১২ মে সংঘটিত সিছুয়ানের ওয়েনছুয়ান ভয়াবহ ভূমিকম্প হচ্ছে ১৯৪৯ সালের পর চীনে সবচেয়ে ধ্বংসাত্মক ভূমিকম্প দুর্যোগ। সিছুয়ান ছাড়া পশ্চিম চীনের শেনশি, কানসু, ছোংছিং, ইয়ুনান ও কুইচৌসহ অনেক প্রদেশ বিভিন্ন মাত্রায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এখন পর্যন্ত ভূমিকম্পে প্রায় ৭০ হাজার মানুষ প্রাণ হারিয়েছে এবং সরাসরি অর্থনৈতিক ক্ষতি হয়েছে ২০০ বিলিয়ন ইউয়ানেরও বেশি।
চীনের জাতীয় উন্নয়ন ও সংস্কার কমিশন এবং চীনের গণ ব্যাংকসহ সংশ্লিষ্ট বিভাগের প্রকাশিত তথ্য থেকে জানা গেছে, ওয়েনছুয়ান ভূমিকম্পের কারণে দুর্গত অঞ্চলের অর্থনীতির গুরুতর ক্ষতি হয়েছে এবং স্বাভাবিক উত্পাদন ও জীবনযাপনের শৃঙ্খলা বিনষ্ট হওয়ার পরও সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত অঞ্চলটি পাহাড়ী হওয়ার কারণে এর অর্থনৈতিক উত্পাদনের মোট পরিমাণ গোটা চীনের তুলনায় অনেক কম। ফলে এবারের দুর্যোগ মারাত্মক হলেও চীনের সামষ্টিক অর্থনৈতিক উন্নয়নের মৌলিক অবস্থার পরিবর্তন হবে না।
চীনের জাতীয় উন্নয়ন ও সংস্কার কমিশনের উপ-পরিচালক মু হোং
চীনের জাতীয় উন্নয়ন ও সংস্কার কমিশনের উপ-পরিচালক মু হোং বলেন, 'সিছুয়ান প্রদেশের উত্তরাঞ্চল হচ্ছে সবচেয়ে গুরুতর দুর্গত অঞ্চল। আমি বিশ্বাস করি, দুর্যোগ সিছুয়ান প্রদেশের অর্থনৈতিক বিকাশের ওপর বড় আঘাত হেনেছে। কিন্তু সারা চীনের জিডিপিতে সিছুয়ানের অনুপাত মাত্র ৪ শতাংশের মতো। এ অঞ্চলের মোট অর্থনৈতিক পরিমাণ গোটা চীনের এক হাজার ভাগের কয়েক ভাগ। তাই আমরা মনে করি, এবারের দুর্যোগ চীনের উত্পাদন পরিমাণের ওপর কিছুটা প্রভাব ফেললেও তা খুবই সীমিত।'
তিনি আরো মনে করেন, ভূমিকম্পের কারণে চীনের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির তিনটি প্রধান উপাদান অর্থাত্ বিনিয়োগ, রপ্তানী ও পণ্যভোগের ওপর তেমন প্রভাব পড়ে নি। ফলে ভূমিকম্প চীনের অর্থনৈতিক বিকাশের মৌলিক অবস্থার পরিবর্তন করবে না।
চীনের সমাজ বিজ্ঞান একাডেমির অর্থ গবেষণা ইনস্টিটিউটের গবেষক ই সিয়ান রোং মনে করেন, কেন্দ্রীয় সরকারের বিপুল আর্থিক সমর্থনে নির্ধারিত সময়ের মধ্যে এই অঞ্চলের সড়ক পরিবহন, শহরের গণ স্থাপনা ও বসতবাড়ির নির্মাণকাজ ধাপে ধাপে দুর্যোগ পূর্ববর্তী মানে পুনরুদ্ধার হবে। এ ক্ষেত্রের বরাদ্দ জিডিপি প্রবৃদ্ধির একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদানে পরিণত হতে পারে। তিনি বলেন, 'দুর্যোগোত্তর পুনর্গঠনে বিপুল পরিমাণ অর্থ দেয়ার পর নিঃসন্দেহে স্থানীয় অর্থনীতির প্রবৃদ্ধি দ্রুততর হবে। পুনর্গঠন প্রক্রিয়ার সঙ্গে সম্পৃক্ত সকল শিল্প প্রতিষ্ঠান এর ইতিবাচক ভূমিকা উপলব্ধি করবে।'
জানা গেছে, সিছুয়ানে বিদেশী বিনিয়োগের শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলো দুর্যোগের কারণে বিনিয়োগের আস্থা হারিয়ে ফেলে নি। ছেংতু শহরের বিনিয়োগ ত্বরান্বিতকরণ কমিটির স্থানীয় ১০০০টি বিদেশী পুঁজির শিল্প প্রতিষ্ঠানের ওপর চালানো জরীপের ফলাফল থেকে জানা গেছে, ভূমিকম্প হওয়ার দশ দিন পর প্রায় ৮০ শতাংশ বিদেশী পুঁজির শিল্প প্রতিষ্ঠানের উত্পাদন পুনরুদ্ধার হয়েছে। পৃথিবীর ৫০০টি সেরা শিল্প প্রতিষ্ঠানের মধ্যে ১৩০টি সিছুয়ান প্রদেশের রাজধানী ছেংতুতে শাখা কোম্পানি স্থাপন করেছে। ভূমিকম্পের পর এগুলোর ৮০ শতাংশেরও বেশি শিল্প প্রতিষ্ঠান স্বাভাবিক উত্পাদন ও ব্যবসা আবার শুরু করেছে।
সিঙ্গাপুরের টেলিযোগাযোগ প্রযুক্তি ছেংতু কোঃ লিমিটেডের মহা ব্যবস্থাপক ভিলিয়াম গান কিয়ান হোক সংবাদদাতাকে বলেন, 'আমরা আমাদের বিদেশী ক্রেতা ও আমাদের সদর দপ্তরকে জানানোর চেষ্টা করি যে, ছেংতু বিপন্ন হয়ে পড়ে নি। এখানকার দৈনদিন জীবন স্বাভাবিক হয়েছে। ছেংতুর পানি, বিদ্যুত্, ইন্টারনেট, টেলিযোগাযোগ ও বিমান বন্দরের ওপর প্রভাব পড়ে নি। ফলে আমাদের শিল্প প্রতিষ্ঠানের উন্নয়ন বাধাগ্রস্ত হবে না।'
এরিকসন চায়না টেলিযোগাযোগ কোঃ লিমিটেডের নির্বাহী ভাইস চেয়ারম্যান আলফ্রেড লিং নিজ শিল্প প্রতিষ্ঠানের ভবিষ্যত উন্নয়নের ওপর আশাবাদী। তিনি বলেন, 'ছেংতুর বড় পরিবর্তন হয় নি। এখানকার অর্থনীতি সুষ্ঠু। শ্রম শক্তিও প্রতিন্দন্দ্বিতাপূর্ণ। সত্যি, সিছুয়ানে ভয়াবহ ভূমিকম্প হয়েছে। কিন্তু আমি মনে করি, দুর্গত অঞ্চলের পুনর্গঠন থেকে নতুন সুযোগও সৃষ্টি হবে।'
রপ্তানী ক্ষেত্রে সিছুয়ান চীনের গুরুত্বপূর্ণ রপ্তানী কেন্দ্র নয়। ফলে সিছুয়ানের দুর্যোগ গোটা চীনের রপ্তানী বাণিজ্যের ওপর তেমন বড় প্রভাবও ফেলবে হবে না। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অর্থ গবেষণা ইনস্টিটিউট মনে করে, চীন একটি বড় অর্থনৈতিক ইউনিট। অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে অভ্যন্তরীণ চাহিদার গুরুত্বপূর্ণ তাত্পর্য আছে। বিদেশী চাহিদা মন্দা হলেও চীনের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির ওপর তেমন প্রভাব পড়বে না।
বর্তমানে চীনের বাজারে ভোগ্যপণ্যের সরবরাহ ও চাহিদা উভয়ই পর্যাপ্ত। অনেক বিশেষজ্ঞ মনে করেন, দুর্যোগোত্তর পুনর্গঠন চীনের নির্মাণ সামগ্রীসহ সংশ্লিষ্ট ভোগ্যপণ্যের চাহিদা বাড়াবে। জুন মাসের প্রথম দিকে চীনের গণ ব্যাংকের অর্থ গবেষণা ইনস্টিটিউটের এক রিপোর্টে বলা হয়েছে, দুর্যোগোত্তর পুনর্গঠন স্থাবর সম্পত্তির বিনিয়োগ এবং খাদ্য ও নিত্যপণ্যের চাহিদা বৃদ্ধি ত্বরান্বিত করবে।
দুর্যোগোত্তর পুনর্গঠন পর্বে সম্পদজাত ও বড় পরিমাণ পণ্যের দাম বাড়ার সম্ভাবনা রয়েছে। সেক্ষেত্রে সামষ্টিক অর্থনৈতিক নীতিতে চীন জটিল সমস্যার মুখোমুখি হবে। এক দিকে, সরকারের দুর্যোগোত্তর পুনর্গঠনের জন্য বরাদ্দ বৃদ্ধি। এ কারণে ঋণদানের ওপর নিয়ন্ত্রণ কিছুটা শিথিল করা হবে। অন্য দিকে, যদি ভূমিকম্পের কারণে জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ আর শ্রম শক্তির মূল্য বাড়ে, তাহলে মূল্য স্ফীতির চাপ আরো বেড়ে যাওয়ার আশংকা আছে।
এ সমস্যা মোকাবেলায় চীনের গণ ব্যাংকের গবেষণা ব্যুরোর সামষ্টিক অর্থনীতি বিভাগের পরিচালক চি মিন বলেন, 'সামষ্টিক নিয়ন্ত্রণের প্রধান দায়িত্ব হচ্ছে কাঠামোর কারণে পণ্যের মূল্য বৃদ্ধি থেকে স্পষ্ট মূল্য স্ফীতি রোধ করা। আমাদের মোট পরিমাণ নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে কঠোর মুদ্রা নীতি অবলম্বন করা উচিত।'
পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ভূমিকম্পের পর দেশ বিদেশের ৪০ বিলিয়ন ইউয়ান সাহায্যের অর্থ ছাড়াও চীনের কেন্দ্রীয় সরকার ভূমিকম্পের উদ্ধার ও ত্রাণ কাজের জন্য কয়েক ডজন বিলিয়ন মার্কিন ডলার বরাদ্দ করেছে এবং দুর্যোগোত্তর পুনর্গঠনের জন্য ৭৫ বিলিয়ন ইউয়ানের তহবিল স্থাপন করেছে। এই অর্থ চীনের অভ্যন্তরীণ চাহিদা ত্বরান্বিত করবে এবং এ বছরের দ্বিতীয়ার্ধে শিল্প উত্পাদন ও বিনিয়োগ প্রবৃদ্ধির গতি বাড়ানোর জন্য ইতিবাচক ভূমিকা পালন করবে। (ইয়ু কুয়াং ইউয়ে)
|