হোজে জাতি চীনে জনসংখ্যার দিক দিয়ে সবচেয়ে সংখ্যালঘু জাতিগুলোর অন্যতম। তারা বংশপরম্পরায় চীনের হেইলুংচিয়াং প্রদেশের উসুলি নদীর পাশে বসবাস করে। তাদের নিজস্ব কোনো লিখিত ভাষা নেই। তবে এই জাতির মধ্যে 'ইমাখান' নামে এক ধরনের লোক শিল্প প্রচলিত আছে। জীবনযাপন রীতি সংস্কারের কারণে এক শ বছরের ইতিহাসসমৃদ্ধ এই ঐতিহ্যিক লোকশিল্প এক সময় বিলুপ্তির হুমকির মুখে পড়েছিল। ২০০৬ সালে ইমাখানকে চীনের প্রথম দফা জাতীয় বিষয়গত সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকার তালিকাভুক্ত করা হয়েছে। বিভিন্ন পক্ষের জোর প্রচেষ্টায় ইমাখান আবার হোজে জাতির জনগণের মুখে মুখে ফিরে এসেছে।
এখন আপনারা শুনছেন ১৯৭৯ সালের অক্টোবর মাসে চীন গণ প্রজাতন্ত্রের ৩০তম প্রতিষ্ঠা বার্ষিকী উদযাপন উপলক্ষ্যে পেইচিংয়ের মহা গণ ভবনে হোজে জাতির শিল্পী উ লিয়ান কুইয়ের গাওয়া গানের রেকর্ডিং। তখন উ লিয়ান কুই হোজে জাতির জাতিগত কাপড় পরে মহা গণ ভবনের মঞ্চে বিশেষ সুরে গান গেয়ে সকল দর্শককে মুগ্ধ করে দিয়েছিলেন।
ইমাখান হোজে জাতির ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিষয়ক পুস্তক হিসেবে সুপরিচিত। ইমাখান কথায় ও গানে হোজে জাতির ইতিহাস, বীরত্ব কাহিনী, সামাজিক উত্পাদন, রীতিনীতি ও ধর্মীয় বিশ্বাসসহ নানা বিষয় বর্ণিত হয়। শিল্পীরা প্রাণবন্ত উপমা ও সমৃদ্ধ মৌখিক ভাষায় নানা রকমের মানুষের কথোপকথন ও প্রাণীর আওয়াজ নকল করেন। তাদের অভিনয় দেখে শুনে মনে হয় সেই বিশেষ দৃশ্যই মঞ্চস্থ হচ্ছে। হোজে জাতির পূর্বপুরুষরা কঠোর পরিশ্রমের পর ইমাখান গেয়ে যেমন আনন্দ পেতেন, তেমনি সান্ত্বনা এবং সামনে এগোনোর শক্তিও খুঁজে পেতেন।
হোজে জাতির মানুষের মধ্যে খুব কম লোক ইমাখান গাইতে পারেন। উ লিয়ান কুই ইমাখানের উত্তরসূরীদের অন্যতম। তিনি মারা যাওয়ার পর তাঁর নাতি উ পাও চেন এ লোকশিল্প শিখেছেন। উ পাও চেন বলেন, 'হেইলুংচিয়াং নদীর তীরে চিয়েচিনকুও নামে একটি ক্ষুদ্র প্রাচীন নগর আছে। আমরা পূর্ব দিকের সর্বোচ্চ পাহাড়ে দাড়িয়ে সূর্যের দিকে তাকিয়ে সমবেত কন্ঠে উচ্চ স্বরে ইমাখান গাই।'
উ পাও চেনের জন্মস্থান হচ্ছে উসুলি নদী, হেইলুংচিয়াং নদী ও শোংহুয়াচিয়াং নদীর সংযোগ স্থলের দিকে অবস্থিত চিয়েচিনকুও থানায়। সেখানে উঁচু পাহাড় ও গভীর বন আছে। সেখানকার পানি সম্পদ সমৃদ্ধ এবং ঘাস খুব সুন্দর। এমন পরিবেশ মত্স্য চাষ প্রধান হোজে জাতির বসবাসের জন্য উপযুক্ত স্থান।
হোজে জাতির মানুষ একসময় মাছের চামড়া দিয়ে কাপড় তৈরি করতো। তারা দেবতাকে মদ নিবেদন করতো, কুকুর চালিত স্লেজ-গাড়ি ব্যবহার করতো। ঐতিহ্যিক হোজে জাতির মানুষ মত্স্য শিকার করে জীবিকা নির্বাহ করেন। তারা বড় বড় মাছের চামড়া তুলে কাঠের হাতুড়ি দিয়ে পিটিয়ে সুতার কাপড়ের মতো তা নরম করার পর বৈশিষ্ট্যপূর্ণ মাছের চাকড়া দিয়ে কাপড় তৈরি করেন। এ ধরনের কাপড় খুব হালকা। শরত্ ও শীতকালে তা পরে শীত নিবারণ করা যায়। বসন্ত ও গ্রীষ্মকালে এই কাপড় পানি নিরোধক।
মাছের চামড়া দিয়ে তৈরি কাপড় পরা হোজে জাতির মেয়েরা
এখন মাছের চামড়া দিয়ে তৈরি কাপড় কেউ পরে না। এ ধরনের কাপড় জাদুঘরের মূল্যবান সংরক্ষিত জিনিসে পরিণত হয়েছে। এখন শীতকালে হোজে জাতির মানুষের মধ্যে শিকার করার দৃশ্য তেমন দেখা যায় না। কেবল ইমাখানে এখনো বংশধরের কাছে পুর্বপুরুষদের কাহিনী বর্ণনা করা হয়। উ পাও চেন বলেন, ছোট বেলায় বয়স্ক স্বজনরা দিনে পরিশ্রম করার পর বাসায় ফিরে এসে সবাই একসাথে ইমাখান গাওয়ার দৃশ্য তাঁর স্পষ্ট মনে আছে, যা কোন দিন তিনি ভুলবেন না। তিনি বলেন, 'আমার মনে আছে, মাছ ধরার নৌকা ফিরে আসার পর বাবা মা বাচ্চাদেরকে ডেকে নৌকার গলুই বা গাছের নিচে বসে গল্প বলতেন। হোজে জাতির উত্সবের দিনে কেউ নাচেন, কেই গল্প বলেন, আবার কেউ বা বাদ্যযন্ত্র বাজান।'
কিছু দিন আগে চীনের সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় উ পাও চেনকে হোজে জাতির ইমাখানকে শিল্পকলার জাতীয় পর্যায়ের উত্তরসূরী হিসেবে নির্ধারণ করেছে। তিনি মনে করেন, ইমাখান হোজে জাতির ঐতিহাসিক সংস্কৃতি, জীবনযাপনের প্রথা এবং সভ্যতার প্রতিনিধিত্বকারী। তাকে বংশগতভাবে রক্ষা করা উচিত্। তিনি বলেন, 'বলা যায়, ইমাখান হচ্ছে হোজে জাতির সবচেয়ে মূল্যবান সম্পদ। একে দিন দিন যত বেশি জনপ্রিয় করে তোলা এবং যত বেশি উত্তরসূরি এর প্রশিক্ষণ নিতে পারে ততই ভালো। এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।'
উ পাও চেন চিয়েচিনকুও থানার সংস্কৃতি কেন্দ্রের প্রধান ছিলেন। তিনি সবসময় ইমাখানকে জনপ্রিয় করার চেষ্টা চালিয়ে এসেছেন। দাদা উ লিয়ান কুই-এর সংগৃহীত প্রাচীন ইমাখানের ভিত্তিতে তিনি নিজের ব্যাখ্যাও যোগ করেছেন। এখন শুনুন উ পাও চেনের গাওয়া 'সা মান তিয়াও' নামের ইমাখানের একটি অংশ।
ইমাখানকে সম্প্রসারণ করার আগ্রহ থাকা সত্ত্বেও অনেক সমস্যার মুখে পড়তে হচ্ছে। উত্তরসূরীর সংখ্যা কম, হোজে জাতির জীবনযাপন রীতির পরিবর্তন হচ্ছে ইমাখানের অন্যতম বিপদ। গত শতাব্দীর ৫০'র দশকে সারা চীনে কেবল দশ বারো জন শিল্পী ইমাখান গাইতে পারতেন। গত শতাব্দীর ৮০'র দশকে মাত্র পাঁচ জন ইমাখান শিল্পী ছিলেন। মত্স্য সম্পদ কমে যাওয়ার কারণে হোজে জাতির মানুষ বাধ্য হয়ে মাছ ধরা বাদ দিয়ে জমি চাষ শিখতে শুরু করেন। এতে তাদের ইমাখানে প্রশংসনীয় মাছ ধরার জীবন আর থাকে না। তা ছাড়া হোজে জাতির লিখিত ভাষা নেই, ফলে ব্যাপক অঞ্চলে ইমাখান প্রচার করা খুব কঠিন। হোজে জাতির মূল্যবান ইমাখান শিল্পকলা দিনে দিনে বিলুপ্ত হওয়ার হুমকির মুখে আছে। তাকে উদ্ধার ও রক্ষা করার কাজ অতি জরুরী। ইমাখানের উত্তরসূরী হিসেবে উ পাও চেন আবেগের সঙ্গে বলেন, 'আমার বয়স ৫০ বছর। আমার মতো বয়সী হোজে জাতির মানুষরা যদি এ জাতির সংস্কৃতি না শেখে, তাহলে আমাদের সন্তানকে হোজে জাতির সংস্কৃতি শেখানো আরো দুরের কথা।'
চীন সরকার এ সমস্যাও উপলব্ধি করেছে। ইমাখানকে চীনের জাতীয় বিষয়গত সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকার হিসেবে তালিকাভুক্ত করার পর সংশ্লিষ্ট বিভাগ একে রক্ষা করার জন্য বিস্তারিত পদক্ষেপ ও উপায় নির্ধারণ করেছে। থোংচিয়াং শহর হোজে জাতির প্রাকৃতিক ও সাংস্কৃতিক জাদুঘর এবং জাতিগত প্রথা উদ্যান প্রতিষ্ঠা করেছে। সেখানে হোজে জাতির অধিবাসীদের ঐতিহ্যিক বসতবাড়ি সংরক্ষিত রয়েছে। এর পাশাপাশি হোজে জাতির নাচ, গান ও অন্যান্য লোক শিল্প সংগ্রহ করে সংরক্ষণ করা হয়েছে। ২০০১ সাল থেকে প্রতি বছরের শরত্কালে হোজে জাতির পর্যটন উত্সব আয়োজিত হয়। পর্যটন উত্সবে ইমাখান সংক্রান্ত সংগীতানুষ্ঠান ও নৃত্য প্রদর্শন করা হয়। এভাবেই হোজে জাতির লোক শিল্প রক্ষা পেয়েছে। থোংচিয়াং শহরে হোজে জাতি গবেষণা সমিতি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।
থোংচিয়াং শহরের ডেপুটি মেয়র ইয়ু লি জুন মনে করেন, 'জাতিগত সংস্কৃতি জাতিগত অঞ্চলে জন্ম ও বিকশিত হয়। ফলে জাতিগত অঞ্চলে তাকে বিকাশ ও সম্প্রসারণ করা খুব গুরুত্বপূর্ণ। কেবল এভাবে তা বংশপরম্পরায় বেঁচে থাকবে।'
এর জন্য স্থানীয় সরকার সংশ্লিষ্ট পরিকল্পনা নিয়েছে। যেমন তৃণ মূল সাংস্কৃতিক কেন্দ্রে প্রায়শই জাতিগত বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন সাংস্কৃতিক তত্পরতা আয়োজিত হয়। প্রবীন লোকশিল্পীরা নবীনদেরকে জাতিগত ঐতিহ্যিক সংগীত, নৃত্য, প্রথা ও ভাষা শেখান। স্থানীয় স্কুল শিশুদেরকে নিজ জাতির ইতিহাস, সংস্কৃতি ও প্রথা জানানোর জন্য মাঝেমাঝে জাতিগত সাধারণ জ্ঞানের কোর্স আয়োজন করে। সরকার জাতিগত সংস্কৃতির উত্তরসূরীকে বিশেষ ভর্তুকি দেয়। যাতে তাদের মাধ্যমে নিজ জাতির লোকশিল্প ও হস্তশিল্পের ঐতিহ্যিক কৌশল ধারাবাহিকতা পায়। (ইয়ু কুয়াং ইউয়ে)
|