২. সন্তানের সাফল্যের জন্য কী করণীয়

* মূল্যবোধের শিক্ষা: টাকা-পয়সা, নাম, যশ, খ্যাতিকেই বেশিরভাগ ক্ষেত্রে আমরা জীবনের সফলতা ভাবি। এগুলো জীবনের সফলতা, ঠিক। কিন্তু জীবনের সবচেয়ে বড় সফলতা হচ্ছে, ভালো ও আলোকিত মনের মানুষ হওয়া এবং এর জন্য সাধনা করে যাওয়া। মা-বাবাকে বুঝতে হবে- ভালো চাকরি, পর্যাপ্ত টাকা জীবনের জন্য দরকার। কিন্তু তার আগে সন্তানকে মানুষ হিসেবে গড়ে তুলতে হবে। নয়তো কোনো কিছুর অর্থই থাকবে না। তাই ছোট থেকেই মূল্যবোধের শিক্ষা দিতে হবে। সততা, ন্যায়পরায়ণতা, বিনয়, লজ্জা, সত্য-মিথ্যার পার্থক্য বুঝাতে হবে। পরিবার সন্তানের সবচেয়ে বড় শিক্ষার স্থান এটা ভুললে চলবে না। আর মা-বাবা সবচেয়ে বড় শিক্ষক।

*সন্তানের রোল মডেল বা আদর্শ হওয়া: জীবনে যারা সফল হয়েছে, তারা কোনো-না-কোনো সময় কারো-না-কারো দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়েছেন। কখনো সেটা হয়েছে প্রত্যক্ষভাবে বা পরোক্ষভাবে। আর সে সকল মানুষ আমাদের কাছে আমাদের আদর্শ, আমাদের রোল মডেল।

কিন্তু একজন শিশু বা সন্তানের জন্য সবচেয়ে বড় রোল মডেল হলো তার বাবা-মা। শিশুরা অনুকরণ প্রিয়। তারা সবসময় তাদের বাবা-মাকে আদর্শ ভাবে এবং তাদের সব কিছুর অনুকরণ করে তাদের মতো হতে চায়। এ কারণে বাবা-মাকে বেশি সর্তক থাকতে হবে। এবং প্রকৃতপক্ষে সন্তানের সুন্দর আগামীর জন্য সন্তানের সামনে নিজেদেরকে রোল মডেল হিসেবে উপস্থাপন করতে হবে।

-সন্তানের সামনে পরিবারের অন্য সদস্যদের কোনো সমালোচনা করা থেকে বিরত থাকুন।

-কেউ উপহার দিলে কখনোই সন্তানের সামনে সেই উপহারের খুঁত বা দাম নিয়ে আলোচনা করবেন না।

-পরিবারের কেউ কাউকে উপকার করলে ধন্যবাদ দিন। কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করুন। ঘরের মানুষ বলে তাকে ধন্যবাদ দেওয়া যাবে না, এই ধারণা থেকে বের হয়ে আসুন। আপনার এই ছোট পদক্ষেপ সন্তানের মধ্যে কৃতজ্ঞতাবোধ জাগ্রত করবে।

-পরিবারের কেউ ভুল করলে, একে অপরের কাছে দুঃখ প্রকাশ করুন।

-কারো ব্যক্তিগত বা ব্যবহার্য জিনিস নেওয়ার আগে অনুমতি নিন। হোক পরিবারের অন্য সদস্যের জিনিস- তাও জিজ্ঞেস করে নিন। সন্তান তবে কখনো কারো জিনিস না-বলে ধরবে না। পরিবার বা বাইরের কারো জিনিস না-বলে নেওয়াটা লজ্জার, এটা অনেক ক্ষেত্রে চুরির পর্যায়ে পড়ে। সন্তানকে তা বুঝিয়ে বলুন।

-কেউ আসলে বা কল দিলে অনেক ক্ষেত্রে সন্তানকে দিয়ে আমরা মিথ্যা বলাই। 'বলে দাও, বাবা বাসায় নেই।'- এই ধরনের মিথ্যা কথা সন্তান যদি মা-বাবার কাছ থেকে শিক্ষা পায়, সেই সন্তান বড় হলে মা-বাবাকেও এভাবেই মিথ্যা বলতে পারে।

মোট কথা, সন্তান হবার পর থেকে নিজের খারাপ স্বভাব, অভ্যাসগুলো বর্জন করে সন্তানের কাছে আদর্শ মানুষ হতে হবে।

* সামাজিকতা শিক্ষা: অসামাজিক মানুষ সহজে সফল হতে পারে না। কারণ জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে নিজের যোগ্যতার পাশাপাশি অন্যের সাহায্য বা বন্ধুত্বপূর্ণ আচরণ আমাদের এগিয়ে যেতে অনুপ্রাণিত করে। তাই ছোট থেকেই সন্তানকে সামাজিক হবার সুযোগ করে দিন। তার সমবয়সী বাচ্চার সঙ্গে খেলতে দেওয়া, কোনো সমস্যা হলে মা-বাবা সাহায্য না করে, তার বন্ধুদের সঙ্গে সমস্যা সমাধানের জন্য উৎসাহ দেওয়া ইত্যাদি।

কিন্তু অবশ্যই মা-বাবাকে দেখতে হবে সন্তান সামাজিকতা শিখতে গিয়ে যেন ভুল পথে চলে না-যায়। কিছুক্ষেত্রে দূর থেকেই নজর রাখতে হবে।

* বাড়ির ছোট ছোট কাজ করতে দেওয়া: সন্তানের ৫ বছর বয়স হলে বাড়ির ছোট ছোট দায়িত্ব তাকে দিতে হবে। এর মাধ্যমে তার দায়িত্ববোধ গড়ে উঠবে। এই দায়িত্ববোধের জ্ঞান তাকে জীবনের নানা ক্ষেত্রে সফল হতে সাহায্য করবে। দায়িত্বশীল মানুষ একদিন-না-একদিন জীবনে সফলতা পায়।

তাই শিশুকে তার বয়স অনুপাতে দায়িত্ব দিন। যেমন- খেলার পর খেলনা গুছিয়ে রাখা, পড়ার টেবিল পরিষ্কার রাখা, জুতার ফিতা বাঁধতে শেখা ইত্যাদি।

* কম মানসিক চাপ: ছোট থেকেই দায়িত্বজ্ঞান শিক্ষার সঙ্গে সঙ্গে দেখতে হবে কোনো কিছুই যেন সন্তানের মানসিক চাপের কারণ না হয়। পড়াশুনা নিয়ে কখনোই সন্তানকে চাপ দিবেন না। তা ছাড়া, বাবা-মায়ের মাঝে মানসিক দোটানা থাকলে সন্তান ও মানসিক চাপে পড়ে। যা আগামীতে তার জীবনের ওপর বিরূপ প্রভাব ফেলতে পারে। মা-বাবা সংসার বা অন্য কারণে মানসিক চাপে থাকলে সন্তানকে বুঝতে দিবেন না। তার সামনে নিজেকে ভারমুক্ত, পজিটিভ রাখার চেষ্টা করুন। এতে সন্তান সঠিক পরিবেশ পাবে, আগামীও সুন্দর হবে।

* সাধনা ও উচ্চাকাঙ্ক্ষা গড়ে তোলা: জীবনে সফল হতে হলে লক্ষ্য থাকতে হয়, সেই সঙ্গে থাকতে হয় সাধনা আর উচ্চাকাঙ্ক্ষা। মা-বাবাকে সন্তানের লক্ষ্য অর্জনের প্রতি আগ্রহী করতে হবে। বুঝাতে হবে সাধনার গুরুত্ব ও ভূমিকা। সেই সঙ্গে তাকে উচ্চাকাঙ্ক্ষী করে গড়ে তুলতে হবে। কিন্তু খেয়াল রাখতে হবে উচ্চাকাঙ্ক্ষা যেন এমন পর্যায়ে চলে না-যায়, যেখানে সাফল্য পাবার জন্য সন্তানকে মিথ্যা ও অসৎ উপায় গ্রহণ করতে হয়!

* মা-বাবার পুষ্টিজ্ঞান সম্পর্কে ধারণা: সন্তানের সুন্দর জীবন ও সাফল্যের জন্য ছোট থেকেই তার শরীর ও মস্তিষ্কের বিকাশের দিকে খেয়াল রাখতে হবে। তার জন্য তার খাদ্য তালিকা হওয়া উচিত পুষ্টি সমৃদ্ধ। মা-বাবার তাই খাবারের পুষ্টিজ্ঞান সম্পর্কে সঠিক জ্ঞান থাকা দরকার। সেই অনুসারে সন্তানকে খাবার দিলে সন্তানের সুস্বাস্থ্য যেমন নিশ্চিত হবে, তেমনি আগামীও হবে সুন্দর।

* মা-বাবার উচ্চশিক্ষা: সন্তানের সাফল্যে মা-বাবার অনেক বড় ভূমিকা আছে। তাই মা-বাবা যদি উচ্চশিক্ষিত হয় সন্তান ও সঠিক শিক্ষা পাবে। সেই সঙ্গে সন্তানের ও ইচ্ছা জাগবে মা-বাবার মতো উচ্চশিক্ষা লাভ করতে ও জীবনে সফল হতে।

* সন্তানের সঙ্গে সুসম্পর্ক: মা-বাবার সঙ্গে সন্তান এর সম্পর্ক যেন সুন্দর ও স্বাভাবিক হয় এর জন্য মা-বাবাকেই সবচেয়ে বড় ভূমিকা পালন করতে হবে। সন্তানের সুষ্ঠু সুন্দর বিকাশের জন্য মা-বাবার সঙ্গে বন্ধনটা থাকতে হবে মজবুত। সন্তানের সবচেয়ে ভালো সাপোর্ট হচ্ছে তার বাবা-মা।

বাবা-মার সঙ্গে সন্তানের নিবিড় বন্ধন সন্তানের ভবিষ্যত সাফল্যের ক্ষেত্রে অনেক গুরুত্বপূর্ণ।

সন্তানের সাফল্য কামনা করাই শুধু মা-বাবার দায়িত্ব নয়। সেই সাফল্য লাভের জন্য সন্তানকে যোগ্যভাবে গড়ে তুলতে নিজেদেরও প্রস্তুত হতে হবে। বাদ দিতে হবে খারাপ অভ্যাস, অর্জন করতে হবে ইতিবাচক নানা গুণ। মা-বাবার এই সাধনা শুধু তাদের সন্তানকে সাফল্যের মুখই দেখাবে না, জাতিও পাবে যোগ্য উত্তরসূরি।

(স্বর্ণা/তৌহিদ)