চীনের মুলভূভাগের শহরগুলোর মধ্যে ফুচিয়ান প্রদেশের সিয়ামেন শহর তাইওয়ানের খুব কাছে। দু'পারের অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিক বিনিময় দিনে দিনে যেমন নিবিড় হচ্ছে তেমনি বহু তাইওয়ানী ব্যবসায়ী সিয়ামেন শহরে বিনিয়োগ করছেন। বহু বছর চেষ্টার পর মূলভূভাগের অর্থনীতির দ্রুত বিকাশের সঙ্গে সঙ্গে তাইওয়ানী ব্যবসায়ীদের ব্যবসাও ধাপে ধাপে বড় হয়েছে।
মিঃ চেন ছিন চাও হচ্ছেন ফুচিয়ান প্রদেশের সিয়ামেন দুওয়েল ইলেকট্রন কোঃ লিমিডেটের চেয়ারম্যান। গত শতাব্দীর ৯০'র দশকে তাইওয়ানে তাঁর ইলেকট্রন কোম্পানির বাজার আর ব্যয়বহুল শ্রম শক্তির কঠিন অবস্থার মধ্যে পড়ে। তখন থেকে তিনি তাঁর শিল্প প্রতিষ্ঠানকে বাইরে স্থানান্তর করার চিন্তাভাবনা শুরু করেন। তিনি বলেন, 'মূলভূভাগের আগে আমি ফিলিপাইন, থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া ও সিঙ্গাপুরের বাজার পরিদর্শন করেছিলাম। তখন আমি ভাবলাম, একজন চীনা মানুষ হওয়া সত্ত্বেও আমি কখনো চীনের মূলভূভাগে যাই নি। আমি একদিন স্বদেশ দেখতে যাবো।'
ঘুরিয়ে ফিরিয়ে চিন্তা করার পর চেন ছিন চাও বেছে নিলেন সিয়ামেনকে। এখানেই তাঁর মূলভূভাগের ব্যবসা জীবন শুরু। চেন ছিন চাওয়ের সিয়ামেনকে বাছাই করার অন্যতম কারণ হচ্ছে সিয়ামেনের মানুষ মিন নান ভাষা বলেন। অনেক তাইওয়ানী ব্যবসায়ীদের আদি বাড়ি মিন নান অঞ্চলে। ফলে সিয়ামেন তাঁদের কাছে অনেক বেশি আপন বলে মনে হয়। তা ছাড়া এখানকার বাণিজ্যের ভবিষ্যত সম্ভাবনাও আশাব্যাঞ্জক। চেন ছিন চাও সাংবাদিককে বলেন, 'আমাদের উত্পাদন প্রধানতঃ রপ্তানীমুখী। সিয়ামেন একটি বন্দর শহর। আমি মনে করে, সিয়ামেনের একটি ভালো রপ্তানীর অঞ্চল হওয়ার ভিত্তি ও পরিবেশ আছে। তা ছাড়া সিয়ামেন ও তাইওয়ান খুব কাছাকাছি। আমি ভেবেছিলাম, আমাদের উত্পাদন কেন্দ্রকে সিয়ামেনে প্রতিষ্ঠা করলে পরিবহনের সুবিধা পাবো।'
গত শতাব্দীর ৯০'এর দশকের প্রথম দিকে, চীনের মূলভূভাগের অর্থনৈতিক অবস্থা তাইওয়ানের তুলনায় অনেক পিছিয়ে ছিল। শিল্প প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনাও সুষ্ঠু ছিল না। চেন ছিন চাওয়ের এখনো মনে পড়ে, তখন মূলভূভাগের টেলিযোগাযোগ ব্যবস্থাও অপেক্ষাকৃত পশ্চাত্পদ ছিল। চেন ছিন ছাওয়ের প্রতিষ্ঠানের একটি টেলিফোন সংযোগ লেগেছিল আবেদনের প্রায় ছয় মাস পর।
কিন্তু চেন ছিন চাও সমস্যায় ভেঙে পড়েন নি। সমৃদ্ধ অভিজ্ঞতা ও মানসিক শক্তির কারণে তাঁর শিল্প প্রতিষ্ঠান দিন দিন বড় হয়েছে এবং আকার ও মুনাফাও নিরন্তরভাবে বেড়েছে। ২০০৭ সালে সিয়ামেন দুওয়েল ইলেকট্রন কোঃ লিমিডেটের রপ্তানী ও আমদানীর মোট মূল্য প্রায় ৪০ কোটি মার্কিন ডলার দাঁড়িয়েছে।
শিল্প প্রতিষ্ঠানটি সফল হওয়ার গোপন রহস্য সম্পর্কে চেন ছিন চাও বলেন, সফল হওয়ার কোনো সোজা পথ নেই। এর দুটি প্রধান শর্ত হচ্ছে সঠিক সিদ্ধান্ত ও লেগে থাকা। তিনি বলেন, 'আমি মনে করি, যে কোন কাজে সফল হতে চাইলে প্রথমেই অন্য মানুষের তুলনায় আপনার আলাদা নিজস্ব বৈশিষ্ট্য থাকা দরকার। শিল্প প্রতিষ্ঠানেরও নিজের বৈশিষ্ট্য থাকা উচিত। দ্বিতীয়তঃ শিল্প প্রতিষ্ঠানের ওপরে সবসময় মনোযোগী থাকতে হবে। ভূলভূভাগে বিনিয়োগ করার পর থেকে আমি সবর্দাই ইলেকট্রোনিক শিল্প নিয়ে কাজ করছি। অন্যান্য শিল্পেও বিনিয়োগ করার আমার অনেক সুযোগ ছিল, যেমন স্থাবর সম্পত্তি। কিন্তু আমি তা করি নি। কারণ আমি মনে করি, যে কোন কাজ ভাল করে করতে চাইলে মনোযোগী হওয়া দরকার। আমি বিশ্বাস করি, সফল হওয়ার সোজা সাপ্টা পথ নেই।'
মূলভূভাগে ১৬ বছরের ব্যবসায়ী জীবনে চেন ছিন চাও নিজের চোখে এখানকার অর্থনীতির লক্ষণীয় বিকাশ দেখেছেন। তিনি মনে করেন, তাইওয়ানী ব্যবসায়ীরা মূলভূভাগে ভালো ব্যবসা করার মূল কারণ হচ্ছে অর্থনৈতিক উন্নয়নের পরিবেশ। তিনি বলেন, 'আসলে আমার চোখে চীনের অর্থনৈতিক উন্নয়ন প্রক্রিয়া আমার কোম্পানির উন্নয়ন প্রক্রিয়ার মতো। বিশেষ করে সাম্প্রতিক পাঁচ বছর এই পরিবর্তন পরিমাণ থেকে মানের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। চীনের অর্থনৈতিক বিকাশ এখন এক দ্রুততর যুগে আছে। দেখুন, এখন আরো বেশি বড় বড় তাইওয়ানী ব্যবসায়ী মূলভূভাগে আসছে। তারা এখানে হাই টেক কারখানা স্থাপন করছেন।'
তাইওয়ানী ব্যবসায়ীদের সিয়ামেন শহরে সফল হওয়ার আরেকটি কারণ হচ্ছে সিয়ামেন সরকার তাইওয়ানী ব্যবসায়ী ও তাদের বিনিয়োগ শিল্প প্রতিষ্ঠানের জন্য সহায়ক নীতিসহ নানা ক্ষেত্রে সমর্থন ও সাহায্য দিয়ে আসছে। সিয়ামেন শহরের তাইওয়ান বিষয়ক কার্যালয়ের উপ-পরিচালক ওয়াং মিং সুই জানিয়েছেন, 'তাইওয়ানের স্বদেশবাসীদেরকে সিয়ামেনে বিনিয়োগে উত্সাহিত করা এবং তাদের বৈধ স্বার্থ ও অধিকার রক্ষার জন্য সিয়ামেন শহরের গণ কংগ্রেস ১৯৯৪ সালে 'সিয়ামেন শহরে তাইওয়ানের স্বদেশবাসীদের বিনিয়োগ নিশ্চয়তা ধারা' অনুমোদন করে। সিয়ামেন পৌর সরকার তাদের সেবায় তাইওয়ান বিষয়ক কার্যালয়ে তাইওয়ানী স্বদেশবাসীদের অভিযোগ গ্রহণ কেন্দ্র স্থাপন করেছে।'
এখন সিয়ামেনে বিনিয়োগকারী তাইওয়ানী স্বদেশবাসীরা এই শহরের সঙ্গে মিশে গেছে। ধারাবাহিকভাবে ৪০ জনেরও বেশি তাইওয়ানী ব্যবসায়ীকে সিয়ামেন শহরের 'গৌরবময় শহরবাসী'-এর খেতাব দেয়া হয়েছে। চেন ছিন চাও এর মধ্যে একজন। তিনি বলেন, এখন তার ব্যবসা সুষ্ঠুভাবে চলছে। কিন্তু তাঁর আরেকটি আশা এখনো পূর্ণ হয় নি। তা হচ্ছে দু'পারের সরাসরি বাণিজ্যিক বিনিময়, ডাক যোগাযোগ আর বিমান চলাচল যত তাড়াতাড়ি সম্ভব এগুলো বাস্তবায়িত হওয়া উচিত। তিনি বলেন, 'কীভাবে দু'পারের সম্পর্ককে আরো ঘনিষ্ঠ করা যায়, দু'পারের জনগণের যৌথ অর্থনীতি উন্নয়ন করা যায়, দু'পারের জনসাধারণের জীবনযাপনের মান উন্নত করা যায়। তা বিবেচনার বিষয়। আমাদেরকে তা বিবেচনা করতেই হবে। বিশেষ করে বর্তমান বিশ্বায়নের প্রেক্ষাপটে আমরা দিন দিন আরো কাছে আসলে বৈশ্বিক গ্রামে আমরা আরো শ্রেষ্ঠ হয়ে উঠতে পারবো। এভাবে আমরা চীনা জাতির আরেকটি উজ্জ্বল ভবিষ্যত সৃষ্টি করতে পারবো। দু'পারের জনসাধারণ বৈশ্বিক গ্রামে অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে সেরা হতে চাইলে দু'পারের যোগাযোগের পথ আরো দ্রুত সুগম করা উচিত।'
এখন চেন ছিন চাও হচ্ছেন সিয়ামেন শহরের তাইওয়ানী ব্যবসায়ীদের বিনিয়োগ শিল্প প্রতিষ্ঠান সমিতির চেয়ারম্যান। তিনি বলেন, তিনি সিয়ামেনের তাইওয়ানী ব্যবসায়ীদের শক্তিকে ঐক্যবদ্ধ করে দু'পারের সরাসরি বাণিজ্যিক বিনিময়, ডাক যোগাযোগ ও বিমান চলাচল বাস্তবায়নের জন্য নিরন্তর চেষ্টা চালাবেন। (ইয়ু কুয়াং ইউয়ে)
|