বর্তমানে আপনি চীনে পোস্ট ডক্টরাল ফেলো হিসেবে গবেষণা করছেন। আজ আপনার কাছ থেকে চীনের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিসি)-র দুই অধিবেশন নিয়ে জানতে চাইবো।
১. একজন বিদেশি হিসেবে চীনের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিসি)-র দুই অধিবেশন সম্পর্কে আপনার যে ধারণা সেটি শুনতে চাই, যেমন এনপিসি ও সিপিপিসিসি'র সংক্ষিপ্ত পরিচয়, চীনের বহু পার্টির রাজনৈতিক পরামর্শ ব্যবস্থার বিশেষ বৈশিষ্ট্য ইত্যাদি।
ড. গালিব: দুই অধিবেশন বলতে প্রতি বছর মার্চ মাসের প্রথম সপ্তাহে অনুষ্ঠিত এনপিসি আর সিপিপিসিসি'র অধিবেশনকে বোঝানো হয়ে থাকে।
এনপিসি বা National People's Congress আদতে অনেকটা আমাদের বাংলাদেশের জাতীয় সংসদের মতই । তবে এর সদস্যসংখ্যা প্রায় তিন হাজার। গণচীনের রাষ্ট্রপতি ও উপরাষ্ট্রপতি নির্বাচন, মহামান্য রাষ্ট্রপতির সুপারিশক্রমে প্রধানমন্ত্রী, প্রধানমন্ত্রীর সুপারিশক্রমে উপ-প্রধানমন্ত্রী মনোনয়ন ও নির্বাচন, মেয়াদান্তে প্রধান বিচারপতির নিয়োগ, Supreme People's Procuratorate এর প্রধান নিয়োগ এবং সর্বোপরি গণচীনের সংবিধান সংশোধন ও এর রক্ষণাবেক্ষণের গুরুদায়িত্ব রয়েছে এনপিসির হাতে।
অপরদিকে সিপিপিসিসি বা Chinese People's Political Consultative Conference হলো অনেকটা যুক্তফ্রন্ট এর মতো। চীনের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিসি) হলো গণচীনের প্রধান রাজনৈতিক ও আদর্শিক দল। গণচীনে সিপিসি ছাড়াও আরও আটটি রাজনৈতিক দলের কার্যক্রম রয়েছে। এই আটটি দল, চীনের কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিসি) নেতৃত্বে একসাথে মিলিত হয়ে যে যুক্ত ফ্রন্ট গঠন করেছে তার নামই হলো সিপিপিসিসি বা Chinese People's Political Consultative Conference। সিপিপিসিসি মূলত শাসনপ্রক্রিয়ার একটি উপদেষ্টা সংগঠন বা অ্যাডভাইসরি বডি হিসেবে কাজ করে।
১৯৫৯ সাল থেকে এই দুটি অধিবেশন মোটামুটি একই সাথে হয়। ১৯৯৫ সাল থেকে সিপিপিসিসির অধিবেশন তেসরা মার্চ এবং এনপিসির অধিবেশন পাঁচই মার্চ থেকে হয়ে আসছে।
২. চীনের দুই অধিবেশনের গুরুত্ব সম্পর্কে আপনার কাছ থেকে জানতে চাই, যেমন দারিদ্র বিমোচন যুদ্ধে জয়লাভ, চীনের গ্রামের সঞ্জীবনীশক্তি পুনরুদ্ধারের কৌশল, চীনের সংবিধান সংশোধন ইত্যাদি।
ড. গালিব: দুই অধিবেশন একটি সাংবিধানিক পরম্পরা। জাতীয়, আন্তঃরাষ্ট্রীয় জনগুরুত্বপূর্ণ বিষয়াদি নিয়ে এখানে আলোচনা হয় ও প্রয়োজন সাপেক্ষে ভোটাভুটির মাধ্যমে সংশ্লিষ্ট নীতি নির্ধারিত হয়। এক্ষেত্রে বলা যেতে পারে এবারের অধিবেশনে চীনা জনগণের সার্বিক আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন হিসেবে সংবিধানের একটি বিশেষ সংশোধন হয়েছে। সংবিধানের এই সংশোধনীটি হলো রাষ্ট্রপতির কার্যক্রমের নির্দিষ্ট সময়সীমা অপসারণবিষয়ক একটি সংশোধনী। প্রস্তাবটি বিপুল ভোটে (বিপক্ষে মাত্র দুই ভোট, পক্ষে আড়াই হাজারেরও বেশি ভোট) পাস হওয়াতে এখন থেকে আগের মতো রাষ্ট্রপতির কার্যক্রমের মেয়াদ অনধিক দশ বছর হবে না।
দারিদ্র বিমোচন যুদ্ধে জয়লাভ আসলেই গণচীনের এক চোখ ধাঁধানো সাফল্য। দারিদ্র বিমোচনে চীনা জনগণের সাফল্য দেশ বিদেশের বাঘা বাঘা অর্থনীতিবিদগণকে "চীনা মডেলের" দিকে দৃষ্টি ফেরাতে বাধ্য করেছে। বিগত কয়েক দশকে এখানে প্রায় পাঁচ কোটি লোককে দারিদ্র সীমার ওপরে টেনে তোলা হয়েছে। তবে দারিদ্র বিমোচনে এই সাফল্য অনেকটাই ম্লান হয়ে যাবে যদি না সুষম উন্নয়ন ও দুর্নীতি দমন নিশ্চিত করা যায়। সুষম উন্নয়নের মুল ভাবনাটি হলো গ্রামাঞ্চল বাদ দিয়ে শুধুমাত্র শহরকেন্দ্রিক উন্নয়ন প্রকল্প হাতে নিয়ে আসলে বেশি দূর আগানো যায় না, তাছাড়া চীনের কিছু কিছু দুর্গম এলাকা এখনও দারিদ্রপীড়িত। এই অনগ্রসর এলাকার লোকজনও গণচীনের উন্নয়নের সুফলভোগের দাবিদার। প্রশ্ন হচ্ছে, কিভাবে এই পিছিয়ে পড়া এলাকা গুলোকে উন্নয়নের মূলস্রোতে তুলে আনা যায় ?
এক্ষেত্রে প্রেসিডেন্ট সি চিন পিং সরকারের বিভিন্ন কর্মসূচি ও সাফল্য উল্লেখ করবার মতোই। এক হিসাবে জানা যায় এখনও চীনে প্রায় ৭০ মিলিয়ন লোক দারিদ্রপীড়িত। কারা এই ৭০ মিলিয়ন? যারা দুর্গম এলাকায় বাস করেন, যেখানে জলবায়ু কৃষিকাজের অনুকূল নয় এবং যারা ইতোপূর্বে গৃহীত সমস্ত দারিদ্র বিমোচন কর্মসূচির পরেও দারিদ্রসীমার নীচেই থেকে গেছেন, তার মানে কাজটা সহজ নয়। প্রেসিডেন্ট সি চিন পিং সরকার কিন্তু বিষয়টি থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয় নি, তাঁরা কি করেছেন ? তাঁরা নতুন নতুন অস্ত্রে সজ্জিত হয়ে দারিদ্রের সঙ্গে যুদ্ধে নেমে গেছেন এখানেই রয়েছে দুর্নীতিদমনের প্রাসঙ্গিকতা । দুর্নীতি উন্নয়নকে কুরে কুরে খাওয়া এক ভাইরাস। বর্তমান সরকার দুর্নীতির ক্ষেত্রে একদম শুরু থেকেই "জিরো টলারেন্স" নীতি গ্রহণ করে এসেছে। এর পাশাপাশি দুর্গম এলাকাগুলোর দারিদ্র বিমোচনে এলাকাভিত্তিক বিশেষ যোজনা প্রকল্প নিয়ে সরকার আগাচ্ছে। যার ফলশ্রুতিতে সেই ২০১৬ সাল থেকেই প্রতিবছর তাঁরা কিন্তু প্রায় ১০ মিলিয়ন লোককে দারিদ্রতার হাত থেকে টেনে তুলতে পারছেন।