v চীনের বিশ্ব কোষv চীন আন্তর্জাতিক বেতারv বাংলা বিভাগ
এক টুকরো বাংলাদেশ
2008-12-28 12:55:24
                                                                                                            ---মাহমুদ হাশিম

    চুং গোয়া কোওচি কোয়াম্পো তিয়েন থাই-বিশাল ভবনটির গায়ে লম্বালম্বি লেখা চায়নিজ শব্দ কয়টির ওপর আমার চোখ। সময় সকাল সাড়ে ৮টা, ১১ আগস্ট ২০০৫। আমি দাঁড়িয়ে চায়না রেডিও ইন্টারন্যাশনালের (সিআরআই) গেটে। সিআরআই বাংলা বিভাগে চাকরি নিয়ে আগের দিন বেইজিং এসেছি। গলায় পরিচয়পত্র ঝুলিয়ে চায়নিজ আর নানা দেশের কর্মীরা ব্যস্তসমস্ত হয়ে ঢুকছেন অফিসে।

    নি হাও! আমার সুবর্ণা। আপনি আমাদের নতুন বিশেষজ্ঞ হাশিম সাহেব? চমকে তাকিয়ে দেখি, আমার পাশেই দাঁড়িয়ে এক চায়নিজ তরুণী। ঢাকা থেকে যাওয়ার আগে নি হাও (চীনা কায়দায় সম্ভাষণ), নি হাও মা? (আপনি ভালো আছেন?) জাতীয় কিছু বাক্য শিখে গিয়েছিলাম। কিন্তু সুবর্ণা নামের চায়নিজ মেয়ের মিষ্টি বাংলা শুনে সব গেল গুলিয়ে। শুধু মাথাটা এদিক-ওদিক করে সায় দিলাম। আমার লাগেজটা টেনে নিয়ে সুবর্ণা হাঁটা দিল, আমি তার পিছু পিছু। সিআরআই-এর ১১ তলায় বাংলা বিভাগে অনেকগুলো হাসিমুখ আমাকে স্বাগত জানালো্

    আমার সহকর্মীরা

    বাংলা বিভাগে আমার প্রবীণ সহকর্মী ছিলেন প্রফেসর লি ইউয়ানশান, শি চি উ, পাই খাই ইউয়ান, থান ইয়াও খাং, মাদাম ফোং সিউ ছিয়েন ও মাদাম চুং শাওলি। বাংলায় তাদের প্রত্যেকের চমত্কার দখল। বিভিন্ন দেশের ভূগোল আর ইতিহাসে দারুণ জ্ঞান লি সাহেবের। বেলাল ভাইয়ের (সিআরআই শ্রোতা সংঘের চেয়ারম্যান সৈয়দ রেজাউল করিম বেলাল) কাছে তার অনেক প্রশংসা শুনেছি। নিপাট ভদ্রলোক মৃদুভাষী শি সাহেব। কিছুটা গম্ভীর প্রকৃতির পাই সাহেব চীনা ভাষায় রবীন্দ্র-নজরুলের খ্যাতিমান অনুবাদক। দারুণ আমুদে থান সাহেব। মজার মজার কথা বলে সবাইকে রাখতেন মাতিয়ে। তার প্রাণখোলা হাসির শব্দ এখনো কানে বাজে। 'বেশি বেশি খাবে' খাওয়া-দাওয়ায় আমার অনাগ্রহ দেখে বলতেন স্নেহার্দ মাদাম ফোং। বিকাল সাড়ে পাঁচটায় ডিনার খেতে আমাকে মাঝে মধ্যে জোর করে ধরে নিয়ে যেতেন(চায়নিজরা ৪ থেকে ৭টার মধ্যে রাতের খাবার খায়)।

    আর কিছুদিন সময় পেলে তিনি হয়তো কোনো চায়নিজ মেয়ের সঙ্গে আমার বিয়েই দিয়ে দিতেন।স্নেহ পেয়েছি মাদাম চুংয়েরও। কোনো মজার কথা কিংবা আমার ভুলভাল চায়নিজ শুনে অন্যরা হাসতো, আর মাদাম চুং গড়িয়ে পড়তেন উচ্ছ্বল হাসিতে। বাংলা বিভাগের প্রধান মাদাম ইয়ু কুয়াং য়ুএ। বয়স ৪০-এর কোঠা পেরোয়নি। ধীরস্থির, মার্জিত ভদ্র মহিলা। দক্ষ অ্যাডমিনিস্ট্রেটর। চমত্কার পরিচালনা করছেন বিভাগকে। সব বিষয়ে আন্তরিক সহযোগিতা পেয়েছি তার কাছে।

    বাংলা বিভাগের ডেপুটি ডিরেক্টর চিয়াং চিন ছেং। বয়স ৫০ পেরুলেও দারুণ হ্যান্ডসাম এখনো। শরীর ঠিক রাখতে মেয়েদের সঙ্গে টেনিস খেলেন রোজ। গড় চায়নিজদের তুলনায় চিয়াং সাহেব বেশ লম্বা। একদিন এক মজার কাণ্ড, লম্বাত্ব নিয়ে চিয়াং সাহেব আমাকে চ্যালেঞ্জ করে বসেন। অবশেষে পাশাপাশি দাঁড়িয়ে মাপামাপি। বিভাগের ভোট আমার দিকে। খুবই হতাশ বেচারা। সান্ত্বনা দেয়ার জন্য বলি, আপনি দৈর্ঘ্যে না হলেও প্রস্থে আমার চেয়ে ভালো!

    নয় তরুণী, নো তরুণ

    প্রবীণদের পাশাপাশি বিভাগে আমার সহকর্মী নয় চায়নিজ তরুণী। মুক্ত(ছাই ইউয়ে), প্রেমা(খোং চিয়া চিয়া), লাবন্য(লিলি), পান্না(লিলু), সুবর্ণা(ছাও ইয়ান হুয়া), স্বর্ণা(ইয়াং ওয়েই মিং), শিখা(শুয়েই ফেই ফেই), উর্মি(ওয়াং হাইমান) ও রুবি(ওয়াং তান হোং)। সুবর্ণা বর্তমানে ঢাকায় চায়না দূতাবাসে ডেপুটেশনে কর্মরত। দুই-একজন বাদে তাদের চমত্কার বাংলা নামগুলো দিয়েছেন বিভাগে আমার বাঙালি সহকর্মী তাহের ভাই(দি ইন্ডিপেন্ডেন্টের সাবেক বিজনেস এডিটর মহিউদ্দিন তাহের)। দীর্ঘ নয় বছর দারুণ সুনামের সঙ্গে বাংলা বিভাগে কাজ করেছেন সবার প্রিয় তাহের ভাই।

    আমার তরুণী সহকর্মীদের সবাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আধুনিক ভাষা ইন্সটিটিউটে ১০ মাস বাংলা শিখেছেন। প্রত্যেকেই ভীষণ ফ্রেন্ডলি আর স্মার্ট, সুন্দরীও বটে। সিআরআই-এর ৪৩টি বিভাগের মধ্যে আর কোনো বিভাগে এতো সুন্দরী নেই। অন্য বিভাগের কর্মীরা বাংলা বিভাগকে রীতিমতো ঈর্ষার চোখে দেখে তাই। তাদের সঙ্গে কাজ করতে গিয়ে কতো যে মজার কাণ্ড, ছোট দুই-একটা নমুনা: ওসমান গনি নামে বাংলাদেশের এক শ্রোতা চিঠি লিখেছেন। আমার এক সহকর্মী তাকে বানিয়ে দিয়েছেন অসমান গনি। সংশোধনের সময় তাকে নামটা আবার উচ্চারণ করতে বললাম, অ-সমান গ-নি- নিশ্চিন্ত জবাব তার। বিষয়টা ধরিয়ে দেয়ার পর পুরো বিভাগে অট্টহাসি। আরেকজন লং ডিসটেন্স ফ্লাইং কনটেস্টের বাংলা করেছেন দূরপাল্লার মক্ষিকা উড্ডয়ন প্রতিযোগিতা। ডিকশনারিতে ফ্লাই শব্দটার এ দুটো যুৎসই শব্দ পেয়েছেন তিনি আর দুটোই বসিয়ে দিয়েছেন। অন্য এক সহকর্মী ব্লু-প্রিন্ট শব্দের বাংলা করেছেন, নীলপত্র! হোয়াইট পেপার যদি শ্বেতপত্র হতে পারে তাহলে ব্লু-প্রিন্ট অর্থ নীলপত্র হতে দোষ কি? অকাট্য যুক্তি তার। এমন অসংখ্য মজার মজার ঘটনা। লেখায় কোনো ভুল ধরিয়ে দেয়ার পর তাদের সলজ্জ হাসি মুখের কথা আমার মনে থাকবে অনেক দিন।

    সিআরআই ও বাংলা বিভাগ

    জাপানি ভাষায় ১৫ মিনিটের অনুষ্ঠান দিয়ে সিআরআই-এর যাত্রা শুরু ১৯৪১ সালের ৩ ডিসেম্বর। ১৯৬৯ সালের ১ জানুয়ারী শুরু বাংলা ভাষায় সম্প্রচার। বর্তমানে ৩৮ বিদেশি ভাষা ও চায়নার ম্যান্ডরিনসহ পাঁচটি আঞ্চলিক ভাষায় অনুষ্ঠান সম্প্রচার করে সিআরআই। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে সিআরআই-এর ২৭টির ব্যুরো অফিস আছে। বাংলা বিভাগ প্রতিদিন এক ঘন্টার অনুষ্ঠান প্রচার করে চার বার। চায়নার বিশ্বকোষ সমৃদ্ধ একটি ওয়েবসাইট এবং 'পূবের জানালা' নামে একটি পত্রিকা রয়েছে বিভাগের।

    সিআরআই-এ কাজ করতে গিয়ে আমার কখনো মনে হয়নি আমি বিদেশি কোনো প্রতিষ্ঠানে কাজ করছি। চায়নিজ সহকর্মীরা বাংলায় কথা বলেন, বাংলায় লেখেন, অনেকের জীবনাচারেও বাংলার ছাপ। সব কিছুই বাংলাকেন্দ্রিক। প্রবীণরা গোটা জীবনটাই ব্যয় করেছেন বাংলা চর্চায়। নবীনরাও একই পথের পথিক। সিআরআই বাংলা বিভাগ বেইজিংয়ের বুকে যেন এক টুকরো বাংলাদেশ।

    (লেখক সিআরআই বাংলা বিভাগের সাবেক বিশেষজ্ঞ। বর্তমানে একই বিভাগের বাংলাদেশ প্রতিনিধি হিসেবে কর্মরত।)

  • সাক্ষাত্কার
  • সর্বশেষ সংবাদ
  • অন-লাইন জরীপ
     
    © China Radio International.CRI. All Rights Reserved.
    16A Shijingshan Road, Beijing, China