বন্ধুরা, আজকের 'চলুন বেড়িয়ে আসি' অনুষ্ঠানে আমরা আপনাদেরকে মধ্য চীনের হো নান প্রদেশের জেংচৌ শহরের—হো নান পাথর বুদ্ধমূর্তি শিল্পী সম্প্রদায়ে নিয়ে যাবো।
হো নান পাথর বুদ্ধ শিল্পী সম্প্রদায় জেং চৌ শহরের পাথর বুদ্ধ গ্রামে অবস্থিত। পাথর বুদ্ধ গ্রামটি জেংচৌ শহরের উত্তর-পশ্চিম দিক থেকে ১০ কিলোমিটার দূরে। উত্তর-পশ্চিম গ্রামে একটি প্রাচীন মন্দির আছে। জানা গেছে মন্দিরটি খ্রিস্টাব্দ সপ্তম শতাব্দীতে থাং রাজবংশ আমলের প্রথম দিকে নির্মিত হয়। মন্দিরে বুদ্ধের একটি ২ মিটারের বেশি উঁচু পাথরের ভাস্কর্য আছে। এ কারণেই মন্দিরটির নাম 'পাথর বুদ্ধ মন্দির'।
পাথর বুদ্ধ গ্রামের পরিবেশ সতেজ এবং শান্তিপূর্ণ। ২০০৬ সালের এপ্রিল মাসে চীনের আমেরিকান শিল্পী হুয়াং কুও রুই এই জায়গাটি বাছাই করে তার ঘরের বাইরের দেয়াল হলুদ রঙে চিত্রিত করেন এবং ছাদে একটি স্টুডিও নির্মাণ করেন। এটা দেখে পরে ওয়াং ই তিং আর সু সিয়াও শি এবং তারও পরে সব শিল্পীই ছাদে তাদের স্টুডিও নির্মাণ করেন। ৩০ মে তারা 'পাথর বুদ্ধ শিল্পী সম্প্রদায় প্রতিষ্ঠা করেন। এরপর থেকে আরো বেশি শিল্পী এখানে আসতে শুরু করেন। মাত্র এক বছরের মধ্যে গ্রামে শতাধিক স্টুডিও খোলা হয়। হোনান প্রদেশের একমাত্র এই গ্রামটি বিভিন্ন ধরনের শিল্পীর মিলন কেন্দ্রে পরিণত হয়েছে।
গ্রামে ঢুকলে পথের দু'পারের দেয়াল চিত্রগুলোই এখানকার বিশিষ্টতার কথা জানিয়ে দেবে। শিল্পী হুয়াং কুও রুই সংবাদদাতাকে জানিয়েছেন, স্বদেশে ফিরে আসার প্রথম দিকে তিনি পেইচিংয়ের সুও চিয়া ছুন গ্রামের আন্তর্জাতিক শিল্পকলা শিবিরে তার স্টুডিও তৈরি করেছিলেন। কিন্তু কিছু দিন যেতে না যেতেই বড় নগরীর উচ্চ দ্রব্যমূল্য ও কোলাহলময় পরিবেশের কারণে তিনি নিজের জন্মস্থান হোনানের পাথর বুদ্ধ গ্রামে ফিরে আসার সিদ্ধান্ত নেন এবং সেখানে স্টুডিও তৈরি করেন। পেইচিং ও সাংহাইয়ের চেয়ে পাথর বুদ্ধ শিল্পী সম্প্রদায়ের পরিবেশ অনেক সতেজ ও শান্তিপূর্ণ এবং জিনিস পত্রের দামও খুব কম। এ সব সুবিধার কারণে অনেক শিল্পী পাথর বুদ্ধ গ্রামে আসেন। হুয়াং কুও রুই বলেন, পাথর বুদ্ধ শিল্পী সম্প্রদায় গড়ে তোলার প্রথমে পর্যায়ে আমি একাই স্টুডিও করেছিলাম। তার পর ছয় সাতটি, এরপর দশ-বারোটি স্টুডিও হলো। এক বছরের মাথায় ৩০জনেরও বেশি শিল্পী এতে অংশ নিলেন। এখন শতাধিক শিল্পী এই গ্রামে বাসা ভাড়া করে থাকেন। শিল্পীরা তৈলচিত্র, চীনা শিল্পকর্ম, ক্যালিগ্রাফি, ভাস্কর্য, আলোকচিত্র, সিরামিক শিল্প ও ব্যবস্থাপনাসহ বিভিন্ন কাজ করছেন।
শিল্পী সম্প্রদায় গঠনের পর ১ বছরে পাথর বুদ্ধ শিল্পী সম্প্রদায় গ্রামে চারটি প্রদর্শনী করেছে। চলতি বছরের প্রথম দিকে 'হোনান পাথর বুদ্ধ শিল্পী সম্প্রদায়' মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কের সোহো ৪৫৬ আর্ট গ্যালারীতে প্রদর্শনী করেছে। এর মধ্য দিয়ে শিল্পীদের শিল্প-কর্ম বিশ্ব মহানগরে প্রবেশ করেছে। নিউইয়র্কের দর্শকদের মনে এই প্রদর্শনী গভীর ছাপ ফেলেছে। হুয়াং কুও রুই বলেন, নিউইয়র্কের সোহো এলাকায় এ বছরের ৮ জানুয়ারির ঐ প্রদর্শনী। প্রদর্শনীটি খুবই ভালো ছিল। নিউইয়র্কের অনেক শিল্পী এতে এসেছিলেন এবং খুব প্রশংসা করেছেন। সাধারণত বিদেশী শিল্পী, সমালোচক, প্রদর্শনী পরিকল্পনাকারী, সংগ্রহকারী সবাই শুধু পেইচিং ও সাংহাই থেকে চীনকে উপলব্ধি করেন। মধ্য চীনের হোনান সম্পর্কে তারা জানেন না। এ জন্যেই এ প্রদর্শনীর উদ্দেশ্য ছিল হোনান ও পাথর বুদ্ধ গ্রামের আধুনিক শিল্পকর্ম সম্পর্কে বিদেশী দর্শকদেরকে পরিচিত করানো। প্রদর্শনী দেখার পর তারা হোনান, জেংচৌ এমনকি পাথর বুদ্ধ গ্রামও দেখতে যাবেন।
পাথর বুদ্ধ গ্রামে শিল্পীদের আসা শিল্পী এবং স্থানীয় কৃষক উভয়ের জন্য কল্যাণকর। শিল্পী ও স্থানীয় কৃষকদের মধ্যে স্বাক্ষরিত চুক্তি অনুযায়ী গ্রামবাসীদের বাড়ির ছাদে স্টুডিও নির্মাণ করতে চাইলে শিল্পীদের এককালীন কিছু পুঁজি বিনিয়োগ করতে হবে। কিন্তু ১০ বছরের জন্যে তারা চিন্তামুক্ত, আর কোনো খরচ নেই। একাগ্রচিত্তে তখন তারা নান্দনিক সৃজনশীলতার কাজ করে যেতে পারবেন। কৃষকদের লাভ কী? ১০ বছর পর এ সব স্টুডিও তাদের সম্পদ হয়ে যাবে। ১০ বছরের পর যদি শিল্পী স্টুডিওটি ব্যবহার করতে চান, তখন দু'পক্ষের সম্পর্ক দাঁড়াবে বাড়িওয়ালা ও ভাড়াটের। যদি কোন শিল্পী স্টুডিও তৈরি করতে না চান, তারা মাত্র ৫০ ইউয়ান দিয়ে বাড়ি ভাড়া নিতে পারবেন। পাথর বুদ্ধ শিল্পী সম্প্রদায় স্থানীয় সরকারেরও সমর্থন পেয়েছে। সরকার পাথর বুদ্ধ গ্রামের জন্য গণ অবকাঠামো মেরামত করেছে। দু'বছর ধরে যেমন আরো বেশি বেশি শিল্পী আসছেন তেমনি পাথর বুদ্ধ গ্রামও বদলে যাচ্ছে। হুয়াং কুও রুই বলেন, আমার মনে হয় গ্রামবাসীদের নগদ লাভ হচ্ছে শিল্পীদেরকে বাড়ি ভাড়া দেয়া। আগে পাথর বুদ্ধ গ্রামে কেউ বাড়ি ভাড়া দিত না। তবে শিল্পীদের আসা এবং পাথর বুদ্ধ গ্রামের সুনাম বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বাড়ি ভাড়া নিতে আসা শিল্পীর সংখ্যাও দিন দিন বেড়ে যায়। তবে এটা কেবলই ওপরে ওপরে। আমার মনে হয়, এতে কেন্দ্রীয় প্রভাব এবং পাথর বুদ্ধ গ্রামের সাংস্কৃতিক পক্ষের অবদান আছে। কারণ সাধারণত শিল্পী ও গ্রামবাসীদের মধ্যে স্বাক্ষরিত চুক্তির মেয়াদ দশ বছর। এই সময়ের মধ্যে একটি শিশু বড়ো হয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়। এই পর্যায়ে শিশুদের ওপর বড় প্রভাব ফেলার পাশাপাশি পাথর বুদ্ধ গ্রামবাসীদের নান্দনিক সংস্কৃতি, ধারণা এমনকি সাংস্কৃতিক মানও অনেক বাড়বে। এটা কিছু বাড়িঘর ভাড়া দেওয়ার চেয়ে অনেক গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার।
পাথর বুদ্ধ গ্রামে শিল্পী সম্প্রদায়ের শিল্পীরা স্থানীয় কৃষকদের সঙ্গে জীবনযাপন করে তাদের সরলমনের স্পর্শে অনুপ্রেরণা খুঁজে পান। স্থানীয় কৃষকরাও তাদেরকে সাদরে গ্রহণ করে নিয়েছে। একজন গ্রামবাসী মা বলেন, যে শিল্পী দোতলার ঘরটি ভাড়া নিয়েছেন, নিঃসন্দেহে তিনি জিতেছেন। কারণ ঐ ঘরটিই সবচেয়ে ভালো। মনে হয় তার সঙ্গে শিল্পীর যোগাযোগও খুব ভালো।
আরেকজন গ্রামবাসী নারী ওয়াং বলেন, শিল্পী আসার পর পরিবেশসহ সবার মধ্যে বিরাট পরিবর্তন এসেছে। আমাদের সম্পর্ক খুবই ভালো। আমি শিল্পীকে বলেছি, আমার বাচ্চা বড়ো হওয়ার পর আপনার ছাত্র হবে।
কোনো কোনো মানুষ বলেছে, পাথর বুদ্ধ শিল্পী সম্প্রদায়ে শিল্পীরা ছাড়াও এর অন্য গুরুত্বপূর্ণ দিক হচ্ছে নাগরিকদের মধ্যে শিল্পকর্ম জনপ্রিয় করা এবং সাংস্কৃতিক চেতনা উন্নীত করা। এখানে শিল্পীকে গ্রামবাসী শিল্পী বলা হয়। পাথর বুদ্ধ গ্রামের নান্দনিক প্রভাব ধাপে ধাপে চীনের মধ্য অঞ্চলেও বিস্তৃত হচ্ছে। এর অন্যতম কারণ শিল্প প্রদর্শনী কেন্দ্রের চেয়ে ঐ অঞ্চল গ্রামবাসীদের আরো কাছে। পেইচিংয়ের প্রদর্শনী পরিকল্পনাকারী ছাই ছিং মনে করেন, জেংচৌ 'পাথর বুদ্ধ শিল্পী সম্প্রদায়ের নিজের বৈশিষ্ট্যময় আকর্ষণী ক্ষমতা আছে। তিনি বলেন, কারণ পেইচিং একটি মহানগর। সেখানকার স্টুডিও স্বাধীন ও স্বতন্দ্র। অন্য কারো জীবন থেকে বিচ্ছিন্ন। কিন্তু এখানে পুরোপুরি কৃষকদের জীবন ঘনিষ্ঠ। কৃষক ও বাস্তব জীবন এতো ঘনিষ্ঠ হলে শিল্প-কর্মের প্রতিফলন ঘটে আরো যথার্থভাবে। এটা হচ্ছে চীনে প্রথম গ্রামে প্রতিষ্ঠিত স্টুডিও, কৃষকদের ঘরের ছাদে প্রতিষ্ঠিত স্টুডিও। ফলে এগুলো চীনের সবচেয়ে বৈশিষ্ট্যপূর্ণ শিল্প স্টুডিওগুলোর প্রতিনিধিত্ব করে। ভবিষ্যতে এই গ্রাম অনেক বিদেশী শিল্পীকে আকর্ষণ করবে। আমি ভাবছি ভবিষ্যতে পেইচিং, জার্মানী এমনকি আমেরিকায় নিয়ে পাথর বুদ্ধ গ্রামের শিল্পীদের প্রদর্শনী করবো।
এখানকার শিল্পীরা দৃঢ় আস্থার সঙ্গে নিজেদের শিল্প ঘাঁটি নির্মাণ করছেন। সেখানে তারা হোনান প্রদেশের প্রথম বিখ্যাত তৈলচিত্র শিল্পীদের শিল্প-কর্ম ব্যবস্থাপনা গ্যালারি স্থাপন করেছেন। এছাড়া পাথর বুদ্ধ গ্রাম শিল্পকলা নিয়ে আলোচনা সভা ও সেমিনারও আয়োজন করে। শিল্পীরা মিলিত হয়ে আলোচনা সভা আয়োজন করে বিশ্বের সবচেয়ে আধুনিক শিল্পের ধারা নিয়ে মতবিনিময় করেন। দুই বছর ধরে পাথর বুদ্ধ শিল্পী সম্প্রদায় অনেক অসম্ভবকে সম্ভব এবং হোনান শিল্পী গ্রুপের স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দিয়েছে। পাথর বুদ্ধ গ্রামে আসা প্রথম শিল্পী হুয়াং কুও রুই বলেন, পাথর বুদ্ধ শিল্প সম্প্রদায়ের শিল্পীরা নিজেদের কর্মকান্ড দিয়ে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সঙ্গে সেতু গড়ে তোলেন।
প্রিয় শ্রোতাবন্ধুরা, যদি আপনাদের ইচ্ছা থাকে, আপনারাও পাথর বুদ্ধ গ্রামকে নিজ চোখে দেখে আসতে পারেন। আজকের 'চলুন বেড়িয়ে আসি' অনুষ্ঠান এখানেই শেষ করছি। শোনার জন্য আপনাদেরকে অসংখ্য ধন্যবাদ। আপনারা সবাই ভালো থাকুন, সুস্থ থাকুন। আর অপেক্ষা করুন আগামীতে আপনাদেরকে কোন দর্শনীয় স্থানে নিয়ে যাই সেটা জানার জন্য।
|