তখন দু'জনই বেঁচে থাকার অবলম্বন খুঁজছিলেন। একসময় তারা নদীর কাছে একটি পতিত জমিতে বৃক্ষরোপণ শুরু করতে। সেটা ২০০২ সালের কথা।
পতিত জমিটিতে পাথর ও আগাছা ছাড়া আর কিছুই ছিল না। এখানে বৃক্ষরোপণ সহজ কাজ নয়। গ্রামবাসীরা বলল, দু'জন প্রতিবন্ধীর পক্ষে এখানে বন গড়ে তোলা সম্ভব নয়।
তখন যারা দু'জনকে উপহাস করেছিল, তারা এখন লজ্জিত। তবে কাজটি করতে এই দুই প্রতিবন্ধীকে সত্যিই অনেক কষ্ট সহ্য করতে হয়েছে।
চিয়া হাই সিয়া এক হাতে নিতেন বেলচা, বালতি ও চারাগাছ এবং অন্য হাতে চিয়া ওয়ে ছির জামার হাতা ধরে চলতেন। চিয়া ওয়ে ছির কাঁধের ঝুলন্ত ঝুড়িতে থাকত অন্যান্য প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি।
জমিটি নদীর অন্য তীরে অবস্থিত বলে দু'জনকে প্রতিবার নদী অতিক্রম করতে হতো। চিয়ে ওয়ে ছির বাহু নেই বলে তিনি দু'কাধেঁ প্রথমে সব
যন্ত্রপাতি নিয়ে নদী অতিক্রম করেন। তারপর ফিরে এসে আবার চিয়া হাই সিয়াকে বহন করে নদী অতিক্রম করেন। এভাবে কেটে যায় দিন-মাস-বছর। এভাবে কতোবার তাদের নদী অতিক্রম করতে হয়েছে, তার হিসেব কে রাখে! চিয়া ওয়ে ছি বলেন, শুরুর দিকে চিয়া হাই সিয়েকে বহন করে নদী অতিক্রম করা তার জন্য খুব কঠিন কাজ ছিল। সতর্ক না-থাকলে দু'জনই নদীতে পড়ে যাবার ভয় থাকতো। শীতকালেও নদী অতিক্রম করার সময় চিয়া ওয়েন ছি রীতিমতো ঘামতেন।
দু'জন কীভাবে গাছ রোপণ করতেন? শ্রম-বন্টনের মাধ্যমে। প্রথমে চিয়া ওয়ে ছি একটি জায়গা বাছাই করেন, তারপর চিয়া ওয়েন ছি চিয়া হাই সিয়াকে এ জায়গায় নিয়ে আসেন, তাকে একটি বেলচা দেন। চিয়া হাই সিয়া গর্ত করার সময় চিয়া ওয়েন ছি নিজের তৈরি বিশেষ সরঞ্জাম নিয়ে নদী থেকে পানি নিয়ে আসেন।এভাবে একটি একটি করে দুজন ২০০২ সালে ৮০০টি গাছ রোপণ করেন। না, পরিবেশ সংরক্ষণ বা জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলার মহান চিন্তা থেকে তারা এসব করেননি। তারা শুধু কিছু একটা করে নিজেদের প্রমাণ করতে চেয়েছিলেন। তবে তাদের স্বপ্ন দ্রুতই আঘাতপ্রাপ্ত হয়। বসন্তকালে রোপিত গাছগুলো গ্রীষ্মকালে মারা যায়। ৮০০টি গাছের মধ্যে মাত্র দুটি বেঁচে থাকে। এতে তারা হতাশ হন। চিয়া হাই সিয়া বলেন, তারা এর কারণ কিছুতেই বুঝে উঠতে পারলেন না।
দু'জন জীবনে নানা দুর্ভাগ্যের শিকার হয়েছেন, কিন্তু কখনও হাল ছেড়ে দেননি। এক্ষেত্রেও তারা হাল ছাড়লেন না। প্রাথমিক ব্যর্থতার কারণ খুঁজে বের করার চেষ্টা করলেন তারা। তারা আবিষ্কার করলেন যে, এ ধরনের পতিত জমিতে পানি ধরে রাখা যায় না। তাই তারা একটি খাল কাটার সিদ্ধান্ত নিলেন। দু'জন প্রতিবন্ধীর জন্য খাল কাটা একটি কঠিন কাজ । দু'জন একসাথে একদিনে মাত্র কয়েক মিটার খাল কাটতে পারেন। অসংখ্য সূর্যোদয় ও সূর্যাস্তের পর দু'জন এ প্রায়-অসম্ভব কাজ শেষ করেন। চিয়া হাই সিয়া এখনও ভুলতে পারেন না সেই স্মৃতি। খাল কাটা হলো এবং সে খাল বেয়ে নদী থেকে পানি এলো তাদের পতিত জমিতে। চারাগাছ লাগানো হলো। এবার সেগুলো বড় হতে লাগলো। সে এক আশ্চর্য সুন্দর দৃশ্য! চিয়া হাই সিয়া বললেন, এর চেয়ে সুন্দর দৃশ্য পৃথিবীতে আর একটিও নেই।
দু'জন প্রতিবন্ধী শেষ পর্যন্ত পতিত জমিকে সবুজ বনে পরিণত করেন। বন এতো ঘন যে, বনের ভিতর থেকে আকাশ দেখা মুশকিল। কিছুদিন আগে তারা পাহাড়ের ২০০ মু পতিত জমি ঠিকা নেন এবং নতুন গাছ রোপণ শুরু করেন। এখন সরকার ও গণকল্যাণ সংস্থাগুলোও তাদের সাহায্য দিচ্ছে এ কাজে।
চিয়া ওয়েন ছি ও চিয়া হাই সিয়ার গল্প তথ্যমাধ্যমের মাধ্যমে চীন ছাড়িয়ে গোটা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়েছে ইতোমধ্যেই। অনেকেই তাদেরকে 'মহান মানুষ' হিসেবে আখ্যায়িত করছেন। কিন্তু চিয়া ওয়েন ছি বলেন, 'আমরা মহান মানুষ নই, আমরা শুধু যে কাজ করতে পারি সে কাজ করেছি। গত কয়েক বছরে আমরা অনেক কষ্ট স্বীকার করেছি। ভবিষ্যতেও আমাদের অনেক সমস্যায় পড়তে হবে। কিন্তু সব সমস্যার সমাধান আছে বলে আমরা বিশ্বাস করি। আমরা দু'জন বৃক্ষরোপণ করেই যাবো। এখন অনেক গণকল্যাণ সংস্থা আমাদেরকে সাহায্য দেয় এবং আমি বিশ্বাস করি সবার প্রচেষ্টায় গাছের সংখ্যা দিন দিন বাড়তেই থাকবে।" (শিশির/আলিম)