v চীনের বিশ্ব কোষv চীন আন্তর্জাতিক বেতারv বাংলা বিভাগ
প্রথমবার চীনে আগমন---কিছু স্মৃতি
2008-12-28 12:47:33
                                                                                                            ---মুন্সী ফয়েজ আহমদ

    অনেক ছোট বয়স থেকেই চীন সম্পর্কে আমার গভীর কৌতুহল। আমার এক মামা আমাদের বাড়ীতে থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করতেন এবং তিনি স্থানীয় কমিউনিস্ট আন্দোলনের সাথে গভীরভাবে জড়িত ছিলেন। তিনি সবসময়ে আমাদেরকে চীনে গল্প, মাও-সেতুঙ, চৌ-এন লাই প্রমুখ রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের জীবনি শোনাতেন। তখন থেকেই চীনকে জানার বিষয়ে আগ্রহ জন্মাতে থাকে এবং হয়তো কিছুটা মোহগ্রস্থও হয়ে পড়ি। বয়স বাড়ার সাথে সাথে আমিও সমাজতান্ত্রিক ধারার রাজনীতির বিষয়ে আগ্রহী হয়ে উঠি এবং আস্তে আস্তে জড়িয়ে পড়ি। ফলে চীনের বিপ্লব, উন্নয়নধারা ও চীনের মানুষকে আরও বেশী করে জানা ও দেখার জন্যে আমার আকুলতা ক্রমেই বাড়তে থাকে।

    ১৯৭৯ সালে আমি বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিস (পররাষ্ট্র বিষয়ক) ক্যাডারে নিয়োগ পাই। চাকরিতে যোগদানের পর পরই কে কোন ভাষা শিখতে চাই সে বিষয়ে আমাদের ব্যক্তিগত পছন্দের কথা জিজ্ঞেস করা হলে আমার সহজ উত্তর ছিল চীনা ভাষা। যেহেতু তৃতীয় ভাষা শিক্ষার বিষয়টি আমাদের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে তখনও খুব নিয়মিত রূপ ধারণ করেনি, তাই অচিরেই বিষয়টি অন্তরালে পড়ে যায়। দু'বচর পর হঠাৎ একদিন প্রশাসন বিভাগের মহা-পরিচালক আমাকে ডেকে জানালেন যে একটি চীনা সরকারি বৃত্তি পাওয়া যাচ্ছে চীনা ভাষা শেখার জন্য – আমি যেতে রাজি আছি কিনা? সাথে সাথে তিনি পরিষ্কার করে এও জানালেন যে, বৃত্তিটি আর্থিক দিক বিবেচনায় তেমন পর্যাপ্ত নয় এবং আমি যেতে না চাইলে তাঁরা আশ্চর্য হবেন না। আমি তাত্ক্ষনিক জানালাম যে আমি কারও চেয়ে কম বা বেশী নই সুতরাং সরকার যদি এ বৃত্তির অনুকূলে কাউকে চীনে পাঠাতে চান আমি তা গ্রহণ করতে সম্পূর্ণ প্রস্তুত। মহা-পরিচালক মহোদয় আমাকে আবারও ভেবে দেখতে বলেন। প্রতিউত্তরে আমি বলাম যে আমার এ বিষয়ে আর ভাবার প্রয়োজন নেই এবং আমি যেতে প্রস্তুত। তখন তিনি আমাকে পরামর্শ দিলেন যে যেহেতু বৃত্তিটি আর্থিকভাবে পর্যাপ্ত নয় সেহেতু আমি আবেদন করলে হয়তো বাংলাদেশ সরকার আমাকে আরও কিছু অর্থ প্রদানের ব্যবস্থা নিতে পারে। তাঁর পরামর্শ অনুযায়ী আমি চেষ্টা করে বাংলাদেশ সরকারের কাছ থেকে অল্প কিছু অতিরিক্ত অর্থের ব্যবস্থা করতে সক্ষম হলাম। বলা বাহুল্য যে বৃত্তির অর্থ ও বাংলাদেশ সরকার প্রদত্ত অতিরিক্ত অর্থ মিলিয়েও মোট অর্থের পরিমাণ একজন কূটনৈতিক কর্মকর্তার প্রয়োজনের তুলনায় অত্যন্ত অপ্রতুল ছিল। কিন্তু চীনে যেতে পারার, চীনের মানুষ সম্পর্কে আরও বেশী করে জানার অমূল্য সুযোগের কাছে এ সমস্যা আমার কাছে তেমন গুরুত্ব পেলনা।

    সমস্ত প্রস্তুতি শেষ করে ১৯৮১ সালের আগস্ট মাসের এক সুন্দর দিনে বাংলাদেশ নৌবাহিনীর একজন কর্মকর্তাসহ (তিনিও অনুরূপ একটি বৃত্তির অধীনে চীনা ভাষা শেখার জন্যে মনোনীত হয়েছিলেন) চীনের উদ্দেশ্যে ঢাকা ত্যাগ করি। তখন ঢাকা ও চীনের রাজধানী পিকিং(পেইচিং)-এর মধ্যে কোন সরাসরি বিমান যোগাযোগ ছিল না। ব্যাংকক অথবা হংকং হয়ে যেতে হতো। হংকং থেকে সরাসরি পিকিং যাওয়ার ব্যবস্থা ছিল। কিন্তু আমাদের ট্রাভেল এজেন্সী সেটার ব্যবস্থা করতে না পেরে হংকং থেকে ক্যান্টন(কোয়াংচৌ) হয়ে পিকিং যাওয়ার ব্যবস্থা করেছিল। প্রথমবারের মতো দেশ ছেড়ে বিদেশ পাড়ি দেয়ায় আমি এবং আমার সহযাত্রী লেফ্টেন্যান্ট ফরিদ, দুজনেই দ্বিধা, শঙ্কা ও চিন্তাগ্রস্থ ছিলাম। যাহোক, হংকং পর্যন্ত পৌঁছুতে আমাদের তেমন কোন সমস্যা হয়নি। দুপুরের পর হংকং পৌঁছুই এবং ৪/৫ ঘন্টা পর ক্যান্টনে যাওয়ার সংযোগ ফ্লাইট ছিল। ট্রান্জিট ডেস্কে ধারালো চেহারার মহিলা কর্মকর্তার রুক্ষ্ম মাস্টারীসুলভ আদেশ-নির্দেশে আমরা দুই অনভিজ্ঞ যাত্রী বেশ নাজেহাল ও সন্ত্রস্ত। ফ্লাইটের জন্য দীর্ঘ অনিশ্চিত অপেক্ষা হয়ে উঠল আরো দুঃসহ। ট্রাভেল এজেন্টের কোন একটা ভুলের কারণে আমাদের পরবর্তী ফ্লাইট নিশ্চিত ছিল না এবং অপেক্ষা তালিকায় আমাদের নাম উঠানো হলো। আমাদের অনেক অনুনয়-বিনয়ের পর মহিলা সদয় হয়ে অপেক্ষা তালিকার প্রথমদিকে আমাদের নাম তুলতে রাজি হলেন। ২/৩ ঘন্টা অনিশ্চয়তার মধ্যে থেকে নির্ধারিত সময়ে ট্রান্জিট ডেস্কে ফেরত গেলে শেষপর্যন্ত চিন্তা দূর হলো এবং পূর্বনির্ধারিত ফ্লাইটে ক্যান্টন যাওয়ার নিশ্চিত হলো। আমাদের জন্য যে আরো বড় সমস্যা অপেক্ষা করে আছে তা বুঝলাম ক্যান্টন পৌঁছে।

    হংকং থেকে ক্যান্টন খুবই কাছে। মাত্র আধা ঘন্টার উড়ান। আমরা সন্ধ্যা সাড়ে ছয়টার দিকে ক্যান্টন পৌঁছলাম। আমাদের টিকেট অনুযায়ী এক ঘন্টা পর, অর্থাৎ সন্ধ্যা সাড়ে সাতটায় পিকিং যাওয়ার কানেকটিং ফ্লাইট। হংকং অর্থাৎ চীনের বাইরে থেকে আসার কারণে ক্যান্টন বিমান বন্দরে প্রথমেই আমাদের ইমিগ্রেসন চেকিং করাতে হল। তাতে কিছু সময় ব্যয় হল। বাইরে এসে ট্রান্জিট ডেস্কে খোঁজ করতেই লাগল বড় ধাক্কা। পিকিং যাওয়ার শেষ ফ্লাইট ছেড়ে গেছে বিকেল সাড়ে পাঁচটায়। ট্রাভেল এজেন্টের দায়িত্বহীনতা, অদক্ষতা ও অসাবধানতার মাশুল দিতে আমরা রাতের জন্য আটকা পড়ে গেলাম ক্যান্টনে। সমস্যা আরো প্রকট হলো ভাষা বিভ্রাটে। আমরা দুজনেই চীনা ভাষার 'চ'-ও জানিনা। এয়ারপোর্টে বেশীরভাগ লোকই ইংরেজী বোঝেনা। যাও-বা দু'একজন বোঝে, তাদের ইংরেজী বোঝা আমাদের সাধ্যের বাইরে। তাছাড়া স্থানীয় চীনারা যখন নিজেদের মধ্যে কথা বলছে-বেশ উঁচু স্বরে-মনে হচ্ছিল বুঝি ঝগড়া করছে। খুব ঘাবড়ে গেলাম-এ কেমন ভাষা? শিখতে পারব তো? তবে লোকগুলোকে বেশ বন্ধুভাবাপন্ন মনে হলো। বুঝতে অসুবিধা হয় না যে তারা আমাদের সাহায্য করতে আগ্রহী।

    এদিকে রাত প্রায় আটটা বেজে গেছে। থাকার জায়গা ঠিক করতে হবে। রাতের খাবার প্রয়োজন। অনেক কষ্টে বোঝা গেল যে পাশেই এয়ারপোর্ট হোটেল এবং এয়ার লাইন্স কর্তৃপক্ষ সেখানেই আমাদের থাকার ব্যবস্থা করেছে। সকাল সাড়ে নয়টায় আমাদের পিকিং যাওয়ার ফ্লাইট। কিছুটা নিশ্চিন্ত হয়ে হোটেলে গেলাম। এখানে ভাষার সমস্যা আরো প্রকট। অনেক কষ্টে ইশারা-ইঙ্গিতে বোঝালাম যে খাওয়া প্রয়োজন। উত্তরে অনেক কষ্টে যা বোঝা গেল, তার অর্থ হলো রাতের খাবার সময় অনেক আগেই পেরিয়ে গেছে। এখন কোন রেস্তোরা খোলা নেই। মহা চিন্তায় পড়ে গেলাম। হঠাৎ চোখে পড়ল-হোটেলের লবিতে একটি কাঁচের আলমারীতে কিছু শুকনো মতো কেক ও বিস্কুট রাখা আছে। আকার-ইঙ্গিতে হোটেলের লোককে বোঝালাম যে আর কিছু না পেলে ওগুলো দিয়েই চালিয়ে নেব। শেষ পর্যন্ত শুকনো কেক বিস্কুট আর গরম পানি খেয়ে রাতটা পার করলাম।

    পরদিন সকালে, তিনঘন্টার উড়ান সেরে দুপুরের দিকে পিকিং পৌঁছালাম। দূতাবাস থেকে লোক এসেছেন আমাদের অভ্যর্থনা জানাতে। তাদের পেয়ে আমরা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললাম। তাদের সাহায্যে সব আনুষ্ঠানিকতা সেরে দুপুর একটার দিকে আমাদের নির্ধারিত প্রতিষ্ঠান পিকিং ভাষা ইনস্টিটিউটে পৌঁছালাম। আমাদের শিক্ষক অপেক্ষায় ছিলেন। পৌঁছাতেই দুপুরের খাবারের জন্য ক্যান্টিনে নিয়ে গেলেন। খাওয়ার পর আমাদের থাকার কক্ষ দেখিয়ে দিলেন। আমাদের দুজনের একই কামরায় থাকার ব্যবস্থা হওয়ায় আমরা উভয়ই খুশী হলাম। তারপর ঘুরে ঘুরে একাডেমিক বিল্ডিং, প্রশাসনিক দপ্তর, মিলনায়তন, খেলার মাঠ, দোকান ইত্যাদি দেখালেন আমাদের শিক্ষক।

    সন্ধ্যা ছয়টায় রাতের খাবারের সময়। পূর্ব থেকেই একই প্রতিষ্ঠানে অধ্যয়নরত কয়েকজন বাংলাদেশী ছাত্র আমাদের পৌঁছানোর খবর পেয়ে দেখা করতে এসেছিল। তাদের সাথে যেয়ে রাতের খাবার খেয়ে নিলাম। কক্ষে ফিরতে ফিরতে খেয়াল করলাম যে আমাদের কক্ষের পাশেই টেলিভিশন কক্ষ। কাজ নেই, তাই যেয়ে বসে গেলাম। কিছুই বুঝিনা, তবু বসে থাকলাম। অন্য যারা দেখছিল, তাদের কাছ থেকে জানলাম-তখন চীন দেমে টেলিভিশনে কেবল একটাই চ্যানেল দেখা যায় এবং সন্ধ্যা ছয়টা থেকে রাত এগারটা পর্যন্ত মোট পাঁচ ঘন্টার অনুষ্ঠান প্রচার হয় প্রতিদিন। এরপর ভাষা ইনস্টিটিউটে যে প্রায় দু'বছর ছিলাম, তার প্রায় প্রতিদিন অন্ততঃ তিন থেকে চার ঘন্টা বসে থেকেছি টেলিভিশনের সামনে। প্রথমে কিছুই বুঝতাম না, কিন্তু ক্রমে ক্রমে একটি দুটি শব্দ, তারপর আরও বেশী শব্দ, পূর্ণ বাক্য ইত্যাদি পরিচিত লাগতে শুরু করল। যতবেশী বুঝতে পারি ততই তৃপ্তি বোধ করি। শেষপর্যন্ত চীনা ভাষা শেখায় এই টেলিভিশনের সামনে বসে থাকা আমার জন্য অত্যন্ত উপকারী প্রমাণিত হয়েছিল।

  • সাক্ষাত্কার
  • সর্বশেষ সংবাদ
  • অন-লাইন জরীপ
     
    © China Radio International.CRI. All Rights Reserved.
    16A Shijingshan Road, Beijing, China