চীনে কর্মরত বাংলাদেশি ড.কিশোর বিশ্বাসের জীবনযাপন
১৯ বছর আগে বাংলাদেশ থেকে এইচএসসি পাস করার পর চীন সরকারের বৃত্তি নিয়ে বেইজিংয়ে লেখাপড়া করতে আসেন বাংলাদেশি শিক্ষার্থী কিশোর বিশ্বাস। তখন তিনি অবশ্য ভাবেন নি যে, একদিন তিনি চীনেই শুরু করবেন তার জীবনযাপন। তিনি একজন চীনা মেয়েকে ভালোবেসে বিয়ে করেছেন, তাদের এখন একজন সন্তান রয়েছে। বাংলাদেশ ও চীনের মৈত্রীর উন্নয়নে ভূমিকা পালন করছেন ড. কিশোর। এখন তার জীবনের অভিজ্ঞতা নিয়ে গল্প শোনাবো।
সাক্ষাত্কালে কিশোর বলেন, তিনি আকস্মিক সুযোগে চীনে লেখাপড়া করতে আসেন। তখন বাংলাদেশের এইচএসসি পরীক্ষা শেষ করে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন তিনি। তখন তাঁর মা পত্রিকায় চীন সরকারের বৃত্তির খবর পান এবং কিশোরকে পরীক্ষায় অংশগ্রহণের কথা বলেন। এ বিষয়ে কিশোর বলেন,
'তখন আমি এ পরীক্ষাকে তেমন গুরুত্ব দেই নি,কারণ সারাদেশে শুধুমাত্র ৭ জনের সুযোগ রয়েছে, আমি ভবি যে এটি কঠিন ব্যাপার, তবে চেষ্টা করতে পারি।'
পরীক্ষায় প্রথম স্থান অর্জন করেন কিশোর, পরে তিনি চীনা দূতাবাসে সাক্ষাত্কারে উত্তীর্ণ হয়ে চীন সরকারের বৃত্তি লাভ করেন। মধ্য চীনের উহান শহরের হুয়াচুং প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে এক বছর চীনা ভাষা শেখার পর তিনি ছিংহুয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের কম্পিউটার বিভাগে ভর্তি হন এবং লেখাপড়ার বড় চাপের সম্মুখীন হন। তিনি বলেন,
'ছিংহুয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে লেখাপড়া করতে অনেক চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হই, চীনের বিভিন্ন অঞ্চলের শ্রেষ্ঠ ছাত্রছাত্রীরা এ স্কুলে ভর্তি হয়। এখানে কম্পিউটার বিজ্ঞান বিশ্ববিদ্যালয়ের সবচেয়ে আকর্ষণীয় বিভাগের অন্যতম, তাই বলা যায় চীনের সবচেয়ে শ্রেষ্ঠ ১৭০ জন শিক্ষার্থী আমাদের বিভাগে লেখাপড়া করে। তাদের তুলনায় আমি একটু দুর্বল আর তখন আমি ভাষা সমস্যারও সম্মুখীন হই। দুই সেমিস্টার চীনা ভাষা শেখার পরও ক্লাসের সব চীনা ভাষার বিষয় বুঝতে পারি না, আমার পাঠ্যপুস্তক সব চীনা ভাষায়।'
কিশোর বলেন, ছিংহুয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে লেখাপড়ার সময় তিনি বহু চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হন। ততদিনে তিনি যেসব চীনা ভাষা শিখেছেন তা দিয়ে তাঁর জীবনযাপন কাটানো সম্ভব, তবে পেশাগত বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিবিষয়ক শব্দ বোঝা সম্ভব নয়। তিনি ইংরেজি-চীনা অভিধান দিয়ে পাঠ্যপুস্তকের বিভিন্ন শব্দের অর্থ খুঁজে বের করেন, তারপর লেখাপড়া করা শুরু করেন। এভাবে চীনা শিক্ষার্থীদের চেয়ে তাকে আরো বেশি সময় দিতে হয়। অন্য দিকে ক্লাসের সহপাঠীরা অনেক চমত্কার ও মেধাবী। উন্নত গণিত ও ক্যালকুলাসসহ অনেক মৌলিক মেজর চীনা সহপাঠীদের জন্য সহজ বিষয়। এ সম্পর্কে কিশোর বলেন, তিনি অনেক কঠোর চেষ্টার মাধ্যমে ছিংহুয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে লেখাপড়া করেন। চীনা সহপাঠীদের সহায়তায় তিনি অনেক উপকৃত হন। তিনি বলেন,
'এ চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার মূল কারণ চীনা সহপাঠীদের সহায়তা। আমাদের ক্লাসে মাত্র ৫ জন বিদেশি সহপাঠী। আমি অনেক সময় দিয়ে চীনা সহপাঠীদের সাথে খাওয়া, খেলাধুলা ও হোমওয়ার্ক করি। আমার অজানা বিষয়ে তারা আমাকে সহায়তা দেয় এবং পরস্পরের কাছ থেকে ভাষা শিখি। আমি তাদের সাথে চীনা ও ইংরেজি ভাষায় কথা বলি, তারা আমাকে চীনা ভাষা বোঝায়, তাদের সহায়তায় আমি বিভিন্ন সমস্যা মোকাবিলা করি।'
ছিংহুয়া বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক হওয়ার পর কিশোর পিকিং বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মাস্টার্স ও ডক্টরেট ডিগ্রি লাভ করেন। পিকিং বিশ্ববিদ্যালয়ে লেখাপড়ার সময় ২০০৬ সালের গ্রীষ্মকালে তিনি তাঁর স্ত্রীর সাথে পরিচয় হন। কিশোর বলেন,
'তখন আমার স্ত্রী মিনজু বিশ্ববিদ্যালয়ে লেখাপড়া করে, একদিন সে আমাদের গ্রন্থাগারে বইয়ের জন্য আসে, তবে কার্ড না থাকায় গ্রন্থাগারে ঢুকতে পারে না। তাই আমি অন্য শিক্ষার্থীর কাছ থেকে কার্ড নিয়ে তাকে সহায়তা করি, পরে আমরা একসাথে ডিনার খাই। ঘনিষ্ঠ বন্ধু থেকে আমরা পরস্পরকে ভালাবেসে ফেলি, তারপর আমরা বিয়ে করি।'
পিকিং বিশ্ববিদ্যালয়ে লেখাপড়াকালে বাংলাদেশ ও চীনের সাংস্কৃতিক বিনিময়ে যুক্ত হন কিশোর। ২০০৯ সালে দ্বিতীয় 'চীনা ব্রিজ' চীনা ভাষা প্রতিযোগিতায় অংশ নেন এবং 'স্বর্ণ পদক' লাভ করেন তিনি। প্রতিযোগিতার পর চীনের ঐতিহ্যিক সংস্কৃতির গভীর চেতনা তৈরি হয় তার মধ্যে।
ডক্টরেট ডিগ্রি লাভ করার পর তিনি পিকিং বিশ্ববিদ্যালয়ের বিদেশি ভাষা একাডেমির 'এক অঞ্চল, এক পথ' প্রকল্পের বাংলা শিক্ষক হিসেবে কাজ করেন এবং বাংলাদেশ ও চীনের প্রকাশনা আর অনুবাদ কাজে অংশ নেন।
চলতি বছরের প্রথমার্ধে তিনি হাংচৌতে হুয়াওয়ে কোম্পানির প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে চাকরি নেন। বর্তমানে তিনি স্ত্রী ও ছেলের সাথে অসাধারণ দৃশ্যের হাংচৌ শহরে জীবনযাপন কাটাচ্ছেন। যদিও তিনি তাঁর কাজে অনেক ব্যস্ত, তবে নিজের চাকরি অনেক পছন্দ করেন তিনি। তিনি বলেন,
'আমাকে নিয়মিতভাবে দেশের বাইরে যেতে হয়। সৌদি আরবের টেলিযোগাযোগ কোম্পানির উদাহরণ দিয়ে বলি, তাদের এআই প্রযুক্তির প্রয়োগ, বিগ ডেটার হস্তান্তর ইত্যাদি এবং প্রযুক্তির মাধ্যমে নিজের ব্যবসা প্রক্রিয়া উন্নত করা নিয়ে নানা ধারণা দিতে হয়। এসব বিষয়ে প্রশিক্ষণের জন্য আমাকে কোর্স ডিজাইন করতে হয় এবং আমি নিজে প্রশিক্ষণ প্রকল্পে অংশ নেই।'
২০০০ সালে বাংলাদেশ থেকে চীনে আসার পর কিশোর অনুভব করেন যে, চীন ও বাংলাদেশের বিনিময় অনেক বেড়েছে এবং পারস্পরিক সমঝোতাও গভীর হয়েছে। তিনি বলেন,
'অনেক বছর আগে বাংলাদেশে চীনা ভাষার দোভাষী লোক ছিলো খুবই কম এবং তখন সবাই চীনা ভাষা শিখতে ভয় পেতেন। সবাই মনে করেন চীনা ভাষা বিশ্বের অনেক কঠিন ভাষা এবং চীনা অক্ষর মনে রাখাও অনেক কঠিন। তবে বর্তমানে অনেক বাংলাদেশি চীনা ভাষায় দক্ষ, এটা বড় পরিবর্তন। অনেকে লেখাপড়া ও ব্যবসার কারণে চীনা ভাষা শিখতে আগ্রহী।'
কিশোর আরো বলেন, চীনে আসার কারণেই তিনি প্রেম ও পরিবার পেয়েছেন। চীনে স্বপ্ন বাস্তবায়নের সুযোগ নিয়ে দু'দেশের বন্ধুত্বপূর্ণ বিনিময়ের দূত হিসেবে আরো বেশি অবদান রাখবেন বলে আশা করেন।
প্রিয় শ্রোতা, সময় দ্রুত চলে যায়। আমাদের আজকের অনুষ্ঠানও এখানেই শেষ করতে হবে। এ অনুষ্ঠান সম্পর্কে কোনো মতামত থাকলে আমাদের চিঠি লিখতে ভুলবেন না। আমাদের যোগাযোগ ঠিকানাben@cri.com.cn,caoyanhua@cri.com.cn
সময় মতো আমাদের অনুষ্ঠান শুনতে না পারলে বা শুনতে মিস করলে আমাদের ওয়েবসাইটে তা শুনতে পারবেন। ওয়েবসাইটের ঠিকানা: www.bengali.cri.cn
তাহলে এবার বিদায় নিচ্ছি, সবাই ভালো থাকুন, সুস্থ থাকুন, থাকুন সুন্দর ও আনন্দে। আগামী সপ্তাহের একই দিনে একই সময়ে আবারো কথা হবে। যাই চিয়ান। (সুবর্ণা/টুটুল/মুক্তা)