এতক্ষণ আপনারা যে রেকর্ডিং শুনলেন , তা চীনের তিব্বতের পোতালা ভবন মেরামতে নিয়োজিত শ্রমিকদের কাজের আওয়াজ । কাজের সময় শ্রমিকরা একদিকে গান গাইছেন , অন্যদিকে তিব্বতী স্থাপত্যশৈলীপূর্ণ ভবন মেরামতের কাজ করছেন । শ্রমিকদের গান ও কন্ঠস্বর পোতালা ভবনের মেরামত প্রকল্পের নির্মাণস্থলের সর্বত্রই ছড়িয়ে যাচ্ছে । গত ২০ বছরে পোতালা ভবনের বিভিন্ন স্থানে এ ধরনের আওয়াজ শোনা যায় ।
পোতালা ভবন চীনের তিব্বত স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চলের লাসা শহরের কেন্দ্রস্থলে অবস্থিত । তার বয়স ১ হাজার ৩ শো বছরেরও বেশি । পোতালা ভবন এমন এক ধরনের প্রাচীন রাজকীয় ভবন , যে ভবন সমুদ্র সমতলের তুলনায় বিশ্বের শীর্ষস্থানে এবং তা সুষ্ঠুভাবে সংরক্ষিত রয়েছে । পোতালা ভবন সম্পর্কে বহু লোক কাহিনী ও গল্প প্রচলিত রয়েছে । সপ্তম শতকে তিব্বতী রাজা থাং রাজবংশের রাজকুমারী ওয়েন ছেনকে বিয়ে করার জন্য এই রাজমহল নির্মাণ করা হয় । পাহাড়ের পাদদেশে নির্মিত এই রাজভবনের আয়তন ৪ লাখ বর্গ মিটার , ভবনের উচ্চতা ১৩ তলা এবং তা পাথর ও কাঠ দিয়ে নির্মিত । ভবনের ছাদ সোনালী টালিতে সাজানো । পুরো ভবন ঝকঝকে , তকতকে ও জাঁকজমকপূর্ণ । এতে তিব্বতী জাতির প্রাচীন স্থাপত্যশেশীর বৈশিষ্ট্য প্রকাশ পেয়েছে ।
দীর্ঘকাল ধরে ভবনের কাঠামো ও প্রাকৃতিক পরিবেশ পরিবর্তনের কারণে পোতালা ভবনের ভিত্তি ধীরে ধীরে দেবে গেছে এবং দুর্বল হয়ে পড়েছে । দেয়ালের বেশ কয়েকটি জায়গায় ক্ষয়ক্ষতি ও ফাটল দেখা দিয়েছে । পোকার ক্ষয়ক্ষতি ও বিকৃত হওয়ার কারণে ভবনের কাঠের কাঠামোতে গুরুতর বিপদ ঘটার আশংকা ছিল । গত শতাব্দির পঞ্চাশের দশক থেকে বিশেষ করে গত ২০ বছর ধরে চীন সরকার পোতালা ভবনের সার্বিক মেরামত ও সংস্কারের ব্যাপারে বিপুল অংকের অর্থ বরাদ্দ করেছে ।
১৯৫৯ সালের পর পোতালা ভবন মেরামতের জন্য চীন সরকার প্রতি বছর অর্থ বরাদ্দ করে থাকে । ১৯৮৯ ও ২০০২ সালে ভবনের আরো ব্যাপকভাবে মেরামত ও সংস্কারের জন্য চীন সরকার আরো বেশি অংকের অর্থ বরাদ্দ করেছে । পোতালা ভবনের ব্যবস্থাপনা বিভাগের পরিচালক ছাম্বা কেলজাং বলেন ,
১৯৮৯ সাল থেকে ১৯৯৪ সাল পর্যন্ত পোতালা ভবনের প্রথম সার্বিক মেরামত সময়পর্বে চিন সরকার ৫ কোটি ৩০ লাখ ইউয়ান অর্থ বরাদ্দ করেছে । ২০০২ সালে ভবনের দ্বিতীয় মেরামত করা হয় । এ ক্ষেত্রে চীন সরকার ১৭ কোটি ইউয়ান অর্থ বরাদ্দ করেছে । এ প্রকল্প এখনো শেষ হয় নি ।
জানা গেছে , পোতালা ভবনের দ্বিতীয় বড় ধরনের মহা মেরামত প্রকল্পের কর্মসূচীতে প্রাচীন বাড়িঘরের ভিত্তি মজবুত করা , আশেপাশের পরিবেশের পুনর্গঠন , বিদ্যুত্ ও দূষিত পানি নিষ্কাশন এবং দমকল , নিরাপত্তা রক্ষা ও বজ্রপাত মুক্ত ব্যবস্থা উন্নত করা , হাইটেক পদ্ধতিতে ভবনের ওপর তত্ত্বাবধান করা এবং দেয়ালচিত্রের পুনরানয়ন অন্তর্ভুক্ত । বৃদ্ধ জামইয়াং হচ্ছেন তিব্বতের লাসা প্রাচীন শিল্পকলা , স্থাপত্যশৈলী ও চারুকলা কোম্পানির একজন প্রবীণ প্রযুক্তিবিদ । গত শতাব্দির আশির দশক থেকে তিনি পোতালা ভবনের মেরামত ও সংস্কার কাজে যোগ দেন । তিনি বলেন ,
তিনি বহুবার পোতালা ভবনসহ তিব্বতের প্রধান পুরাকীর্তিগুলোর মেরামত ও সংস্কারের কাজে যোগ দিয়েছেন । এ সব পুরাকীর্তি চীন ও বিশ্বের অত্যন্ত মূল্যবান পুরাকীর্তি । এ সব পুরাকীর্তি মেরামতের ক্ষেত্রে চীন সরকার বিপুল অংকের অর্থ বরাদ্দ করেছে । ঐতিহাসিক পুরাকীর্তি মেরামত করতে হলে বিশেষ প্রযুক্তি ও নির্মাণ সামগ্রী ব্যবহার করতে হয় । চীন সরকার পুরাকীর্তি ও ইতিহাসের ওপর খুব গুরুত্ব দিয়ে আসছে । তারা প্রাচীন স্থাপত্যশৈলির মাধ্যমে পুরার্কীতি মেরামত করে থাকে । সুতরাং যখন পুরাকীর্তি মেরামত প্রকল্পের কর্মসূচী প্রণয়ন করা হয় , তখন বিভিন্ন ক্ষেত্রের মতামত ও প্রস্তাবও সংগ্রহ করা হয় ।
পোতালা ভবন মেরামত প্রকল্পের একজন প্রকৌশলী বলেন , পোতালা ভবনের মেরামত প্রকল্প সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করার জন্য চীনের রাষ্ট্রীয় পুরাকীর্তি ব্যুরো ও তিব্বতের সংশ্লিষ্ট বিভাগের উদ্যোগে প্রাচীন স্থাপত্যশৈশী , ভূতত্ত্ব ও জলসেচসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রের বিশেষজ্ঞদের নিয়ে একটি পরিদর্শন গ্রুপ গঠিত হয়েছে । তারা বিজ্ঞান ভিত্তিক উপায়ে পোতালা ভবনের স্থাপত্যশৈলী ও কাঠামো নিয়ে ব্যাপক পরিদর্শন ও যাচাই করেছেন । তাদের নির্ধারিত কর্মসূচী অনুযায়ী তিব্বতী প্রাচীন স্থাপত্যশৈলীর ভিত্তিতে পোতালা ভবন মেরামত ও সংস্কার করা হবে ।
সোনাম লাসার একজন তিব্বতী বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী । তিনি সচক্ষে পোতালা ভবনের দু'বারের মেরামত কাজ লক্ষ্য করেছেন । তিনি বলেন ,
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে চীন সরকার পোতালা ভবন ও সাকিয়া মন্দিরসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পুরাকীর্তি মেরামত ও সংস্কারের ক্ষেত্রে বড় অংকের অর্থ বরাদ্দ করেছে । ফলে তিব্বতের বহু শ্রেষ্ঠ পুরাকীর্তি সংরক্ষিত হয়েছে । এতে তিব্বতের ধর্মাবলম্বীরা ব্যাপক প্রফুল্ল হয়ে উঠেছেন ।
পোতালা ভবনের দ্বিতীয়বারের মেরামত কর্মসূচী চলাকালে ভবনের দেয়ালচিত্র মেরামত ও মজবুত করার ব্যাপারে বেশ কিছু অর্থ ব্যয় করা হয়েছে । এ পর্যন্ত পোতালা ভবনের ২১০০ বর্গ মিটার দেয়ালচিত্রের মেরামত ও সংস্কারের কাজ সম্পূর্ণভাবে সম্পন্ন হয়েছে । এ প্রসংগে পোতালা ভবনের ব্যবস্থাপনা বিভাগের প্রধান ছাম্বা কেরজাং বলেন ,
পরিকল্পনা অনুযায়ী , পোতালা ভবনের মেরামত কাজ পূর্বনির্ধারিত ৭০ শতাংশ সম্পন্ন করা হয়েছে ।
২০০১ থেকে ২০০৫ সাল পর্যন্ত অর্থাত্ দশম পাঁচসালা পরিকল্পনা মেয়াদে চীন সরকার পোতালা ভবন , নরবু লিংখা ও সাকিয়া মন্দির মেরামতের ক্ষেত্রে ৩৩ কোটি ইউয়ান বরাদ্দ করেছে । ২০০৬ থেকে ২০১০ সাল পর্যন্ত একাদশ পাঁচসালা পরিকল্পনা মেয়াদে তাও চাও মন্দিরসহ অন্যান্য পুরাকীর্তি মেরামতের জন্যই চীন সরকার প্রায় ৮০ কোটি ইউয়ান বরাদ্দ করবে । (থান ইয়াও খাং)
|