
হেলমুট স্মিথ
এ বছরের প্রথম দিকে জার্মানীর সাবেক চ্যান্সেলর হেলমুট স্মিথ 'পশ্চিম জার্মান ডেইলি' পত্রিকায় এক বিশেষ সাক্ষাত্কার দেয়ার সময় বলেছেন, চীনের সংস্কৃতির নিজস্ব বৈশিষ্ট্য আছে। পশ্চিমা মাপ দিয়ে চীনকে মূল্যায়ণ করা যাবে না। চীনের সামাজিক সংস্কার নিজেদের পথটি অনুসরণ করতে হবে।
বহু পশ্চিমা লোকের চোখে 'সমাজতন্ত্র' মানে পরিকল্পিত অর্থনীতি, যৌথ-মালিকানাবাদ এবং ব্যক্তিগত অধিকারকে অবমাননা করা ইত্যাদি। কিন্তু যদি তারা চীনে এসে ঘুরে দেখেন, তাহলে তারা বুঝতে পারবেন যে, সমাজতন্ত্রী চীনের অবস্থা সেই রকম নয়। চীনের সমাজতন্ত্রের স্পষ্ট বৈশিষ্ট্য, ব্যবস্থার প্রাধান্য ও বিরাট প্রাণশক্তি রয়েছে।
স্মিথ একাধিকবার চীনে এসেছেন এবং চীনের সংস্কার ও উন্মুক্তকরণের প্রধান স্থপতি তেং সিয়াও পিংয়ের সঙ্গে সাক্ষাত্ করেছেন। চীনের ওপর তার কিছু ধারণা আছে বলে স্মিথ উপলব্ধি করেছেন, চীনের সংস্কারে নিজেদের পথেই এগিয়ে যেতে হবে। অর্থাত্ নিজ দেশের অবস্থা ও যুগের বৈশিষ্ট্যের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ হচ্ছে চীনের বৈশিষ্ট্যময় সমাজতান্ত্রিক পথ।
আজকের চীনে নানা ধরণের বাজার শহর ও গ্রামাঞ্চলের প্রতিটি জায়গায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। সস্তা দামের প্রাতকালিন বাজারে ফেরিওয়ালারা গভীর আগ্রহ নিয়ে বিবিধ পণ্য বিক্রি করে। ওয়াল-মার্টসহ নানা সুপারমার্কেটে ক্রেতারা শপিং এর জন্য ট্রলি নিয়ে লাইন দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকেন। বিলাসবহুল বাজারে সুন্দর সুন্দর দ্রব্য বহু ক্রেতাদের আকর্ষণ করে। এ সব দৃশ্য যথাযথভাবে চীনের বাজার ও অর্থনীতির প্রাণশক্তি প্রদর্শন করে।
বাজার একটি 'অদৃশ্য হাতের মতো চীনাদের জীবনের সর্বক্ষেত্রে ঢুকে গেছে। ৩০ বছর আগে অর্থাত্ ১৯৭৮ সালে উপরোক্ত দৃশ্যের চিন্তাও ছিল অভাবনীয়। তত্কালীন চীনে পরিকল্পিত অর্থনীতি অনুসরণ করা হতো। পণ্যের দাম ছিল একই। অধিবাসীরা খাদ্যের টিকিট ও তেলের টিকিটসহ নানা প্রমাণপত্র নিয়ে দৈনন্দিন প্রয়োজনীয় জিনিস কিনতেন। ১৯৮৪ সালে চীন যত্নের সাথে 'পরিকল্পিত পণ্য অর্থনীতি' উত্থাপন করে। কিন্তু আসলে বিপ্লবাত্মক পরিবর্তন ঘটেছে ১৯৯২ সালে।
১৯৯২ সালের অক্টোবরে চীনের কমিউনিস্ট পার্টির চতুর্দশ কংগ্রেসে সমাজতান্ত্রিক বাজার অর্থনীতি ব্যবস্থা গড়ে তোলার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। চীন এ প্রথমবার সমাজতন্ত্রের মৌলিক ব্যবস্থা ও বাজার অর্থনীতির সমন্বয় ঘটানো।
যদিও চীন বাজার অর্থনীতির উন্নয়ন করে, তবে এর পাশাপাশি চীন যৌথভাবে সমৃদ্ধ হওয়ার ক্ষেত্রকেও জোরদার করে। চীনের প্রয়াত নেতা তেং সিয়াও পিং 'কিছু লোকের প্রথমে ধনী হওয়া' কর্মসূচীতে উত্সাহিত করেছেন। এর লক্ষ্য হচ্ছে যারা প্রথমে ধনী হয়েছে, তারা অন্য মানুষদেরকে ধনী হওয়ার পথে নিয়ে যাবে, তারপর সবাই ধনী হোক। পশ্চিম চীনের মহা উন্নয়ন আর চীনের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের পুরোনো শিল্প অঞ্চলের পুনরুদ্ধার করা হচ্ছে চীনের অভিন্ন সমৃদ্ধির সুস্পষ্ট প্রতিফলন।
চীন সমাজতন্ত্রের গণতান্ত্রীক আইনী প্রশাসন বাছাই করেছে এবং আইনের দ্বারা মানবাধিকার ও ব্যক্তিগত সম্পত্তির নিশ্চয়তা বিধান করেছে। ২০০৪ সালের মার্চ মাসে দশম জাতীয় গণ কংগ্রেসের দ্বিতীয় অধিবেশনে 'চতুর্থ সংবিধানের সংশোধনী বিল' পর্যালোচনা করে অনুমোদন দেয়া হয়েছে। তখন থেকেই 'নাগরিকদের বৈধ ব্যক্তিগত সম্পত্তি লঙ্ঘন না করা', 'দেশে মানবাধিকারের প্রতি সম্মান ও রক্ষা করা'সহ নানা বিষয়ে সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। ২০০৭ সালের মার্চ মাসে চীনের আইন প্রণয়ন সংস্থা 'চীন গণ প্রজাতন্ত্রের সম্পত্তি আইন' অনুমোদন করে।
সংস্কার ও উন্মুক্তকরণের ৩০ বছরে চীন নিজ দেশের অবস্থার সঙ্গে খাপ খাওয়া একটি উন্নয়নের পথ বেছে নিয়েছে এবং আন্তর্জাতিক মর্যাদা ও সুনাম অর্জন করেছে। ১৯৯৭ সালের দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার আর্থিক সংকট, চলতি বছরের বিশ্বজোড়া আর্থিক সংকট, কোরিয় উপদ্বীপের পারমাণবিক সমস্যা এবং ইরানের পারমাণবিক সমস্যাসহ বিশ্বের নানা উত্তপ্ত সমস্যায় চীনের আচরণ থেকে প্রমাণিত হয়েছে যে, চীন আন্তর্জাতিক ভূবনে একটি দায়িত্বশীল দেশে পরিণত হয়েছে।
তবে চীন উপলব্ধি করেছে যে, অগ্রগতির প্রক্রিয়ায় আরো অনেক সমস্যা রয়ে গেছে। যেমন সম্পদের অভাব, পরিবেশ দূষণ, আয় ও ব্যয়ের ভারসাম্যহীনতা ইত্যাদি। সেই জন্য চীন অর্থনীতির স্থিতিশীলতা ও দ্রুত উন্নয়ন বজায় রাখার পাশাপাশি সম্পদ সাশ্রয় ও পরিবেশ-সহায়ক সমাজ স্থাপনের প্রস্তাব উত্থাপন করেছে। ভবিষ্যতের দিকে তাকিয়ে চীন অব্যাহতভাবে নিজের পথে এগিয়ে যাবে। (ইয়ু কুয়াং ইউয়ে) |