আগলে রেখেছেন। সিআরআইতে যোগ দেয়ার পর একবার তাকে দেখতে গেলে তিনি আমাকে তাক লাগিয়ে দিয়েছিলেন। আমাকে সেই পুরনো হোমওয়ার্ক খাতা বের করে দেখিয়ে বললেন, দেখ,তখনকার লেখা দেখে তুমিও নিজেও হয়তো এই ভেবে হেসে ফেলবে যে, কেমন হাস্যকর ভুল করতাম! তবে আমি এও জানি ,তোমাদের মধ্যে নিশ্চয় এমন কেউ কেউ আছে , যারা আমি আর তোমার শিক্ষক লি'র মতো সারা জীবন বাংলা ভাষার সেবা করবে।
আমার অন্য একজন শ্রদ্ধেয় শিক্ষক লি ইউয়ান শান। তিনি মাদাম লিউ আই হাওয়ের স্বামী। তিনি অনেক আগে সিআরআইতে কাজ শুরু করেন। তিনি আমার বাংলা লেখা দেখে মজা করে বলেছিলেন, আমি যে শব্দ শিখিয়েছি তুমি হবহু সেটাই ব্যবহার করনি। তার বদলে তুমি একই অর্থের অন্য শব্দ ব্যবহার করছো। এটা উদ্ভাবনের অনুপ্রেরণা। শিক্ষক লি ইউয়ান শান সব সময় নিজস্ব পদ্ধতিতে আমাদের সবাইকে উত্সাহ দিতেন। খুবই দুঃখের ব্যাপারে যে, তিনি এক গাড়ি দুর্ঘটনায় আমাদেরকে ছেড়ে চলে গেছেন। সবাই তার মৃত্যতে শোকে স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিল। আমি নিজেকে স্মরণ করিয়ে দেই, শিক্ষক লির কথা মনে পড়লে তার নীতিজ্ঞান ও বিদ্যার কথা মনে রাখতে হবে এবং তার সব দৃষ্টান্তমূলক গুণগুলো নিজে অর্জন করতে হবে।
মাদাম লিউ আর শিক্ষক লি আমাকে বাংলা ভাষা শিখতে অবিরাম উত্সাহ দিয়ে গেছেন। সি.আর.আই'তে কাজ করার জন্য ভাষা ছাড়াও আরো অনেক নতুন বিষয় শিখতে হয়। এ ক্ষেত্রে বিভাগের প্রবীণরা আমাকে অনেক সাহায্য করেছেন। ২০০৪ সালে আমি সিআরআই'তে যোগ দেয়ার পর অনুষ্ঠানের সময় আধা ঘন্টা থেকে বাড়িয়ে এক ঘন্টা করা হয়েছে। তখন আমরা নতুন কর্মীরা সবেমাত্র প্রতিবেদন তৈরি করতে শুরু করেছি। আমি প্রথমে শ্রদ্ধেয় চৌ চিন ছাওয়ের সঙ্গে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি অনুষ্ঠানটি করতাম। এই অনুষ্ঠানে অনেক নতুন শব্দ ব্যবহার করতে হতো। তখন আমার বাংলা ভাষার শব্দভান্ডার খুব সীমিত, তা দিয়ে অনুবাদ করা খুব কঠিন কাজ ছিল। তার চেয়েও বেশি কঠিন ঐ অনুবাদটা পড়ে বোঝা। কিন্তু শ্রদ্ধেয় চৌ সব সময় আমার লেখা জমা দেয়ার পরদিনই সেটা প্রায় পুনর্লিখন করে আমাকে ফেরত দিতেন, কখনোই দেরি করতেন না। তার সমৃদ্ধ শব্দভান্ডার দেখে আমি আশ্চর্য হয়ে যেতাম। পরে মাদাম ইয়ু কুয়াং ইয়ে'র কাছ থেকে শুনেছি যে, চৌ সাহেব এক'শরও বেশি বাংলা উপন্যাস পড়েছেন।বিশাল শব্দভান্ডার তারই ফসল।
পরে আমি মাদাম ফেং সিউ ছিয়েনের সঙ্গে সংস্কৃতি সম্ভার অনুষ্ঠানটা করতে শুরু করি। ২০০২ সালে বাংলাদেশে মাদাম ফেং সিউ ছিয়েনের সঙ্গে আমার প্রথম দেখা । তখন মাদাম ফেং তার স্বামী'র সঙ্গে বাংলাদেশে চীনা দূতাবাসে কাজ করছিলেন। তার সদা উষ্ণ হাশিমুখ দেখলেই আমার মন ভালো হয়ে যায়। তিনি এখন অবসর নিয়েছেন, তবে এখনো বাংলা বিভাগ ছাড়েননি, কাজ করে যাচ্ছেন। এখনো তিনি আমাদের বাংলা বিভাগের সবচেয়ে ভাল উপস্থাপকদের একজন। এখনো নতুন শব্দ শিখলে তিনি নোটবুকে টুকে রাখেন। তার কাছ থেকে আমি অনেক শিখেছি।
আমি সাক্ষাত্কার নিতে শিখেছি মাদাম ইয়ু কুং ইয়ে'র কাছ থেকে । বিভাগের পরিচালক হিসেবে তার ওপর অনেক দায়িত্ব আর চাপ । তারপরও নতুনদের কাজ শেখানোর ব্যাপারে তার সীমাহীন উৎসাহ। তিনি সব সময় আমাদের নিজেদের সম্ভাব্না ও সামর্থ্যের বিকাশ ঘটানোর জন্য অনুপ্রেরণা দেন। বাংলা বিভাগের অনুষ্ঠান আরো উন্নতি এবং এই বিভাগের উন্নয়নের নতুন দিক উন্মোচনের জন্য তিনি অবিরাম চেষ্টা করে যাচ্ছেন।
বিভাগে আরো রয়েছেন বিভিন্ন বিষয়ে মন খুলে আমাদের সঙ্গে কথা বলার জন্য শ্রদ্ধেয় চিয়াং চিন ছেং , হাশি মুখের মাদাম জুং শাও লি, প্রাজ্ঞ ও মনোযোগী শি চিং উ স, উচ্চ স্বরে তামাশাপ্রিয় থান ইয়াও খাং এবং বিদ্বান গবেষক বাই খাই ইউয়ান। এছাড়াও ছিলেন আরো অনেক শিক্ষক ও প্রবীণ সহকর্মী, যাদের অনেকের সঙ্গে আমাদের দেখাও হয়নি। তাদের সবার চেষ্টা ও পরিশ্রমে বাংলা বিভাগ প্রতিষ্ঠার পর আজ ৪০ বছর ছুঁয়েছে। তাদের অবদানেই শ্রোতাদের মনে গভীর ছাপ ফেলে "রেডিও পিকিং-এর নাম। আশা করি আমাদের চেষ্টায় আরো বেশি মানুষের হৃদয়ে জায়গা করে নেবে "চীন আন্তর্জাতিক বেতার।
**স্বপ্ন থেকে বাস্তব**
বেতারের উপস্থাপক হওয়া আমার ছোটবেলার স্বপ্ন। একটি মাইক্রোফোনের মাধ্যমে নিজের আওয়াজ অনেক দূর দুরান্তের মানুষের কানে ঢুকছে –এ কথা ভাবলে এখনো আমার বিস্ময় জাগে।
তরে বাংলা ভাষার উপস্থাপক বা সংবাদকর্মী হিসেবে কাজ করবো সেটা আগে কখনো আমার কল্পনায় আসে নি।
চাকরি নেয়ার পর আমি বাংলা সংস্কৃতি আরো ভালভাবে জেনেছি। অন্তত আমার ক্ষেত্রে ভাষা সত্যিই যোগাযোগের সেতু হিসেবে ভূমিকা পালন করছে।
আমার মনে আছে, বাংলাদেশের বন্ধুরা আমার মুখ থেকে তাদের মাতৃ ভাষা শোনার পর কেমন আনন্দ অভিভূত হয়ে পড়তো। আমার মনে হয় ভাষা শেখার এটাই সবচেয়ে বড় প্রতিদান।
২০০৭ সালের অক্টোবর মাসে আমি এবং আমার সহকর্মী মুক্তা শাংহাইয়ে অনুষ্ঠিত ১২তম বিশেষ (বুদ্ধি প্রতিবন্ধী) অলিম্পিক গেমসে গিয়েছিলাম। বাংলাদেশ ৪০ জনেরও বেশি সদস্যের একটি প্রতিনিধি দল পাঠিয়েছিল। বড় একটি দল , অপরিচিত পরিবেশ আর ভিন্ন ভাষার কারণে দলের খেলোয়াড়দের অনেক সাহায্য দরকার হয়েছিল। আমি আর মুক্তা দু'জনেই তাদের অবস্থা দেখে নিজেদের কাজের পাশাপাশি তাদের সাহায্য করার চেষ্টা করেছিলাম। শিশু'র সমান বুদ্ধির এসব খেলোয়াড়রা যেভাবে উপভোগ করছিল দেখে আমার সত্যি ঈর্ষা হয়েছিল। আমার মনে আছে, আমরা একসাথে জাহাজ যোগে শাংহাইয়ের হুয়াং পু নদীতে বেড়ানোর সময় রেডিওতে গান বাজছিল, তারা সেই গানের সঙ্গে কি আনন্দেই নাচছিল!।আমাদেরকেও তাদের সঙ্গে যোগ দেয়ার জন্য তারা আমন্ত্রণ করেছিল। আমার মনে নেই আমি জীবনে আর কোন দিন এতো উপভোগ করেছি কিনা। তারা দেশের জন্য ১৫টি স্বর্ণপদক জিতেছিল। আমরাও তাদের সাফল্যের খবর বাংলাদেশের শ্রোতাদের জানানোর প্রতিদিন বাংলা বিভাগে পাঠিয়ে দিতাম।
২০০৮ সালের অলিম্পিক গেমসে আমি অলিম্পিক সংবাদদাতা হিসেবে কাজ করেছি। তখন সাংবাদিক অমিত হাবিবের সঙ্গে বাংলাদেশের বিভিন্ন পত্রিকার সংবাদদাতাদের নিয়ে অলিম্পিকের ওপর বিশেষ অনুষ্ঠান করেছিলাম। অমিত হাবিব আমাদের বিভাগের বিশেষজ্ঞ ছিলেন। কিভাবে পেশাদার সংবাদ তৈরী করতে হয় সে সম্পর্কে তিনি আমাদের অনেক শিখিয়েছেন। অলিম্পিকের সময় বাংলাদেশের কয়েকজন অভিজ্ঞ ক্রীড়া সাংবাদিকের সঙ্গেও পরিচয় হয়েছে। যেমন প্রথম আলোর খ্যাতিমান ক্রীড়া সাংবাদিক উত্পল শুভ্র। তাদের মাধ্যমে আমি জেনেছি একজন ভাল সংবাদিক হতে হলে কিভাবে কাজটা করতে হয়।
কাজ করার পাশাপাশি আমি চীনের রেনমিন বিশ্ববিদ্যালয়ে সংবাদিকতা বিষয়ে মাস্টারস ডিগ্রীতে পড়ছি। রেন মিন ইউনিভার্সিটির সাংবাদিকতা ও গণযোগাযোগ বিভাগ চীনের সবচেয়ে ভাল বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মধ্যে একটি।স্বাভাবিকভাবেই প্রত্যাশা করছি মাস্টার ডিগ্রি শেষ করা পা আমার কাজটা আরো ভালভাবে করতে পারবো।
সময় স্রোতের মতো সামনে এগিয়ে যাচ্ছে। চার বছরের মধ্যে আমি বেতারের সব কাজ একটু একটু করে শিখেছি। এর পাশাপাশি আমরা বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যম ও বর্তমান বিশ্বের উন্নয়ন ধারার সঙ্গে তাল মিলিয়ে নিজেদের কাজের উন্নতি করছি।আশা করি আপনারা অচিরেই সেটা উপলব্ধি করতে পারবেন। কালের গহ্বরে চল্লিশ বছর একটি সংখ্যামাত্র। কিন্তু এর ভেতরে যে কতো মানুষের শ্রম আর ঘাম যুক্ত তার হিসেব মেলানো ভার। আজ থেকে দশ বছর পর আমাদের সিআরআইয়ের বাংলা বিভাগ কেমন হবে সেটাই বা কে জানে? চলুন আমরা চোখ খোলা রেখে একসাথে শুনতে থাকি। |