ভাইরাসে আক্রান্ত হবার পর সুস্থ হয়ে ওঠা এক তরুণীর গল্প
  2020-03-02 14:10:19  cri

 


৮ ফেব্রুয়ারি বিকেলে, লি লিনলিন হ্য নান প্রদেশের লু শান জেলার পিপলস সংক্রামক রোগ হাসপাতাল থেকে বের হন। অনেক দিন পর তিনি প্রথমবারের মতো তাজা বাতাসে শ্বাস নেন।

নভেল করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হবার পর তিনি হাসপাতালের ওয়ার্ডে চাঞ্চল্যকর ১৭টি দিন কাটিয়েছেন। এর মধ্যে তিনি শ্বাসকষ্টে পড়েছেন এবং মারা যাবেন—এই আশঙ্কা থেকে একটি চিরবিদায় ভিডিও-ও তৈরি করেন। তবে, তিনি তার জেলার নভেল করোনাভাইরাসে আক্রান্ত রোগীদের মধ্যে প্রথম সুস্থ হয়ে ওঠেন। ভাইরাসের বিরুদ্ধে তার লড়াইয়ের কথা স্মরণ করে এই তরুণী বলেন, 'আমার বয়স মাত্র ২৪ বছর। আমার পরিবার আমার জন্য অপেক্ষা করছে। আমি হাল ছেড়ে দিতে পারি না।'

লি লিনলিন উহান বিশ্ববিদ্যালয়ের চিকিত্সা বিজ্ঞানের স্নাতকোত্তর পর্যায়ের ছাত্রী। যখন তার জ্বর হয় তখন তাকে আলাদা ওয়ার্ডে ভর্তি করা হয়। এসময় তিনি আতঙ্কিত ও অসহায় বোধ করেন। কেন আমি এ ভাইরাসে আক্রান্ত হলাম?—এই প্রশ্নটি তার মনে বার বার জাগতে থাকে।

১৬ জানুয়ারি তার শরীরে ভাইরাসে আক্রান্তের লক্ষণ ফুটে উঠতে থাকে। তিনি ও কয়েকজন সহপাঠি একসাথে খাবার খেয়েছিলেন সেদিন। পরে তার অসুস্থ লাগতে শুরু করে। নিজের শরীরের তাপমাত্রা মেপে দেখেন ৩৭.২ ডিগ্রি সেলসিয়াস। তিনি ভাবলেন, হয়ত বেশি খাওয়ার কারণে অসুস্থ লাগছে। তিনি কখনও নভেল করোনাভাইরাসে কথা ভাবেননি। কারণ, তখন প্রকাশিত কেস মাত্র দশ/বারোটি এবং তিনি কখনও ওই সিফুড বাজারে যাননি।

তারপর কয়েকদিন, তার কোন লক্ষণ নেই। তিনি ফিরে যান হ্য নান লু শান জেলায় তার বাসায় এবং আগের মতো বসন্ত উত্সবের জন্য প্রস্তুতি নিতে থাকেন। ২৩ জানুয়ারি দুপুরে তিনি কিছু চাওজি খাবার পর আবার অসুস্থ বোধ করতে শুরু করে। জ্বর হয় এবং ঠান্ডা লাগে। পেশীতে ব্যথাও লাগে। তিনি ভয় পান। তখন দেশব্যাপী সনাক্ত রোগীর সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৫৭১টিতে। তিনি নিজেও এ ভাইরাস আক্রান্ত হবার আশঙ্কায় পড়েন। তিনি বাইরে যাওয়া বন্ধ করে দিলেন এবং নিজেকে পর্যবেক্ষণ করা শুরু করলেন।

তার শরীরের তাপমাত্রা বাড়তে লাগলো। তার কফ দেখে তার চিকিত্সক তাকে জানান, তার নিশ্চয় বড় সমস্যা আছে। তিনি নিজেকে শান্ত করেন। তিনি কফ পরিষ্কার করেন এবং তার পরিবারকে বলেন, কেউ যেন তার ব্যবহৃত কিছু স্পর্শ না-করে। সবাইকে তিনি মাস্ক পরতে বলেন। তারপর তিনি নিজে ১২০ (জরুরি ফোন) নম্বরে ফোন করেন এবং জানান তিনি নভেল করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে থাকতে পারেন।

চিকিত্সা বিজ্ঞানে একটি শব্দ আছে 'নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া প্রভাব'। তার মানে নিজের অবস্থা গুরুতর ভাবলে শরীর বেশি অসুস্থ হবে। অ্যাম্বুলেন্সে লি লিনলিনের শরীরের তাপমাত্রা আরও বাড়ে এবং তিনি বমি করেন। এমনকি, তিনি তখন এতোটা সচেতন ছিলেন যে, পলিথিনে বমি সংগ্রহ করে নিরাপদ স্থানে পরে ফেলে দেন।

লি লিনলিন এ জেলার প্রথম জন হিসেবে বিছিন্ন ওয়ার্ডে ভর্তি হন। প্রথম দিন তার সব পরীক্ষা করা হয়। সিটি, রক্ত পরীক্ষা এবং নভেল করোনাভাইরাসের পরীক্ষা। রাতে তার নভেল করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হওয়া সম্পর্কে চিকিত্সকরা নিশ্চিত হন।

ভাইরাসে আক্রান্ত হবার বিষয়টি সম্পর্কে নিশ্চিত হবার পর তিনি নিজেকে শান্ত রাখেন। চিকিত্সা বিজ্ঞানের ছাত্রী হিসেবে তিনি জানেন তাকে কী করতে হবে। তিনি চিন্তা করেন, তার সহপাঠিদের মধ্যেও কেউ কেউ আক্রান্ত হতে পারেন। হাসপাতালে ভর্তি হবার দ্বিতীয় দিন চীনের ঐতিহ্যিক উত্সব বসন্ত উত্সব। তিনি আশা করেন, নতুন বর্ষে সব ভাল হবে। তবে আসল অবস্থা অন্য রকম। রাত ১২টায় হঠাত করে তার শ্বাস ও হৃত্স্পন্দন দুর্বল হয়। তিনি জানান, তিনি অক্সিজেনের ঘাটতি টের পাচ্ছেন। উত্তেজনাসংকুল হলে অবস্থা গুরুতর হবে। তিনি শান্ত থাকার চেষ্টা করেন, পাশাপাশি নার্সকে ডাক দেন।

সবচেয়ে কষ্টের সময়ে, শ্বাস নেওয়ার চেষ্টা করেও তিনি অক্সিজেন ফুসফুসে নিতে ব্যর্থ হচ্ছিলেন। তিনি দেখেন নিজের হাত ও পায়ের রঙ পরিবর্তিত হয়েছে, শরীরের তাপমাত্রা দ্রুত হ্রাস পাচ্ছে। প্রথম বারের মতো তিনি ভাবেন, তিনি মারা যাচ্ছেন।

লি লিনলিন স্মরণ করে বলেন, তখন তিনি নিজেকে বার বার বলছিলেন, 'ঘুমানো যাবে না। ঘুমালে শ্বাস নিতে ভুলে যাব।' তিনি অক্সিজেন নেওয়ার চেষ্টা করতে থাকেন এবং শরীরের তাপমাত্রা ধরে রাখতে পা-হাত একটু নাড়াতে থাকেন। পাশাপাশি তিনি ২০ মিনিটের একটি চিরবিদায় ভিডিও তৈরি করে ফেলেন। তিনি চাইছিলেন মৃত্যুর আগে নিজের পরিবার ও বন্ধুদের কাছ থেকে বিদায় নিতে।

চিকিত্সকরা তার পাশে থেকে তাকে উত্সাহ দিতে থাকেন। কয়েক ঘন্টা পর, তার শরীরের তাপমাত্রা একটু বাড়ে। কিন্তু তিনি ঘুমাতে পারছিলেন না। ভোরে তিনি নিজে নিজে শ্বাস নিতে পারছিলেন। লি লিনলিন বলেন, 'তখন আমি ভাবলাম, আমার বয়স মাত্র ২৪, আমি হাল ছেড়ে দিতে পারি না। আমার পরিবারের অনেক আশা আমাকে নিয়ে।' তিনি বিশ্বাস করেন, চিকিত্সা তার জন্য গুরুত্বপূর্ণ তবে আত্মবিশ্বাস ও নিজের ওপর নির্ভরতা তারচেয়েও বেশি গুরুত্বপূর্ণ।  

লি লিনলিনের অবস্থা দিন দিন ভাল হতে থাকে। তার শরীরের তাপমাত্রা স্বাভাবিক হতে থাকে এবং ফুসফুসের প্রদাহ ধীরে ধীরে অদৃশ্য হয়ে যায়। আলাদা ওয়ার্ডে থাকার সময় তিনি স্বজনদের সান্ত্বনা দেন। হাসপাতালে ভর্তি হবার প্রথম দিন তিনি ৭টি নোট লেখেন এবং তার পরিবারের সবাইকে নিজ নিজ বাসায় স্বতন্ত্র থাকতে বলেন। তার পরিবারের মধ্যে কেবল তার মা আক্রান্ত হন এবং এখন প্রায় সুস্থ হবার পথে।

পাশাপাশি, তিনি তার সামাজিক মিডিয়া প্ল্যাটফর্মে ভাগাভাগি করেন মহামারী মোকাবিলার উপায়। একজন চিকিত্সা বিজ্ঞানের ছাত্রী হিসেবে পেশাদার পরামর্শ দেন তিনি। তিনি একজন রোগী, তবে অনেক বন্ধু তার সঙ্গে কথা বলার মাধ্যমে সাহস ও শক্তি পায়।

লি লিনলিন বলেন, 'আশা করি সবাই মনের জোর ধরে রাখবেন। এ রোগ ভয়াবহ নয়। তবে, একে পরাজিত করতে চাইলে ইচ্ছাশক্তি খুব গুরুত্বপূর্ণ। আমি যদি পারি অন্যরাও পারবে।'

ভাইরাসের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে লি লিনলিনের দৃঢ় ইচ্ছা দেখে অনেক মানুষ তাকে জানান শ্রদ্ধা। তবে লি লিনলিন বলেন, 'চিকিত্সক ও নার্স এবং মহামারী নিয়ন্ত্রণকাজে জড়িত মানুষদেরকে জানাতে চাই ধন্যবাদ। তারা আসলে এ যুদ্ধের সৈনিক।'

হাসপাতালে থাকার সময়ে, তিনি একটি নোটে লেখেন যে, একটি বিশেষ ওষুধ এ রোগে কার্যকর। তিনি হাসপাতালকে এটা জানান এবং দু'ঘন্টার মধ্যে এ ওষুধ হাসপাতালে পাঠানো হয়। পরে তিনি শুনেছেন, তিনি হাসপাতালে ভর্তি হবার পরপরই জেলায় একটি জরুরি সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। সামগ্রী ও ওষুধ সরবরাহ করতে আপ্রাণ চেষ্টা করার নির্দেশ দেয়া হয়।

লি লিনলিন বলেন, অল্প এ ১৭ দিনে তিনি জীবন নিয়ে বেশ চিন্তা করেন। চিকিত্সা বিজ্ঞানে পড়াশোনা শেষ করে তিনিও সামনে থেকে রোগ-বালাইয়ের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে নামবেন।


1  2  
© China Radio International.CRI. All Rights Reserved.
16A Shijingshan Road, Beijing, China. 100040