চীনের মূল ভূভাগে পড়াশোনা করছে ম্যাকাওয়ের যেসকল তরুণ-তরুণী
  2019-12-27 18:03:57  cri

 


গত ২০ ডিসেম্বর বিভিন্ন অনুষ্ঠানের মাধ্যমে পালিত হয়েছে ম্যাকাওয়ের চীনের মূল ভূভাগে ফিরে আসার ২০তম বার্ষিকী। গত ২০ বছরে ম্যাকাও ও মূল ভূভাগের মধ্যে বিনিময় অনেক বেড়েছে। শিক্ষাখাতেও এর ব্যতিক্রম হয়নি। বর্তমানে ম্যাকাওয়ের অনেক তরুণ-তরুণী মূল ভূভাগে পড়াশোনা করছেন। আজকে আপনাদের সেসব তরুণ-তরুণীর গল্প শোনাবো।

২০ বছর আগে, হাও নদীর পাশে মূল ভূভাগের অধীনে ফিরে আসতে পেরে, ম্যাকাওয়ের বাসিন্দারা আনন্দিত হয়েছিলেন। কারণ, তারা বুঝতে পেরেছিলেন যে, বিশাল মূল ভূভাগের অংশ হিসেবে ম্যাকাও আরও সমৃদ্ধ হবে, উন্নত হবে। তাদের এই ধারণা সত্যি প্রমাণিত হয়েছে। ম্যাকাওয়ের বাসিন্দারা মূল ভূভাগের সঙ্গে অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক বিনিময়ে অনেক উপকৃত হয়েছেন এবং হচ্ছেন। বিভিন্ন ক্ষেত্রেই তারা উপকৃত হয়েছেন ও হচ্ছেন। এসব ক্ষেত্রের মধ্যে শিক্ষা একটি। গত ২০ বছরে ম্যাকাওয়ের অনেক তরুণ-তরুণী চীনের মূল ভূভাগে উচ্চশিক্ষা অর্জন করেছেন এবং এখনও অনেকে উচ্চশিক্ষা নিচ্ছেন। চীনের মূল ভূভাগে উচ্চশিক্ষাপ্রাপ্ত অনেকেই এখন প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী, সরকারি কর্মকর্তা, বা বেসরকারি উদ্যোক্তা। তাঁরা তাদের সুন্দর ভবিষ্যতের জন্য সৃষ্ট সুযোগ কাজে লাগিয়েছেন এবং তাদের পদাঙ্ক অনুসরণ করে চলেছেন ম্যাকাওয়ের আরও অনেক তরুণ-তরুণী।

১৯৯৯ সালে লিয়াং শু ইংয়ের বয়স ছিল মাত্র ২ বছর। তাঁর কাছে 'ম্যাকাওয়ের মূল ভূভাগে ফিরে আসা'-র অর্থ রাস্তাঘাটে বিশৃঙ্খলার পরিবর্তে শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা এবং তার নিজের পরিবারের আর্থিক অবস্থার উন্নতি। ২০ বছর পর মাতৃভূমির মূল ভূভাগের সঙ্গে তাঁর এখন সম্পর্ক নিবিড়। আর মাত্র ছয় মাস পর তিনি এখানকার একটি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করবেন এবং শেনচেনে জীবনের প্রথম চাকরিতে যোগ দেবেন বলে আশা করা যায়। ছিংহুয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের স্থাপত্যকলা বিভাগের পঞ্চম বর্ষের শিক্ষার্থী তিনি। তিনি হংকং-ম্যাকাও-কুয়াংতুং বৃহত্তর উপসাগর এলাকার ভবিষ্যত নিয়ে আশাবাদী। তাই স্নাতক ডিগ্রি নেওয়ার পর মূল ভূভাগের শেনচেনে চাকরি করতে চান। একজন মেয়ে হিসেবে এটা তার জন্য তাত্পর্যপূর্ণ একটি সিদ্ধান্ত। এ সম্পর্কে লিয়াং শু ইং বলেন,

"ম্যাকাওয়ে খুব কম বিশ্ববিদ্যালয়ে স্থাপত্যকলা বিভাগ রয়েছে। চীনের মূল ভূভাগে সে সমস্যা নাই। তা ছাড়া, মূল ভূভাগের শহরগুলোতে স্থাপত্যসংশ্লিষ্ট শিল্পপ্রতিষ্ঠান ও ইনস্টিটিউটের সংখ্যা অনেক বেশি। এখানে চাকরি করা ভবিষ্যতের জন্য ভালো।"

ছিংহুয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করাও ছিল লিয়াং শু ইংয়ের ছোটবেলার স্বপ্ন। এ বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ তাঁর বেশ ভালো লাগে। তিনি জানান, তাঁর সহপাঠীরা তাঁর পূর্বধারণার চেয়ে বেশি মেধাবী ও প্রাণচঞ্চল। তিনি বলেন,

"এখানকার প্রতিটি দিনই আমার জন্য মজার। এখান থেকে আমি নিজের সুন্দর জীবনের গল্প রচনা করতে চাই।"

গত শতাব্দীর নব্বইয়ের দশকে চীনের মূল ভূভাগের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ম্যাকাওয়ের শিক্ষার্থীদের বিনা পরীক্ষায় ভর্তির সুযোগ দেওয়া হয়। ম্যাকাওয়ের অনেক শিক্ষার্থী সে-সুযোগ গ্রহণ করেন। গত ২০ বছরে তাই ম্যাকাওয়ের অনেক শিক্ষার্থী মূল ভূভাগে এসেছেন উচ্চশিক্ষার জন্য। চীনের উপ-শিক্ষামন্ত্রী থিয়ান স্যুয়ে জুন জানান, চলতি বছর মূল ভূভাগে ম্যাকাও থেকে আসা শিক্ষার্থীর সংখ্যা ৬৩০০ জনেরও বেশি। এর মধ্যে নতুন ভর্তি হয়েছে আড়াই হাজার, যা একটি নতুন রেকর্ড।

মূল ভূভাগে পড়াশোনার সিদ্ধান্ত প্রসঙ্গে ১৮ বছর বয়সী ম্যাকাও যুবক হো ওয়ে খাই পিতা-মাতার ব্যাপক প্রশংসা করলেন। পিকিং বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অনার্সের শিক্ষার্থী হো বলেন,

'আমার পিতামাতা মনে করেন ম্যাকাও-হংকং-কুয়াংতুং বৃহত্তর উপসাগর এলাকার ভবিষ্যত উজ্জ্বল। তাই তাঁরা আমাকে মূল ভূভাগে পড়াশোনা করতে পাঠান। স্নাতক ডিগ্রি অর্জনের পর মূল ভূভাগে চাকরির সুযোগও বেশি।"

যদিও মাত্র ২ মাস ধরে পড়াশোনা করছে, তবে আত্মবিশ্বাস তুঙ্গে হো ওয়ে খাই-এর। তিনি বলেন, "আমার ম্যান্ডারিন মোটামুটি মানের। অন্যান্য দিক দিয়ে আমার সঙ্গে মূল ভূভাগের সহপাঠীদের তেমন কোনো পার্থক্য নেই।"

যুবক হো ওয়ে খাইয়ের সঙ্গে একটি ঘর শেয়ার করেন আরও তিন জন শিক্ষার্থী। তাদের জন্মস্থান মূল ভূভাগের সিনচিয়াং, আনহুই, ও সিছুয়ান। ম্যাকাও থেকে আসা শিক্ষার্থীদের মূল ভূভাগের জীবনযাপনে অভ্যস্ত করতেই এমন ব্যবস্থা নিয়েছে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। এ সম্পর্কে হো বলেন,

"ম্যাকাওয়ে উচ্চবিদ্যালয়ে আমার পড়াশোনার মাধ্যম ছিল ইংরেজি। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার মাধ্যম চীনা ভাষা। তাই গণিতসহ বিভিন্ন বিষয়ের ক্লাসে শিক্ষকের লেকচার বুঝতে আমার সমস্যা হয়। তবে, আমার সহপাঠী ও শিক্ষকরা আমাদের সাহায্য করেন। আমি তাঁদের কাছে কৃতজ্ঞ।"

শিক্ষার জন্য হোক, বা কর্মসংস্থানের জন্য হোক, ম্যাকাওয়ের অনেক তরুণ-তরুণীর স্বপ্ন ও ভবিষ্যত এখন মূল ভূভাগের সাথে সংযুক্ত। ম্যাকাওয়ের আশেপাশে, পার্ল নদীর বদ্বীপ এলাকায়, ম্যাকাওয়ের তরুণ-তরুণীরা কাজ করতে বেশি পছন্দ করে। চলতি বছর 'কুয়াংতু-ম্যাকাও-হংকং বৃহত্তর উপসাগর এলাকা উন্নয়ন কার্যক্রম' চালু হবার পর এখন এতদঞ্চল ম্যাকাওবাসীদের গুরুত্বপূর্ণ কর্মসংস্থানের ঘাঁটিতে পরিণত হয়েছে।

ম্যাকাওয়ের যুবক চেং চি তা সম্প্রতি অনেক ব্যস্ত সময় কাটিয়েছেন। নভেম্বর মাসে আয়োজিত দ্বিতীয় চীন আন্তর্জাতিক আমদানি মেলায় অনেক ব্যবসা-অনুষ্ঠানে যোগ দেন তিনি। বর্তমানেও তিনি নতুন নিবন্ধিত ফ্যাশন ডিজাইন কোম্পানির কাজে ব্যস্ত। এ সম্পর্কে তিনি বলেন, মূল ভূভাগের মেলায় অংশগ্রহণের ব্যাপারে তিনি অনেক আগ্রহী ছিলেন। কারণ, এর মাধ্যমে অনেক ব্যবসায়ীর সঙ্গে পরিচিত হবার সুযোগ হয় এবং ক্ষুদ্র কোম্পানির উন্নয়নেও এই মেলা সহায়ক। আমদানি মেলায় তিনি কয়েকজন ব্যবসায়ীর সঙ্গে সহযোগিতা নিয়ে আলোচনা করেছেন, যা নতুন বছরে নিজের ব্র্যান্ডের কাপড়চোপড় বিক্রিতে সহায়ক হবে।

মূল ভূভাগের ডিজাইন শিল্পে উন্নয়নের সম্ভাবনা বিপুল। তাই চেং চি তা হেংছিনে কোম্পানি স্থাপনের সিদ্ধান্ত নেন। কারণ, হেংছিনে বহু সুবিধাজনক নীতি চালু হয়েছে। যদিও তাঁর কোম্পানিতে মাত্র ৫/৬ জন কর্মী, তবে নিজের কোম্পানির উন্নয়নে চেষ্টা করবেন চেং।

চেং চি তা মূল ভূভাগে ব্যবসা চালু করার পর তাঁর বন্ধুদের কেউ কেউ এখানে ব্যবসা করতে আগ্রহ দেখাতে শুরু করেন। এ সম্পর্কে চেং বলেন, "হেংছিনে আমার কোম্পানি চালু করা যেন ম্যাকাওয়ের এক ব্লক থেকে অন্য ব্লকে যাওয়া।"

চেং চি তা'র মতো ম্যাকাও বাসিন্দা লি হান ছেং এবং লিন মিং সেন চলতি বছর চুহাই শহরে টেনিস প্রশিক্ষণ সংস্থা চালুর সিদ্ধান্ত নেন। তাদের প্রশিক্ষণ সংস্থা সম্পর্কে জনাব লিন মিং সেন বলেন, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে চুহাইতে অনেক কমিউনিটি পার্ক নির্মিত হয়েছে। স্থানীয়দের মধ্যে খেলাধুলায় আগ্রহ অনেক বেড়েছে। পাশাপাশি, আন্তর্জাতিক টেনিস প্রতিযোগিতাও বহু বছর ধরে এখানে আয়োজিত হয়ে আসছে। তাই চুহাইতে টেনিসের ব্যাপারে আগ্রহীর সংখ্যা বেশি। এ সুযোগ কাজে লাগিয়ে নতুন বছরের ফেব্রুয়ারিতে এ টেনিস প্রশিক্ষণ সংস্থা কাজ শুরু করবে।

পরিসংখ্যান অনুসারে, চলতি বছরের অক্টোবর পর্যন্ত চুহাই শহরের হেংছিন অবাধ বাণিজ্য এলাকায় নতুন নিবন্ধিত ম্যাকাওয়ের শিল্পপ্রতিষ্ঠানের সংখ্যা ছিল প্রায় ৫০০টি এবং ম্যাকাও ও হংকংয়ের মোট শিল্পপ্রতিষ্ঠানের মোট সংখ্যা ছিল ৩০০০টিরও বেশি।

চীনের কেন্দ্রীয় সরকার হংকং ও ম্যাকাওয়ের উন্নয়নে ব্যাপক সমর্থন দিচ্ছে। ম্যাকাওয়ের তরুণ-তরুণীদের জন্য তাই ব্যাপক সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। এ সম্পর্কে লি হান ছেং বলেন, নিজের উদ্যোগে কোম্পানি চালু করার ইচ্ছা থাকলে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ম্যাকাও থেকে চুহাইতে আসা উচিত।

২১ বছর বয়সী ম্যাকাও-কন্যা কান হুই শান নানচিং নর্মল বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থী। তিনি চিয়াংসু প্রদেশে ম্যাকাও শিক্ষার্থী ফেডারেশনের মহাপরিচালক। ম্যাকাওয়ের শিক্ষার্থীদের মধ্যে মূল ভূভাগ সম্পর্কে জানাশোনা বাড়ানো এবং মাতৃভূমির প্রতি তাদের ভালোবাসা বাড়াতে ব্যাপক প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন তিনি। চলতি বছর ম্যাকাওয়ের মূল ভূভাগে ফিরে আসার ২০তম বার্ষিকী। এ উপলক্ষ্যে লেখা সংগ্রহ ও ফটোগ্রাফি প্রতিযোগিতাসহ নানান অনুষ্ঠান আয়োজন করে তার সংস্থা। তিনি বলেন, তার মাধ্যমে মূল ভূভাগে পড়াশোনা সম্পর্কে ম্যাকাওয়ের শিক্ষার্থীরা ভালোভাবে জানবে এবং চীনের ইতিহাস-ঐতিহ্য সম্পর্কে আরও সচেতন হবে বলে তিনি আশা করেন। স্নাতক ডিগ্রি নেওয়ার পর ম্যাকাও ফিরে যাবেন নাকি মূল ভূভাগে চাকরি নিয়ে থেকে যাবেন—এখনও চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেননি তিনি। তবে, মাতৃভূমি ও ম্যাকাওয়ের সুন্দর ভবিষ্যত কামনা করতে ভোলেননি তিনি।


1  2  
© China Radio International.CRI. All Rights Reserved.
16A Shijingshan Road, Beijing, China. 100040