v চীনের বিশ্ব কোষv চীন আন্তর্জাতিক বেতারv বাংলা বিভাগ
ছিন রাজবংশের মহাপ্রাচীরকে দেখা
2008-11-27 16:15:01
    আপনি চীনের মহাপ্রাচীরের কথা নিশ্চয়ই শুনেছেন? সেটা হচ্ছে চীন এমনকি বিশ্বের সুপ্রাচীনকালের নির্মাণ ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশী সময় নেয়া এবং বৃহত্তম পরিমাণের একটি প্রতিরক্ষা প্রকল্প। খৃষ্টপূর্ব দ্বিতীয় শতাব্দীর ছিন রাজবংশের সময় মহাপ্রাচীর নির্মাণের কাজ বিপুলভাবে শুরু হয়। ২ হাজারেরও বেশী বছরের মধ্য দিয়ে ৫ হাজারেরও বেশী কিলোমিটারের মহাপ্রাচীর নির্মিত হয়েছে। আজকের অনুষ্ঠানে আমরা মহাপ্রাচীর অনুরাগী সিনপিং এবং পথপ্রদর্শক ইয়ু পাও-এর সঙ্গে ২ হাজার বছর আগে নির্মাণ কাজ শুরু হওয়া, এখনও অক্ষুন্ন থাকা ছিন মহাপ্রাচীরকে দেখতে যাবো।

     পথপ্রদর্শক ইয়ু পাও অন্তর্মঙ্গোলিয়ার কু ইয়াং-এর অধিবাসী। আমরা যেখানে যাবো, সেখানে তার জন্মস্থান—কু ইয়াং থিয়ান শেং ছেং গ্রামের বাইরের একটি অংশ বন্য মহাপ্রাচীর। অর্থাত প্রাচীর ঘীরে রয়েছে ঘন অরণ্যং গাছের সারি। যাওয়ার পথে ইয়ু পাও আমাদেরকে মাহপ্রাচীরের দেয়ালের নিচের দিকে গ্রামবাসীদের গুণের কথা বলেছেন। তিনি বলেন, আমাদের এখানকার মানুষ খুব সহজ ও সরল। আপনি খাবার খেতে চান অথবা কোথায় যেতে চাইলে, তারা আপনাকে কাঙ্ক্ষিত জায়গায় পৌঁছে দেবেন। আমাদের গ্রামে প্রবেশ করে, যদি আপনি পানি বা খাবার খেতে চান, তারা আপনাকে গরম পানি দেবেন। কখনোই ঠাণ্ডা পানি দেবেন না।

    মহাপ্রাচীর নির্মাণের জন্য ২ হাজারেরও বেশী বছর লেগেছে। ফলে উত্তর চীনে ৫ হাজারেরও বেশী দীর্ঘ এ প্রাচীর বিস্তীর্ন হয়। এত বড় প্রকল্প মানবজাতির ইতিহাসে অদ্বিতীয়। ইতিহাসপজ্ঞী অনুযায়ী, চীনকে একীভূত করার পর দেশ সুসংহত এবং উত্তরাঞ্চলের সিয়োং নু যাযাবর জাতির হামলা প্রতিরোধের জন্য ছিন সম্রাট ৩ লাখ সৈন্যকে মহাপ্রাচীর নির্মাণের নির্দেশ দিয়েছিলেন। ২ হাজার বছর আগে নির্মিত ছিন মহাপ্রাচীরের কিছু অংশ এখনও পুরোপুরিভাবে সংরক্ষিত রয়েছে। এতে চীনা মানুষের পিতৃপুরুষদের উচ্চ পর্যায়ের জ্ঞান চর্চার দিকটি প্রতিফলিত হয়েছে। 

     অন্তর্মঙ্গোলিয়ার পাও থৌ শহরের কু ইয়াং জেলার ছিন রাজবংশের মহাপ্রাচীর এর মধ্যে একটি অংশ। গত শতাব্দীর ৯০ দশকে বিশেষজ্ঞরা চিহ্নিত করেছেন যে, এটা খৃষ্টপূর্ব ২১৪ সালে ছিন সম্রাট জেনারেল মেং থিয়ানকে নির্মাণ করার নির্দেশ দিয়েছিলেন। পাশাপাশি এটা এ পর্যন্ত চীনে সংরক্ষণ করা ছিন রাজবংশের মহাপ্রাচীরগুলোর মধ্যে সবচেয়ে অন্যতম এবং অক্ষুন্ন অংশ।

    ইয়ু পাও বলেছেন, কু ইয়াং জেলার ছিন মহাপ্রাচীরের উত্তর দিকে গেলে, মঙ্গোলিয়ার মরুভূমি দেখা যায়। আমরা কু ইয়াং জেলা থেকে রওয়ানা করে ২০ মিনিটের মধ্যেই থিয়ান শেং ছেং গ্রামে পৌঁছাই। আরো সামনে গাড়ি আর যাবে না। গাড়ি থেকে নামার পর মহাপ্রাচীর নজরে পড়ে নি। শুধু এক একটি পাহাড় দাঁড়িয়ে রয়েছে। পথে আমাদের পথপ্রদর্শক ইয়ু পাও বলেছেন, প্রথম বার ছিন মহাপ্রাচীর আবিষ্কার করার সময় তিনি হেঁটে হেঁটে প্রায় এক সপ্তাহ অতিক্রম করেছেন। তিনি বলেন, প্রায় এক সপ্তাহ হেঁটে চলেছি। দিনে প্রায় ২০ মাইল। মহাপ্রাচীরের উত্স থেকে খাবার ও পানি নিয়ে এসেছি। প্রথম দিন খুবই ক্লান্ত। এবং এক সপ্তাহ একটানা হেঁটেছি। 

     তখন ছিন মহাপ্রাচীরের পথ খুঁজে বের করার অভিজ্ঞতা স্মরণ করে ইয়ু পাও বলেছেন, বাতাসের শব্দ ছিল বিকট। নেকড়ের চিত্কারের মত। প্রথম দিকে তার সঙ্গে এসেছিলেন তার কয়েকজন বন্ধু কিন্তু খুব কষ্টসাধ্য হওয়ার কারণে তারা অর্থেক পথ থেকেই ফিরে যায়। শুধু ইয়ু পাও একটি অবিচল থাকেন সামনের দিকে। মহাপ্রাচীরের প্রতি যে পছন্দ এবং জন্মস্থানকে উপলব্ধির আকাংক্ষা তাকে চালিকাশক্তি যোগায়। তিনি উপলব্ধি করতে চান, ২ হাজার বছর আগের মানুষেরা কীভাবে এত বিরাট আকারের মহাপ্রাচীর র্নিমাণ করলেন?

    ইয়ু পাও'র সঙ্গে ৫/৬ মিনিট হাটার পর আমরা দেখেছি নদীর ওপরে বরফ ছেয়ে আছে। সে দিনের তাপমাত্রা প্রায় ১৫ বা ১৬ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড। তবে এখানকার বরফ পুরোপুরিভাবে উষ্ণ হয়ে ওঠে নি। আমরা শুনতে পাচ্ছি ঝরণার মিষ্টিমধুর ছন্দ। পাহাড়ি পাথরের মধ্য দিয়ে বয়ে যাচ্ছে ইচ্ছেমতই। ইয়ু পার নির্দেশের দিকে বরাবর আমি সতর্কভাবে লক্ষ্য রেখেছি। সত্যিই আমি মহাপ্রাচীর দেখেছি। দেখেছি আর অবাক বিষ্ময়ে মুগ্ধ হয়েছি। 

     ছিন মহাপ্রাচীর নির্মাণের প্রধান উপকরণ হচ্ছে নাইস পাথর। এ সব পাথর ২ হাজারেরও বেশী বছরের বিভিন্ন ধরনের আবহাওয়ার মধ্য দিয়ে পার হয়ে এলেও এখনও কোন পরিবর্তন হয়নি। শুধু রঙ আরো গভীর হয়েছে। মহাপ্রাচীরের উত্তর দিকের উপরিতল খুব সমতল এবং স্পষ্টভাবেই স্থাপনের দাগ দেখা যায়। মহাপ্রাচীরের দেয়ালের সব উপকরণই হচ্ছে স্থানীয় পাথর এবং অবাক করার মত প্রক্রিয়াকরণ করা।

    পাহাড়ের চূড়ায় ওঠে আমরা একটি অগ্নিসংকেত টাওয়ার দেখেছি। আমার বন্ধু সিন পিং খুব খুশিতে টগবগ করে উঠেন। তিনি বলেন, এখন আমাদের পায়ের নিচে হচ্ছে একটি অগ্নিসংকেত টাওয়ার। এটা ছিন মহাপ্রাচীরের দক্ষিণ দিকের ৩০ মিটার দূরে অবস্থিত। এর ব্যাস প্রায় ১৫ মিটার এবং উচ্চতা ৬/৭ মিটার। অন্তর্মঙ্গোলিয়ার পার্বত্য অঞ্চলে চীনা জাতির নিরাপত্তার অতন্দ্র প্রহরী। আপনি এখানে এক ধরনের উদার আমেজ অনুভব করতে পারবেন। হারিয়ে যাবেন কল্পনার ভেতর। সেই কালের ইতিহাসের কথা মনে করে।

    ছিন মহাপ্রাচীর কু ইয়াং জেলার অংশে পড়েছে মোট ৮৫ কিলোমিটার। মহাপ্রাচীরের দেয়ালে বিরাট পেট্রোগ্রাম আছে। পেট্রোগ্রামের প্রধান প্রতিবিম্ব হচ্ছে ছাগল। ছাগলের শিং খুব বিশেষ ধরনের। ছাগলের শিং বাঁকা হয়ে তার পেছনের পায়ের কাছে চলে এসেছে। এছাড়া উটের পেট্রোগ্রামও আছে। সুযোগ পেলেই কিন্তু আপনাদের দেখেতে যাওয়া উচিত।

    ফিরে আসার পথে সিন পিং খুবই আনন্দিত। সারাটা পথ তিনি পাহাড়ি গান গেয়েছেন। যেন কোন ক্লান্তি নেই ১৯৯৬ সালে এখানকার ছিন রাজবংশের মহাপ্রাচীর জাতীয় পর্যায়ের গুরুত্বপূর্ণ পুরাকীর্তি নিদর্শন হিসেবে সংরক্ষিত হয়। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ছিন মহাপ্রাচীরের সংরক্ষণ সুশৃঙ্খলভাবে করা ও উন্নয়ন কাজ ত্বরান্বিত করার জন্য প্রতি বছর কু ইয়াং জেলা একবার ছিন রাজবংশের মহাপ্রাচীরে সাংস্কৃতিক উত্সবের আয়োজন করে। চলতি বছর হচ্ছে পঞ্চম বার। এবারের সাংস্কৃতিক পর্যটন উত্সব ১৮ আগস্ট থেকে ৩ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত আয়োজিত হয়। অন্তর্মঙ্গোলিয়া স্বায়ত্তশাসিত বিভাগের কু ইয়াং জেলা কমিটি ও সরকারের উদ্যোগে স্থানীয় এলাকার বিখ্যাত ছিন মহাপ্রাচীর উত্তরাধিকারসূত্রে প্রাপ্ত সম্পত্তিকে কেন্দ্র করে মহাপ্রাচীর সংক্রান্ত লেখা, চলা, মন্তব্য, ছবি তোলা এবং নাচ গানসহ বেশ কিছু সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের ব্যবস্থা করে।

    ছিন রাজবংশের মহাপ্রাচীর হচ্ছে বিশ্বের উত্কৃষ্ট সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকারসূত্রে প্রাপ্ত সম্পত্তি এবং বিশ্বের ৮টি বিস্ময়কারী নিদর্শনগুলোর মধ্যে অন্যতম। ছিন মহাপ্রাচীর একটি সোনালী লতার মত পূর্ব দিক থেকে পশ্চিম পর্যন্ত কু ইয়াং জেলার মধ্যাঞ্চলের মধ্য দিয়ে ৫টি গ্রাম ও শহর পার হয়ে গেছে। এর মোট দৈর্ঘ্য ১২০ কিলোমিটার। কয়েক বছরের সুরক্ষার মধ্য দিয়ে ছিন মহাপ্রাচীরের নিকটবর্তীতে চুকার ও বন্য খরগোশসহ বিভিন্ন পশু-পাখি সব জায়গায় ঘুরে বেড়ায়।

    প্রিয় শ্রোতাবন্ধুরা, সময় পেলে আপনারাও মহাপ্রাচীর নিজ চোখে দেখে আসতে ভুলবেন না। আজকের 'চলুন বেড়িয়ে আসি' অনুষ্ঠান এখানই শেষ করছি। শোনার জন্য আপনাদেরকে অসংখ্য ধন্যবাদ। আপনারা সবাই ভালো থাকুন, সুস্থ থাকুন। আগামীতে আবার দেখা হবে অন্য কোন দর্শনীয় স্থানে।

  • সাক্ষাত্কার
  • সর্বশেষ সংবাদ
  • অন-লাইন জরীপ
     
    © China Radio International.CRI. All Rights Reserved.
    16A Shijingshan Road, Beijing, China