v চীনের বিশ্ব কোষv চীন আন্তর্জাতিক বেতারv বাংলা বিভাগ
হোপেই প্রদেশে সিছুয়ান দুর্গত অঞ্চলের শিশুদের আনন্দ জীবন
2008-09-26 17:18:01

    প্রতি বছর ১ সেপ্টেম্বর হচ্ছে চীনের মাধ্যমিক ও প্রাথমিক স্কুলের নতুন শিক্ষা বর্ষ শুরুর দিন। এ দিন শিশুরা আনন্দচিত্তে স্কুল ব্যাগ নিয়ে স্কুলে গিয়ে লেখাপড়ার জীবন আবার শুরু করে। এ বছর ১২ মেতে চীনের সিছুয়ানের ভয়াবহ ভূমিকম্পে স্থানীয় অনেক শিশুরা হঠাত্ করে নিজেদের স্কুল হারিয়ে ফেলে।

    ভূমিকম্পের পর হোপেই প্রদেশের থাংশান শহরের ইয়ুথিয়েন জেলার কৃষক সোং চি ইয়ো ভূমিকম্পের ত্রাণ ও উদ্ধার দলে যোগ করেন। তিনি অন্যান্য স্বেচ্ছাসেবকদের সঙ্গে সিছুয়ান দুর্গত অঞ্চলে যান। সিছুয়ানের আন জেলায় তিনি স্কুলের ধ্বংস স্তুপ দেখেছেন। শিশুরা যত তাড়াতাড়ি সম্ভব স্কুলে ফিরে গিয়ে আবার লেখাপড়া শুরু করতে চায়। তখন থেকেই সোং চি ইয়ো দুর্গত অঞ্চলের কিছু শিশুকে নিজের জন্মস্থান হোপেই প্রদেশে নিয়ে লেখাপড়া করানোর পরিকল্পনার কথা ভাবেন। তিনি ইয়ুটিয়ান জেলার ইনহো মাধ্যমিক স্কুলের সঙ্গে এ পরিকল্পনার কথা বলেন এবং সঙ্গে সঙ্গে স্কুল পক্ষের সম্মতি পান। স্কুলটি দুর্গত অঞ্চলের ছাত্রছাত্রীদের জন্য সকল শিক্ষা, থাকা ও খাওয়ার ফি মকুফ করার সিদ্ধান্ত নেয়। থাংশান শহর ও ইয়ুটিয়ান জেলা সরকারও সোং চি ইয়োকে সমর্থন করে এবং শিশুদের জীবনযাপনের খরচ সরকার বহন করবে বলে প্রতিশ্রুতি দেয়।

    এভাবে নিজের ইচ্ছা মতো দরখাস্ত করার মাধ্যমে ১৬ জুন সোং চি ইয়ো দুর্গত আন জেলার ২৪৬ জন ছাত্রছাত্রীদেরকে ইনহো মাধ্যমিক স্কুলে নিয়ে যান। এ সব ছাত্রছাত্রীরা ইতোমধ্যেই হোপেই প্রদেশে তিন মাস সময় কাটিয়ে দিয়েছে। এখানে তাদের কেমন জীবনযাপন করছে? শ্রোতাবন্ধুরা, আমাদের সংবাদদাতার সঙ্গে ইনহো মাধ্যমিক স্কুলে গিয়ে দুর্গত অঞ্চল থেকে আসা ছাত্রছাত্রীদের দেখে যান।

    ইনহো মাধ্যমিক স্কুলের প্রাথমিক বিভাগের ক্লাসরুমে আমাদের সংবাদদাতা দেখেছেন, শিশুরা মনোযোগ সহকারে ক্লাস করছে। কেউ কেউ ইংরেজী ক্লাস শুনছে। কেউ কেউ চীনা ভাষার ক্লাস শুনছে। চীনা ভাষা, গণিতবিদ্যা, ইংরেজী ও সংগীতসহ মৌলিক ক্লাস ছাড়াও এই স্কুলে আরো অনেক রকম ক্লাস আছে। চতুর্থ শ্রেণীর ছাত্র লি জুন সংবাদদাতাকে বলেছে, 'এখানে সব ধরনের ক্লাস আছে। খেলার সময়ও প্রচুর। আমি এখানে টাইপ করা, ভাস্কর্য ও গণিতবিদ্যা শিখছি।'

    আরেকজন ছাত্র লি হোং মেই এখানে ক্লাস করতে খুব পছন্দ করে। সে সংবাদদাতাকে বলেছে, 'আমি এ ক্লাসগুলো খুব পছন্দ করি। এ ক্লাসগুলোয় শিক্ষকদের কথা শুনে আমাদের মন খুব উত্ফুল্ল থাকে।'

    শিশুদের বৈচিত্র্যপূর্ণ ক্লাস বিন্যাস করার জন্য শিক্ষকরা নানা ধরনের চেষ্টা করেছেন। ইনহো মাধ্যমিক স্কুলের প্রাথমিক বিভাগের প্রধান ম্যাডাম লি ছুই লিং সংবাদদাতাকে বলেন, 'শিশুরা খুব বুদ্ধিমান এবং চঞ্চল। আমরা ক্লাসের ব্যবস্থা করার সময় শিশুদের বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে বিবেচনা করেছি। আমি সার্বিক ক্রীড়া তত্পরতারও আয়োজন করেছি। এভাবে ছাত্রছাত্রীদের শারীরিক গুণগত মান উন্নত করা যায়। এর পাশাপাশি একোর্ডিয়ান, সংগীত, কম্পিউটার, কারু শিল্প, কাগজ কাটা এবং ইংরেজী গানসহ নানা ক্লাস আছে। তা ছাড়া চীনা ও ইংরেজী পাঠ ও বক্তৃতা সংক্রান্ত প্রতিযোগিতারও আয়োজন করা হয়। আমরা ছাত্রছাত্রীদের বিভিন্ন বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী কর্মসূচী ও তত্পরতার ব্যবস্থা করি।'

    ম্যাডাম লি'র ব্যাখ্যা শুনে আমরা বুঝতে পারি, ইনহো মাধ্যমিক স্কুল শিশুদের শিক্ষার ক্ষেত্রে সত্যি বেশ মনোযোগ দিয়েছে। তা নাহলে শিশুদের এ স্কুল এত পছন্দ হতো না।

    পঞ্চম শ্রেণীর ছাত্রী সু দান এখানকার শিক্ষা জীবন বেশ ভাল লাগে জানিয়ে সে বলেছে, 'খেলার জন্য অনেক সময় আছে। শিক্ষার জন্যও প্রচুর সময় পাই। আমি মনে করি, এ রকম খেলার পাশাপাশি লেখাপড়া করা খুব ভালো পদ্ধতি। আমি এখানে থাকতে খুব পছন্দ করি।'

    ভালোভাবে ছাত্রছাত্রীদের লেখাপড়ার ব্যবস্থা করার পাশাপাশি ইনহো মাধ্যমিক স্কুলের শিক্ষকরা দুর্গত অঞ্চলের শিশুদের ভালোভাবে থাকা, খাওয়া এবং পড়ার জন্যও বহু চেষ্টা চালিয়েছেন। শিক্ষক সুন চিং ওয়েই শিশুদের জীবন যাপনের দায়িত্ব বহন করেন। তিনি সংবাদদাতাকে বলেন, 'কাপড়ের দিকে আমরা কড়া নিয়ম মেনে চলি। সিছুয়ানের ছাত্রছাত্রীরা আসার পর তাদেরকে দেয়া প্রতিটি কাপড় পুরোপুরি নতুন। খাওয়ার দিকেও ভালো ব্যবস্থা করেছি। প্রতি দিন তরমুজ, পীচ, মুরগীর পা সরবরাহ করি। আমরা বিশেষ করে সিছুয়ান থেকে বাবুর্চি নিয়োগ করে সিছুয়ানের ছাত্রছাত্রীদের জন্য স্থানীয় খাবার রান্না করছি। ফলে এখানকার খাবার শিশুদের কাছে খুব সুস্বাদু।'

    শিশুরা খুব ছোট, ছোটদের বয়স মাত্র আট, নয় বছর। বড়দের বয়সও ১১, ১২ বছর মাত্র। ভূমিকম্পের কারণে তারা প্রথম বারের মতো জন্মস্থান ত্যাগ করেছে এবং প্রথম বারের মতো বাবা-মা ত্যাগ করেছে। ফলে সিছুয়ান থেকে হোপেই প্রদেশে আসার প্রথম দিকে প্রায়শই নিজের বাসার কথা মনে পড়ে তারা খুব দুঃখ পেতো। সেই সময় ইনহো মাধ্যমিক স্কুলের প্রতিটি শিক্ষক তাদের বাবা-মার ভূমিকা পালন করেন। স্কুলের প্রধান লি ছুন লিং সংবাদদাতাকে বলেন, 'সিছুয়ানের শিশুরা আমাদের এখানে এসেছে। আমরা নিজেদের ছেলে মেয়ের মতো তাদেরকে দেখাশোনা করি। যাতে তারা সুস্থ ও আনন্দে থাকে। আমরা যে কোন সময় তাদের পাশে আছি। আমরা কেবল শিক্ষকের দায়িত্ব পালন করি তা নয়, বরং বাবা-মার দায়িত্বও বহন করি। সত্যি সত্যি নিজের সন্তানকে আদর করার মতো তাদেরকে ভালোবাসা দিচ্ছি। ছাত্রছাত্রীরা খুশি হলে আমরাও শান্তি পাই।'

    শিশুরা সিছুয়ান থেকে আসছে বলে তাদের খাওয়ার অভ্যাস হোপেইবাসীদের চেয়ে ভিন্ন। যেমন সিছুয়ানের অধিবাসীরা ঝাল খেতে পছন্দ করেন। লিউ ইয়ো লিয়াং হচ্ছেন ইনহো মাধ্যমিক স্কুলের প্রধান বাবুর্চি। শিশুদের ভালো করে খাওয়ানোর জন্য প্রতি সপ্তাহে তিনি গভীর চিন্তা করে পুরো সপ্তাহের খাবারের তালিকা নির্ধারণ করেন। তিনি বলেন, 'সকালের নাস্তায় কেক, রুটি, পাঁউরুটি, সসেজ ও দুধ আছে। দুপুরের খাবারের মধ্যে অবশ্যই একটি সিচুয়ানের ডিশ আছে। দুপুর ও রাতের প্রধান খাদ্য হচ্ছে ভাত। প্রতিদিন মরিচ তেল ও মরিচ সস আছে। শিশুরা যা খুশি, তা খেতে পারে।'

    দুপুরে খাওয়ার সময় হলেই আমরা ডাইনিং হলের সরগরম আওয়াজ শুনতে পাই। তা শুনে বুঝা যায়, তারা ভালোভাবে খাচ্ছে।

    সংবাদদাতা জিজ্ঞেস করেছেন, আজ দুপুরের খাবার কী আছে?

    শিশুরা উত্তর দিয়েছে, ডাম্প্লিং।

    সংবাদদাতা আবার প্রশ্ন করেছেন, তুমি কয়টি ডাম্প্লিং খেয়েছো? এর স্বাদ কেমন?

    তারা উত্তর দিয়েছে, দশ বারোটি খেয়েছি। খুব সুস্বাদু।

    প্রতিটি শিশুই হোপেইতে ভালো করে খেতে পারে, ভালো করে লেখাপড়া করতে পারে এবং ভালো করে খেলতে পারে। তারা বলে, এ স্থান হচ্ছে তাদের উষ্ণ বাড়ি।

    সোং চি উয়ো শিশুদেরকে সিছুয়ান থেকে হোপেই নিয়ে আসার পর এখন তাদের প্রধান অভিভাবক হয়েছেন। তিনি প্রতি দিন ক্লাসরুম, আবাসিক হল ও ডাইনিং হল বেশ কয়েকবার ঘুরে দেখেন। শিশুদের যে কোন ছোট খাটো ব্যাপার তাঁর চোখে পড়লেই তিনি দ্রুত তার সমাধান করেন। যাতে শিশুদের লেখাপড়া ও জীবনের ওপর কোন প্রভাব না পড়ে।

    শিশুরা ইনহো মাধ্যমিক স্কুলে আসার পর থাংশান শহর ও ইয়ুটিয়ান জেলা সরকার ও সমাজের বিভিন্ন মহলের ব্যক্তি তাদের ওপর মনোযোগ দিয়েছে। কিছু দিন আগে থাংশান পৌর সরকার শিশুদের জীবনযাপন নিশ্চিত করার জন্য ২০ লাখ ইউয়ান বরাদ্দ করেছে। আরো অনেক শিল্প প্রতিষ্ঠান আর্থিক সাহায্য দিয়েছে। অনেক দয়ালু মানুষ শিশুদের সান্ত্বনা দেয়ার জন্য কাপড় ও খাবার উপহার দিয়েছেন। এ সব সোং চি ইয়োকে বেশি করে উত্সাহ দিয়েছে। তিনি শিশুদের জীবনকে সয্ত্নে রাখার ব্যাপারে আশাবাদী। তিনি বলেন, 'আমি নিজে শিশুদের নিয়ে এসেছি। আমি মনে করি, তাদের জন্য কিছু কাজ করা তাত্পর্যপূর্ণ। অনেক মানুষ তাদের ওপর নজর রাখছে। ফলে তাদেরকে ভালোভাবে দেখাশোনার ক্ষেত্রে আমরা সবাই আস্থাবান।'

    পরিকল্পনা অনুযায়ী, শিশুরা ইনহো মাধ্যমিক স্কুলে দেড় বছর লেখাপড়া করবে। আগামী বছরের দ্বিতীয়ার্ধে সিছুয়ান প্রদেশের স্কুল পুনর্নিমাণের পর তারা হোপেই ত্যাগ করে আবার জন্মস্থানে ফিরে যাবে। (ইয়ু কুয়াং ইউয়ে)

  • সাক্ষাত্কার
  • সর্বশেষ সংবাদ
  • অন-লাইন জরীপ
     
    © China Radio International.CRI. All Rights Reserved.
    16A Shijingshan Road, Beijing, China