মোঃ লুৎফর রহমান
যোগাযোগের সূচনাঃ গুপ্তযুগে বাংলার সুলতান গিয়াস উদ্দিন আযম শাহ্ এর শাসনামলে চীনা পরিব্রাজক ফা-হিয়েন এর উপমহাদেশ ভ্রমণের ইতিহাস প্রমান করে সুদূর অতীতে বাংলাদেশ ভূখন্ডের সাথে চীনাদের পরিচয় ঘটেছিল। এছাড়া বাংলা ভাষায় কয়েকটি চীনা শব্দের প্রবেশ বাংলাদেশ-চীনের সৌহার্দ্যপূর্ণ লেনদেনের সুপ্রাচীন ইতিহাস বহন করে। বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের পূর্বে ১৯৬৯ সালে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্থানের মানুষের জন্য চীন আন্তর্জাতিক বেতারে বাংলা বিভাগ চালু করার ঘটনা দুই ভূ খন্ডের যোগাযোগের আরো স্পষ্ট ইতিহাস।
রাষ্ট্রীয় যোগাযোগের সূচনাঃ ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ স্বাধীন হবার পরপরই বিভিন্ন দেশ বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয় এবং কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন করে। তৎকালীন রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান চীনের সঙ্গে সম্পর্ক প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ গ্রহণ করেছিলেন। কিন্তু তার জীবদ্দশায় এ উদ্যোগ বাস্তবায়িত হয় নি। অবশেষে ১৯৭৫ সালের ৪ অক্টোবর চীন-বাংলাদেশ কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপিত হয়। ১৯৭৭ সালের জানুয়ারি মাসে তৎকালীন রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের চীন সফরের মাধ্যমে রাষ্ট্রীয় যোগাযোগে গতিশীলতা অর্জিত হয়। বাংলাদেশের শীর্ষ নেতৃবৃন্দের প্রত্যেকেই চীন সফর করেছেন। এঁদের মধ্যে রয়েছেন- হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, মেজর জিয়াউর রহমান, হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদ, বেগম খালেদা জিয়া, শেখ হাসিনা, ড. ফখরুদ্দীন আহমদ প্রমূখ। অপরদিকে চীনেরও বেশ কয়েকজন শীর্ষ নেতা বাংলাদেশ (বা তৎকালীন পূর্ব পাকিস্থান) সফর করেছেন। এঁদের মধ্যে রয়েছেন- লিউ শাও চি, চৌ এন লাই, মার্শাল চেন ঈ, লি সিয়ান নিয়েন, চু রোং চি, ওয়েন চিয়া পাও প্রমূখ।
সম্পর্কের ক্রমবিকাশঃ স্বাধীন বাংলাদেশের প্রাথমিক প্রতিকূল অবস্থায় সবচেয়ে প্রয়োজন হয়ে দাঁড়ায় একটি সহমর্মী দেশের বন্ধুত্ব। বিধ্বস্ত অর্থনীতির পুনর্গঠন, সামাজিক-রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা অর্জন, সাংস্কৃতিক বিকাশ, আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নয়ন ইত্যাদি ক্ষেত্রে সাহায্য-সহযোগিতার জন্য বাংলাদেশ চীনের দিকে বন্ধুত্বের হাত বাড়ায়। চীনা কর্তৃপক্ষ সহাস্যবদনে সেই বন্ধুতা গ্রহণ করে। বিভিন্ন সমস্যা নিরসন এবং সহযোগিতার ক্ষেত্রে দুই দেশের উচ্চ পর্যায়ের নেতৃবৃন্দ ঘন ঘন সফর বিনিময় করেছেন এবং বিভিন্ন ক্ষেত্রে সহযোগিতামূলক আদান-প্রদানের ক্ষেত্র সম্প্রসারিত করেছেন।
১৯৭৫ সালে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপনের পর ১৯৭৬ সাল থেকে দু'দেশ শিক্ষা বিনিময়ের জন্য ছাত্র পাঠানো শুরু করে। এরই ধারাবাহিকতায়, শিক্ষামৈত্রীর নিদর্শনস্বরূপ বাংলাদেশ সরকার ১৯৮৬ সালে পেইচিংয়ে একটি প্রাথমিক স্কুল নির্মানে চাঁদা প্রদান করে। স্কুলটির নাম দেয়া হয়েছে বাংলাদেশ-চীন মৈত্রী প্রাথমিক স্কুল। ১৯৭৯ সালে দু'দেশের মধ্যে সাংস্কৃতিক সহযোগিতা চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। এরপর ত্রি বার্ষিক চীন সফর ও বিনিময় পরিকল্পনা স্বাক্ষরিত হয়। ১৯৮৩ সালের নভেম্বর মাসে চীন ও বাংলাদেশের অর্থনীতি, বাণিজ্য এবং বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি সংক্রান্ত যৌথ কমিটি গঠিত হয়েছে। ২০০৪ সালের নভেম্বরে পেইচিংয়ে প্রথম বাংলাদেশ খাদ্য উৎসব অনুষ্ঠিত হয়েছে। এছাড়া দু'দেশের শীর্ষ নেতৃবৃন্দের নিয়মিত সফর বিনিময় অব্যাহত রয়েছে। এসব ধারাবাহিক তৎপরতা অব্যাহতভাবে দু'দেশের জনগনের সমঝোতা বাড়ানোর ক্ষেত্রে বিশেষ ভূমিকা রাখছে। চীন ও বাংলাদেশের জনগন দু'দেশের মৈত্রী সম্পর্ক উন্নয়নের জন্য প্রয়াস চালাচ্ছেন। দু'দেশের মধ্যে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপনের ৩০ বছর পূর্তি উপলক্ষ্যে ২০০৫ সালকে দু'দেশের জনগন বাংলাদেশ ও চীনের মৈত্রী বর্ষ হিসেবে পালন করেছে।
দুই দেশের দৃষ্টিভঙ্গিঃ আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক ইস্যুতে অভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি এবং দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের ক্ষেত্রে পারস্পরিক সহমর্মিতা রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে সুসংহত নৈকট্যের জন্ম দিয়েছে। উভয় দেশই প্রতিবেশী দেশগুলোর সঙ্গে আঞ্চলিক উন্নয়ন, সমৃদ্ধি এবং শান্তির লক্ষ্যে একসঙ্গে কাজ করে যাচ্ছে। বাংলাদেশ এবং চীন একসঙ্গে অভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি ও সহযোগিতায় যথাক্রমে অস্থায়ী এবং স্থায়ী সদস্য হিসেবে জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদে কাজ করেছে। উভয় দেশ বিশ্ব পরিস্থিতির এই দ্রুত পরিবর্তনশীল প্রেক্ষাপটে ভারসাম্য রক্ষা করে সবার সঙ্গে সৌহার্দ্য ও সহযোগিতার রাষ্ট্রীয় নীতি অনুসরণ করে চলে। দুই দেশের জনগনের সর্বোচ্চ কল্যাণ নিশ্চিত করার লক্ষ্যে দ্বিপাক্ষিক সহযোগিতার বিন্যাসে দু'দেশের নেতৃবৃন্দের পারস্পরিক মতামতের গভীর নৈকট্য রয়েছে। বাংলাদেশের জনগনের উজ্জ্বল ভবিষ্যত বিনির্মানের লক্ষ্যে দারিদ্র বিমোচন, জীবনমান উন্নয়ন এবং আধুনিকায়নে চীনের সহায়তার নিদর্শন সারাদেশেই দৃশ্যমান। ছয়টি বাংলাদেশ-চীন মৈত্রী সেতু, সার কারখানা, বস্ত্র কারখানা, বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র এবং ঢাকায় বাংলাদেশ চীন মৈত্রী সম্মেলন কেন্দ্র তার কয়েকটি উদাহরণ।
আদান প্রদানগত সম্পর্কঃ ৪ অক্টোবর ১৯৭৫ সালে দু'দেশের মধ্যে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপনের পর উভয় দেশের মধ্যে যোগাযোগের ক্ষেত্র অনেকদূর বিস্তৃত হয়েছে। ৩৩ বছর আগে যে বন্ধুত্বের বীজ বপন করা হয়েছিল তা দু'দেশের জনগণের ভালবাসায় পারস্পরিক বিশ্বাস ও শ্রদ্ধাবোধের এক শক্তিশালী মহীরুহে পরিণত হয়েছে। প্রথম থেকেই বাংলাদেশ-চীন সম্পর্ক এক কথায় চমৎকার, বন্ধুসুলভ ও সহযোগিতামূলক। বাংলাদেশের উন্নয়ন ও অগ্রগতিতে চীন বরাবরই গুরুত্বপূর্ণ অংশীদারের ভূমিকা পালন করে আসছে। ব্যবসা ও বিনিয়োগ জোরদারসহ বিভিন্ন খাতে সহযোগিতা বৃদ্ধি পাচ্ছে উত্তরোত্তর। চীনের প্রত্যক্ষ সহযোগিতায় বাংলাদেশ সাফল্যের সঙ্গে গণতন্ত্রের পথে এগিয়ে চলেছে এবং আন্তর্জাতিক অঙ্গনে নিজের আর্থ সামাজিক দক্ষতা ও মর্যাদাকে শক্তিশালী করেছে।
আমরা প্রতিদিন যে সব বিদেশি পণ্য ব্যবহার করি তার সিংহভাগই চীনে বা চীনা প্রযুক্তিতে তৈরী। কলম থেকে শুরু করে কম্পিউটার পর্যন্ত অসংখ্য নিত্য প্রয়োজনীয় চীনা পণ্য আমরা ব্যবহার করছি। বর্তমানে (২০০৭-০৮ অর্থবছর) চীন ৩১০ কোটি ডলারের বেশি মূল্যের পণ্য বাংলাদেশে রপ্তানি করেছে। বাংলাদেশ থেকে সীমিত পরিমাণ পণ্য আমদানি করায় দু'দেশের বাণিজ্য ঘাটতি সম্পূর্ণ বাংলাদেশি বাণিজ্যের প্রতিকূলে। এক্ষেত্রে চীন বাংলাদেশে শিল্প কারখানা স্থাপন করে উৎপাদিত পণ্য সামগ্রী চীনে আমদানি করে এই বাণিজ্য ঘাটতি দূর করতে পারে। সম্প্রতি বাংলাদেশের প্রধান উপদেষ্টা ড. ফখরুদ্দীন আহমদ এর চীন সফরকালে চীনা বিনিয়োগকারীদের সুবিধার্তে একটি স্বতন্ত্র ইইজেড (এক্সক্লুসিভ ইকনোমিক জোন) স্থাপনের সিদ্ধান্ত হয়েছে। বাংলাদেশের পক্ষ থেকে আরো বেশি পণ্যের শুল্কমুক্ত প্রবেশাধিকার দিতে পেইচিংয়ের প্রতি আহ্বান জানানো হয়েছে।
বাংলাদেশের রয়েল বেঙ্গল টাইগার ও হাতি সম্পর্কে চীন বরাবরই আগ্রহী। সুন্দরবন ও পার্বত্য অঞ্চলে পর্যটন শিল্পের বিকাশে চীন সহযোগিতা করতে আগ্রহী। ইতিমধ্যে চীন বাংলাদেশকে চীনা নাগরিকের জনপ্রিয় পর্যটন গন্তব্য হিসেবে তালিকাভূক্ত করেছে। এছাড়াও গ্যাস সম্পদের ব্যবহার, রাসায়নিক, খনিজ ও ওষুধ শিল্প, কৃষিজাত পণ্য প্রক্রিয়াকরণ, টেলিযোগাযোগ, বিদ্যুৎ উৎপাদনে পারমাণবিক শক্তির শান্তিপূর্ণ ব্যবহার ইত্যাদি ক্ষেত্রে চীন অনুদান ও সহায়তা দিতে সম্মত হয়েছে। বাংলাদেশের পক্ষ থেকে তৈরী পোষাক, হস্তজাত সূতা, চামড়াজাত পণ্য, সিরামিকস ও অবকাঠামো খাতে আরো বিনিয়োগের আহ্বান জানানো হয়েছে। ১৮ মে ২০০৫ তারিখে ঢাকা-কুনমিং-পেইচিং সরাসরি বিমান যোগাযোগ প্রতিষ্ঠা দু'দেশের বিনিয়োগ পরিবেশকে আরো সুবিধাজনক অবস্থানে পৌঁছে দিয়েছে। প্রস্তাবিত চট্টগ্রাম-বার্মা-কুনমিং সড়ক যোগাযোগ স্থাপিত হলে এই পরিবেশ আরো উন্নত হবে।
সাম্প্রতিক তৎপরতাঃ ১৯৭৭ সালের জানুয়ারি মাসে তৎকালীন প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান প্রথম রাষ্ট্রীয় নেতা হিসেবে চীনে সরকারি সফর করেন। অপরদিকে ১৯৭৮ সালের মার্চ মাসে উপ-প্রধানমন্ত্রী লি সিয়েন নিয়েন প্রথম রাষ্ট্রীয় নেতা হিসেবে বাংলাদেশ সফর করেন। এরপর অব্যাহতভাবে বিভিন্ন সময়ে উচ্চ পর্যায়ের প্রতিনিধিদের সফর বিনিময় হয়েছে। ২০০৫ এর এপ্রিলে ওয়েন চিয়া পাও বাংলাদেশ সফর করার পর আগষ্টে বেগম খালেদা জিয়া ফিরতি সফর করেন।
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. ফখরুদ্দীন আহমদ ১৫-১৮ সেপ্টেম্বর চীন সফর করেছেন। সফরকালে প্রধান উপদেষ্টা চীনের প্রধানমন্ত্রী ওয়েন চিয়া পাও, প্রেসিডেন্ট হু চিন থাও, ভাইস প্রেসিডেন্ট জি জিনপিং সহ চীনের বড় বড় কোম্পানীর কর্ণধারদের সাথে বৈঠক করেন। এসব বৈঠকে বেশ কয়েকটি চুক্তি ও সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হয়। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল- ১) অর্থনৈতিক ও কারিগরি সহযোগিতা বৃদ্ধি সম্পর্কিত, ২) নদ-নদীর পানি প্রবাহ সম্পর্কিত তথ্য বিনিময় সম্পর্কিত, ৩) কৃষি গবেষণা ও সহযোগিতা সম্প্রসারণ সম্পর্কিত। এছাড়াও চীনা নেতৃবৃন্দ রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র উন্নয়ন, বাংলাদেশি শিক্ষার্থীদের জন্য বৃত্তির সংখ্যা বাড়ানো এবং বাংলাদেশে একটি নতুন সার কারখানা প্রতিষ্ঠায় সহায়তার আশ্বাস দিয়েছে। প্রধান উপদেষ্টা ড. ফখরুদ্দীন আহমদ অর্থনীতি, অবকাঠামো, কৃষি, বিদ্যুৎ, বস্ত্রশিল্প, পেট্রো-কেমিক্যাল, ঔষধশিল্প, চামড়াজাত পণ্য, তথ্যপ্রযুক্তি, সিরামিক, কুটির শিল্প প্রভৃতি খাতে চীনাদেরকে বিনিয়োগ করতে আহ্বান জানিয়েছেন। এসব চুক্তি আর তৎপরতা দু'দেশের ঘনিষ্ঠ সম্পর্কোন্নয়নে ক্রমবর্ধমান কল্যাণ বয়ে আনবে।
বাংলাদেশ চীন সম্পর্ক প্রতিষ্ঠার ৩৩ বছর পর আজ দৃঢ়ভাবে বলা যায়- দু'দেশের বন্ধুত্ব স্বকীয় অনন্যতায় ভাস্বর। এই বন্ধুত্বে রয়েছে প্রচন্ড শক্তি, বিশ্বাস, শ্রদ্ধাবোধ, নিজস্ব গর্বিত ঐতিহ্যের মুক্তবাতাবরণ আর প্রাণবন্ততার প্রকাশ; রয়েছে গতিময়তা ও পার্থিব তেজস্বিতা। এই বন্ধুত্ব আর আন্তরিকতাপূর্ণ সম্প্রীতি সহজ-সারল্য মন্ডিত, প্রসন্ন প্রণোদিত এবং আদর্শবাদিতায় অম্লান।
আমি আর চীন আন্তর্জাতিক বেতার
বাংলাদেশ একটি মুসলিম দেশ। জ্ঞান অর্জনের জন্য সুদূর চীনদেশে যাও- ইসলাম ধর্মের সর্বশেষ রাসুল হযরত মোহাম্মদ (সাঃ) এর এই নির্দেশটির সাথে কম বেশি সব মুসলমানই পরিচিত। শাস্ত্রীয় এই নির্দেশেই প্রাচীনতম সভ্য দেশ, জ্ঞান-বিজ্ঞানের সূতিকাগার হিসেবে মহাচীনের মাহাত্ম্যের স্বীকৃতি সুস্পষ্ট। ছাত্র জীবনে প্রাচীনতম চীন সভ্যতার বিষয়ে কমবেশি সবারই পড়তে হয়েছে। আর তাই চীন এবং চীনাদের প্রতি আমাদের দুর্নিবার আকর্ষণ সহজাত।
অনেক বছর আগে কোন এক রাতে অন্য অনেক বেতার শ্রোতার মতোই ফ্রিকোয়েন্সী আপ-ডাউন করতে গিয়ে হঠাৎ ব্যতিক্রমধর্মী শ্রুতিমধুর বাংলা কন্ঠস্বর শুনতে পাই। রাত ৯টার পর মাদাম ফোং সিউ ছিয়েন এর কন্ঠ আমাকে বিশ্বজয়ের মতো আনন্দ এনে দেয়। আবিষ্কার করি চীন আন্তর্জাতিক বেতারকে। অবাক বিস্ময়ের সাথে মনোযোগ দিই এই বাংলা অনুষ্ঠানের প্রতি। ধীরে ধীরে প্রচারতরঙ্গ, অনুষ্ঠানসূচী মুখস্ত হয়ে যায়।
সে তো অনেক আগের কথা। এরপর শত ব্যস্ততার মাঝেও বাধ্যতামূলকভাবে সিআরআই অনুষ্ঠান শোনা অব্যাহত রয়েছে। চিঠি লেখার মাধ্যমে যোগাযোগের সূচনা হলেও আজ তা সম্প্রসারিত হয়েছে টেলিফোন, ই-মেইল এবং মোবাইল এসএমএস এ। সিআরআইয়ের সাথে নিয়মিত যোগাযোগ শুরু হবার পর চীনদেশ এবং চীনাদের দৃষ্টিভঙ্গি সম্পর্কে অনেক জানতে পেরেছি। আমি যেমন সিআরআইকে ভালবেসেছি, তেমনি সিআরআই ও আমাকে ভালবেসেছে, আপন করে নিয়েছে।
সিআরআই থেকে প্রথমবার মি. শি চিং উ'র কন্ঠে যখন আমার নিজের নামটি শুনেছিলাম তখন কি যে খুশি হয়েছিলাম- তা ভাষায় প্রকাশ করা সম্ভব নয়। যখনই নিজের নাম বা নিজের লেখা কোন চিঠি সিআরআইতে প্রচার হয় বা ওয়েবসাইটে প্রকাশিত হয় তখনই নতুন করে আনন্দিত হই বারবার। আর পুরষ্কার বিজয়ী ঘোষণা বা পুরষ্কার পাওয়া সে তো বি-শা-ল আনন্দের ব্যাপার। সিআরআই থেকে আমি বেশ কিছু পুরষ্কার পেয়েছি। সর্বশেষ দ্বিতীয় চীনা ভাষা পরীক্ষায় প্রথম স্থান অর্জন করেছি, যা আমার কাছে ছিল অকল্পনীয়। আমাদের নেপচুন রেডিও ফ্রেন্ডস্ ক্লাবকে সিআরআই শ্রেষ্ঠ শ্রোতাসংঘের মর্যাদা দেয়ায় আমাদের ক্লাবের সদস্যরাও অত্যন্ত আনন্দিত, সিআরআইয়ের ভালবাসায় সিক্ত। নেপচুন রেডিও ফ্রেন্ডস্ ক্লাবের পক্ষ থেকে সিআরআই, চীন বাংলাদেশ মৈত্রী এবং ডি-এক্সিং এর উপর অনলাইন নেপচুন নিউজ' নামে একটি ম্যাগাজিন নিয়মিত প্রকাশিত হচ্ছে। আরো বেশি সংখ্যক শ্রোতাকে আমরা ম্যাগাজিনটি পাঠাতে চাই এবং এতে শ্রোতাদের লেখা প্রত্যাশা করি। এক্ষেত্রে শ্রোতাদেরকে +৮৮ ০১৯১৩ ৪৬৮৩০১ মোবাইল নাম্বারে এবং crib_102_04@yahoo.com ই-মেইলে যোগাযোগের অনুরোধ করছি।
সিআরআইয়ের মাধ্যমে আমি এক অপার্থিব প্রাপ্তি উপলব্ধি করেছি। আমি বিশ্বাস করি, আমার অনেক চীনা বন্ধু রয়েছে। সিআরআই বাংলা বিভাগের কর্মীরা সবাই আমার বন্ধু, আমার আপনজন, আত্মার আত্মীয়। ওয়াং তান হোং এর কথা তো কখনোই ভুলবার নয়। ও আমার হৃদয়ের অনেক কাছের একজন, যাকে ভালবাসা যায় পরম নিশ্চয়তায়। ওয়াং পেইচিংয়ে ফিরে গেলেও রয়েছে আমার অনেক কাছাকাছি, অনুভবে প্রতিক্ষণ। মাদাম ইউ কোয়াং য়ূএ আমার সাথে অনেক গল্প করেন। শ্রোতাদের অত্যন্ত প্রিয় এই মানুষটিকে আমারও খুব ভাল লাগে। মি. চিয়াং সাহেব আমাকে বলেছিলেন তার বাংলা নাম অমিত। কিন্তু কেউ তাকে এই নামে ডাকে না। আমি বলেছিলাম- আমি ডাকব। কিন্তু আর ডাকা হয় নি। আর ডাকা হবে না মি. লি ইউয়ান শান কিংবা মিস. লি ওয়েই তান কে। দুজনেই যথাক্রমে স্থায়ী এবং অস্থায়ীভাবে আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন। ভীষণ ভাল লাগে বাংলা বিভাগের সকল পুরনো-নতুন বন্ধুকেই। আমার মনে আছে নতুন কর্মীরা যখন বাংলা বিভাগে যোগ দিয়েছেন তখন তাদেরকে আমি একটি বিশাল শুভেচ্ছা বার্তা লিখেছিলাম। পরবর্তীতে এই বার্তাটি দু'টি পর্বে ভাগ করে অনুষ্ঠানে প্রচার করা হয়। এখনও এই লেখাটি সিআরআই ওয়েবসাইটে দেওয়া আছে।
৪০ বছর আগে আকাশপথে শ্রোতাদের সাথে সিআরআইয়ের যে যোগাযোগের সূচনা হয়েছিল তা আজ বিশালত্ব অর্জন করেছে। চীন বাংলাদেশ মৈত্রী সংগঠনগুলোর মধ্যে সিআরআই শ্রোতাসংঘ এক বিশেষ মর্যাদা লাভ করেছে। সিআরআই কর্মীদের বাংলা ভাষার প্রতি ভালবাসা আমাকে প্রভাবিত করেছে বিশেষভাবে। তারা অনেক কষ্ট করে বাংলা ভাষা শিখে আমাদের জন্য অনুষ্ঠান করছেন।
আমার জীবনে একটা গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করে আছে সিআরআই। সিআরআইয়ের মাধ্যমে অনেক বন্ধু পেয়েছি যা আমাকে নিয়ে গেছে এক রোমাঞ্চকর শখের দুনিয়ায়। আমি সিআরআইকে ভালবাসি, চীন এবং চীনাদেরকে ভালবাসি। ভাগ্যক্রমে সিআরআইয়ের সাথে আমার পরিচয় হয়েছে; আমি এই বন্ধুত্ব ভুলে থাকতে পারবো না কোনদিন। আমি চাই আমাদের যোগাযোগ আরো নিবিড়তর হোক। আমি যেন বলতে পারি- এ আমার বেতার, আমার ইচ্ছেয়- আমার আপন হাতে গড়া।
বাংলা বিভাগের প্রতি আমার কিছু পরামর্শঃ ১) পূবের জানালা ম্যাগাজিনে ধারাবাহিকভাবে চীনের ৫৬টি জাতির নাম ও সংক্ষিপ্ত পরিচয় প্রকাশ করা যেতে পারে। ২) চীনের ঐতিহাসিক ঘটনাবলীর ছবি প্রকাশ করা যেতে পারে। ৩) সি আর আইয়ের নতুন পুরনো সহ অবসরপ্রাপ্ত কর্মীদের প্রোফাইল প্রকাশ করা যেতে পারে। ৪) নিয়মিত অনুষ্ঠান সম্পর্কিত মতামত জরিপের আয়োজন করা যেতে পারে। ৫) চীনের ১৬৪টি দেশের সাথে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপনের প্রেক্ষাপট নিয়ে ধারাবাহিক অনুষ্ঠান করা যেতে পারে। ৬) সিআরআই এবং ঢাকাস্থ চীনা দূতাবাসের যৌথ উদ্যোগে চীনা পুস্তক অনুবাদ করে ঢাকার খ্যাতনামা প্রকাশকদের মাধ্যমে প্রকাশের ব্যবস্থা নেয়া যেতে পারে। ৭) শ্রোতাদের টেলিফোন সাক্ষাৎকার ভিত্তিক একটি অনুষ্ঠান করা যেতে পারে। ৮) এফ এম প্রচারতরঙ্গে ঢাকায় অনুষ্ঠান প্রচারের ব্যবস্থা নেয়া যেতে পারে। ৯) শ্রোতাদের কাছ থেকে রিসেপশন রিপোর্ট সংগ্রহ করে অনুষ্ঠানের শ্রবণমান ভাল করা যেতে পারে। ১০) ঢাকায় কোন চীনা অনুষ্ঠান হলে আগে থেকেই তার খবর প্রচার করা উচিত। ১১) বেতারে প্রচারিত অনুষ্ঠান এবং চীনা ভাষা শেখার আসর MP3 (এমপিথ্রি) ফরম্যাটে ওয়েবসাইটে দেওয়া হলে শ্রোতারা ডাউনলোড করে ইচ্ছেমতো শোনতে পারবে। ১২) ওয়েবসাইটে প্রত্যেকটি বিষয়ে আলাদা লিংক পেজ আসায় একই সাথে অনেক পাতা দেখা যায় যা খুবই সহজ এবং ইউজার ফ্রেন্ডলি। তবে যেসব পাতায় আমরা মন্তব্য করি, সেই পাতায় মন্তব্যটি প্রকাশের পর এর একটি লিংক উল্লেখিত ই-মেইল ঠিকানায় পাঠালে পরবর্তীতে মন্তব্যকারী তার মন্তব্যটি সহজেই দেখতে পারবে।
ছবি পরিচিতিঃ ১) সিআরআইয়ের শ্রেষ্ঠ শ্রোতাসংগঠক পুরষ্কার (২০০৪) নিচ্ছেন নেপচুন রেডিও ফ্রেন্ডস্ ক্লাবের পরিচালক মোঃ লুৎফর রহমান। পুরষ্কার বিতরণী অনুষ্ঠানটি হয়েছিল ঢাকার রাজারবাগে হোটেল আশরাফী ভবনে। অন্যান্যদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন চীনা দূতাবাসের তৎকালীন কালচারাল কাউন্সেলর মি. লিউ সান চেন, ওয়াং তান হোং, সিআরআই লিসনার্স ক্লাব অফ বাংলাদেশের চেয়ারম্যান সৈয়দ রেজাউল করিম বেলাল এবং মহাসচিব জিল্লুর রহমান জিলু ২) চীনা দূতাবাসে ওয়াং তান হোং এর সাথে মোঃ লুৎফর রহমান, ৩) চীনা দূতাবাসে ওয়াং তান হোং এর সাথে মোঃ লুৎফর রহমান, ৪) নিজের ছবি
[লেখকঃ নেপচুন রেডিও ফ্রেন্ডস্ ক্লাবের পরিচালক এবং অনলাইন নেপচুন নিউজ ম্যাগাজিনের সম্পাদক] |