চীনা গল্প: নিউলাং ও জিনুই'র কাহিনী
  2017-02-12 17:02:38  cri


নিউলাং ও জিনুই'র কাহিনী হচ্ছে চীনের সবচেয়ে প্রচলিত এবং জনপ্রিয় একটি লোককাহিনী। এটাও চীনা জনগণের মধ্যে প্রচলিত তারা সম্পর্কিত একটি প্রাচীনতম গল্প।

কাহিনীটি হচ্ছে এরকম- প্রাচীন কালের চীনের আকাশে ছিল জিনুই ও ছিয়েননিউ নামে দুটি তারা। এদের মধ্যে জিনুই ছিল স্বর্গের রাজার মেয়ে। জিনুই আর ছিয়েননিউ পরস্পরকে খুব ভালোবাসতো। কিন্তু স্বর্গের নিয়মে ছেলে মেয়েদের গোপন প্রেম সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। তাই ওদের প্রেম যখন জানাজানি হয়ে গেল তখন স্বর্গের রাণী ভীষণ ক্রদ্ধ হয়ে ছিয়েননিউকে শাস্তি স্বরূপ পৃথিবীতে পাঠিয়ে দেয় আর অন্যদিকে জিনুইকে বিরামহীনভাবে 'স্বর্গের পোশাক মেঘ বোনার শাস্তি প্রদান করে।

শাস্তিস্বরূপ জিনুইয়ের কাজটি হচ্ছে এ রকম যে, অদ্ভূত একধরনের সুতা দিয়ে সারা দিন ধরে সুন্দর সুন্দর মেঘ-কাপড় বুনতে হবে। সময় ও ঋতুর পরিবর্তনের সাথে সাথে এ মেঘ-কাপড়গুলোর রংও বদলে যায়। এটাই হলো 'আকাশে স্বর্গের পোশাক'।

ছিয়েননিউ পৃথিবীতে নেমে আসার পর জিনুই তাঁর কথা ভেবে ভেবে বিচ্ছেদ ব্যথায় ব্যকুল হয়ে সারাক্ষণ চোখের জলে বুক ভাসায়। কিন্তু তীব্র বিরহ সত্তেও তাঁর মেঘ-কাপড় বোনাতে এতটুকু ক্লান্তি নেই। বরং জিনুই মনে মনে এই আশা করে যে, 'আমি যদি সারাদিন ধরে সুন্দর সুন্দর মেঘ বোনাতে থাকি তাহলে একদিন নিশ্চয়ই রাণীর মনে দয়া হবে আর সে আমার প্রিয় ছিয়েননিউকে আবার স্বর্গে ফিরিয়ে আনবে'।

এভাবেই দিন কেটে যায়, কিন্তু একদিন স্বর্গের একদল পরী রাণীর কাছে পৃথিবীর সবুজ পদ্ম সরবরে ভ্রমণের অনুমতি চায়, আর দুঃখী জিনুইকেও তাদের সাথে নিয়ে যাবার অনুরোধ করে। সেদিন স্বর্গের রানীর মনটা ছিল খুব ভালো। মেয়ের দুঃখ দুর্দশা দেখে তাঁর মনটাও বেশ নরম যায়। তাই পরীদের অনুরোধে রাণী রাজি হয়ে যায়, তবে শর্ত হচ্ছে একটি- তাড়াতাড়ি যাবে আর ফিরে আসবে।

এদিকে স্বর্গ থেকে বহিস্কৃত ছিয়েননিউ এক কৃষক পরিবারে জন্মগ্রহণ করে। সেখান তাঁর নাম দেয়া হয়েছে নিউলাং। বাবা-মা মৃত্যুর পর নিউলাং বড় ভাই ও ভাবির সঙ্গে থাকে। কিন্তু ভাই ও ভাবি সারাক্ষণ খুব নির্দয় আচরণ করতে থাকে নিউলাং এর সাথে। একদিন তারা কেবল একটি বুড়া হাড্ডিসার গরু আর একটি পুরানো লাঙ্গল দিয়ে নিউলাংকে বাড়ি থেকে বের করে দেয়। আর বাড়ির যত সম্পদ সব ভাই - ভাবি দখল করে নেয়।

নিউলাং-এর জীবনে এরপর নেমে আসে আরও নিদারুণ দুর্দশা। কেবল একটি বুড়া গরুর সাথে নিয়ে একটি পতিত জমিতে চাষবাদ শুরু করে। মাথা গোঁজার মতো একটি কুটিরও তৈরী করে সেখানে, আর কোনোরকমে খেয়ে পড়ে বেঁচে থাকে তাঁর জীবন। দারুণ কষ্টের সে জীবনে এমনকি নিঃস্পাপ বোবা গরুটি ছাড়া আর কোনো সঙ্গীও রইল না। বড় দীর্ঘ আর একাকী তাঁর জীবন। তবে নিউলাং জানতো না যে, তাঁর বুড়া গরুটি আসলে কিন্তু সাধারণ গরু নয়, সে হচ্ছে স্বর্গের তারা টরাস।

একদিন হঠাত্ বুড়া গরুটি কথা বলে উঠলো আর নিউলাংকে বলল, "নিউলাং, আজ তুমি সবুজ জলের পদ্ম সরবরে চলে যাও। সেখানে স্বর্গ থেকে আসা একদল পরী সরবরের সবুজ জলে আনন্দ-স্নান উত্সব করছে। তারা তাদের পোশাক খুলে রেখে সরবর অবগাহন করছে, তুমি যাও আর সেখান থেকে লাল রঙের পোশাকটি লুকিয়ে রাখো। এটা যদি করতে পারো তাহলে সেই লাল পোশাকটি যে পরীর সে তোমার স্ত্রী হবে।"

গরুর মুখে কথা শুনে নিউলাং ভীষণ অবাক হয়েছে। আর তাই সে বলে, "গরু ভাই, তুমি কথা বলতে পারো? সত্যি তুমিই কি কথা বলেছো?" গরু আস্তে মাথা নেড়ে এ কথার জবাব দয়। এরপর নিউলাং আর দেরি না করে গরুর কথা মতো সবুজ জলের পদ্ম সরবরে চলে যায় এবং চুপে চুপে পাশের ঝোপ-ঝাড়ের মধ্যে লুকিয়ে থাকে আর পরীদের অপেক্ষা করতে থাকে।

কিছুক্ষণ পর নিউলাং অবাক বিস্ময়ে লক্ষ্য করে যে এক ঝাক পরীর দল আকাশ থেকে উড়ে এসে নামল সেখানে আর তাঁরা তাদের রেশমী কাপড়গুলো খুলে ঝাপ দেয় সরবরের স্বচ্ছ সবুজ জলে। এদিকে নিউলাং সুযোগ বুঝে ঝোপ থেকে দৌঁড়ে এসে লাল রঙের পোশাকটি নিয়ে যায়। আকস্মিক এই ঘটনায় পরীরদল হকচকিয়ে যায়, তাড়াহুড়া করে যার যার কাপড় পড়ে দ্রুতই পাখির মতো উড়ে আবার আকাশ পানে চলে যায়। কেবল একটি পরী তার কাপড় না পেয়ে বাধ্য হয়ে সেখানে দাঁড়িয়ে থাকে আর ভয়ে কাঁপতে থাকে। পরীটি আর কেউ না, সেই হচ্ছে জিনুই।

এক অপরিচিত যুবক তাও আবার মর্তের পুরুষ মানুষ, তার কাপড় ছিনিয়েছে। এতে ভীষণ লজ্জা আর ভয়ে সংকুচিত হয়ে মুখ লুকিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। আর এই সুযোগে নিউলাং এসে তার সামনে দাঁড়ায় আর তাকে বলল, "তুমি কি আমার স্ত্রী হবে? যদি তুমি স্ত্রী হতে রাজি হও, তাহলেই আমি তোমার কাপড় ফেরত দেবো।" জিনুই যেন হাঠাত একটি ঝাকুনি খেল, 'এই কণ্ঠস্বর এই চেহারা এতো আমি চিনি, এতো আমার ছিয়েননিউয়ের কন্ঠস্বর'। জিনুই ধীরে ধীরে মাথাতুলে ভয়ে ভয়ে তাকিয়ে দেখে সত্যিই হায় 'এই তো আমার প্রাণপ্রিয় ছিয়েননিউ, কত বিনিদ্র রাত আমি শুধু তার কথা ভেবেই কাটিয়েছি, কেঁদেছি কত তাঁর কষ্টের জীবনের কথা মনে করে'। জিনুই ছুটি গিয়ে নিউলাংকে জড়িয়ে ধরে, দু'জনের চোখের আনন্দ অশ্রুতে সরবরের সবুজ জল যেন আরও গাঢ় সবুজ হয়ে উঠলো। এরপর তারা আকাশ, বাতাস, অগ্নী, মর্ত্য আর জলকে সাক্ষী রেখে বিয়ে করে এবং এই পৃথিবীতেই নতুন আর এক জীবন শুরু করে।

দুজনের ছোট্ট সংসারে সব কাজ দু'জনে মিলেমিশে করে। নিউলাং জমিতে চাষ করে আর জিনুই বোনে রেশমী পোশাক। ছোট্ট এই কুটিরে অভাব থাকলেও ভালোবাসার অভাব নেই যেন এতটুকু। আর এই সুখী জীবনকে আরও বেশী আলোকিত করতে তাদের ছোট্ট কুটিরে জন্ম নেয় দুটি ফুটফুটে সন্তান। দেখতে যেন ঠিক মায়েরই মতো পরীর দেশের পরীর গড়ন। এই সুখী দাম্পত্য জীবনে নিউলাং ও জিনুই সিদ্ধান্ত নিল যে তাঁরা আজীবন একসাথে এই পৃথিবীতেই থাকবে। কিন্তু তাদের সুখময় দিনগুলি যেন হঠাত্ দেখা স্বপ্নের মতো ভেঙ্গে যায় একদিন। স্বর্গের রাণী জানতে পেরে ভীষণ ক্রদ্ধ হয়ে যায়। এবং স্বর্গের সৈন্যদের হুকুম দিয়ে বলেন যে, যাও যেখান থেকে পার, যেভাবে পার আমার কন্যাকে এখনই স্বর্গে নিয়ে আস। আমি এই স্বর্গের আদালতে তাঁর বিচার করতে চাই। হুকুম পেয়ে একদল সৈন্য চলে আসে পৃথিবীতে।

1 2
© China Radio International.CRI. All Rights Reserved.
16A Shijingshan Road, Beijing, China. 100040