নেপালের গণ পরিষদের প্রথম অধিবেশন ২৮ মে রাতে রাজধানী কাঠমান্ডুতে অনুষ্ঠিত হয়েছে। অধিবেশনে নেপালের অস্থায়ী সংবিধান সংশোধনের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে এবং আনুষ্ঠানিকভাবে নেপালকে 'ফেডারেল গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র' ঘোষণা করা হয়েছে। এর মধ্য দিয়ে নেপালের প্রায় ২৪০ বছরের রাজতন্ত্রের বিলোপ ঘটেছে এবং প্রজাতান্ত্রিক যুগ শুরু হয়েছে। নেপাল বর্তমানে সবচেয়ে নবীন প্রজাতান্ত্রিক রাষ্ট্রে পরিণত হয়েছে।
এ অধিবেশনে গণ পরিষদের ৫৬৪ জন প্রতিনিধি নেপালের ভবিষ্যতের শাসন ব্যবস্থা নিয়ে ভোটে অংশ নেন। ভোটদানের পর নেপালী কংগ্রেস পার্টির প্রবীন সদস্য কুল বাহাদুর গুরুং ঘোষণা করেন, অধিবেশনে উপস্থিত ৫৬৪জন সদস্যের মধ্যে ৫৬০ জন রাজতন্ত্র বিলুপ্তির পক্ষে এবং চার জন রাজতন্ত্রের পক্ষে ভোট দিয়েছেন। ফলে রাজতন্ত্রের বিলুপ্তি ঘোষণা করে নেপাল ফেডারেল গণতান্ত্রিক প্রজাতান্ত্রিক রাষ্ট্রে পরিণত হয়েছে। এ ফলাফলে অধিবেশন ছিল তুমুল করতালি ও উল্লাসে ফেঁটে পড়ে। অধিবেশন কক্ষের বাইরে অপেক্ষামান হাজার হাজার নেপালী জনগণ আনন্দে রাস্তায় নেমে আসে এবং নেচে গেয়ে উল্লাস প্রকাশ করেন। অনেকে বলেন, প্রজাতান্ত্রিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার এই দিনটি হচ্ছে তাদের জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিন।
গণ পরিষদের বৃহত্তম রাজনৈতিক দল মাওবাদী কমিউনিস্ট পার্টির মুখপাত্র বলেন, 'নেপালী জনগণ অবশেষে কয়েক শতাব্দীর সামন্ততান্ত্রিক ব্যবস্থার বন্দীত্ব থেকে মুক্তি পেয়েছে। নেপাল মৌলিক আর্থ-সামাজিক সংস্কারের দরজা খুলেছে।' তিনি ঘোষণা করেন, রাজতন্ত্র উত্খাত করার জন্য নেপালের মাওবাদী কমিউনিস্ট পার্টি দশ বছরেরও বেশি সময় ধরে সংগ্রাম করেছে। তারা এখন থেকে সশস্ত্র পদ্ধতি পুরোপুরি ত্যাগ করবে এবং নেপালের গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক সংস্কার প্রক্রিয়ায় যোগ দেবে।
অধিবেশনে গৃহীত সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, নেপাল এ দিন থেকে একটি স্বার্ধীন সার্বভৌম ও অবিচ্ছেদ্য গণতান্ত্রিক প্রজাতান্ত্রিক রাষ্ট্রে পরিণত হয়েছে। এর সঙ্গে সংগতিপুর্ণ নয় এমন আইন ও প্রশাসনিক সংস্থা এ দিন থেকে আপনাআপনি অকার্যকর হয়ে যায়। রাজ পরিবারের সদস্যদের সকল বিশেষ অধিকার ও সুযোগ এ দিন শেষ হয়ে যায়। রাজা সাধারণ নাগরিক হিসেবে অন্য সাধারণ নাগরিকদের সমান অধিকার ও সুযোগ সুবিধা পাবেন। তাকে ১৫ দিনের মধ্যে প্রাসাদ ত্যাগ করারও নির্দেশ দেয়া হয়েছে। সরকার রাজপ্রাসাদটি সংস্কার জাতীয় জাদুঘরে রূপান্তর করবে। গণ পরিষদ রাজার স্থলাভিষিক্ত করার জন্য প্রেসিডেন্ট নির্বাচন করবে। প্রেসিডেন্ট রাষ্ট্র প্রধান ও সশস্ত্র বাহিনীর প্রধান হবেন। তিনি মন্ত্রীসভার প্রস্তাব অনুযায়ী দেশে জরুরী অবস্থা ঘোষণা বা বাতিল করতে পারবেন। তবে রাষ্ট্রের নির্বাহী ক্ষমতা থাকবে প্রধানমন্ত্রীর হাতে।
২০০৬ সালের নভেম্বর মাসে নেপালের সাত দলীয় জোট এবং মাওবাদী কমিউনিস্ট পার্টির মধ্যে চুক্তির মধ্য দিয়ে নেপালে শান্তি প্রক্রিয়া শুরু হয়। গত বছরের ডিসেম্বর মাসে গৃহীত নেপালের অস্থায়ী সংবিধানের সংশোধনী বিল অনুযায়ী এ বছরের ১০ এপ্রিল নির্বাচনের মাধ্যমে নেপালের গণ পরিষদ গঠিত হয়। যদিও গণ পরিষদের প্রথম অধিবেশনের আয়োজনের আগে বেশ কিছু সমস্যা দেখা দিয়েছিল, তবে নেপালের বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের প্রচেষ্টায় ২৮ মে অধিবেশনটি অনুষ্ঠিত হয়েছে।
গণ পরিষদের প্রথম অধিবেশনের কার্যসূচী ছিল রাজতন্ত্র বিলুপ্তির সিদ্ধান্ত নেয়া এবং নেপালকে 'ফেডারেল গণতান্ত্রিক প্রজাতান্ত্রিক রাষ্ট্র' ঘোষণা করা। প্রথম অধিবেশনে পূর্বনির্ধারিত এই কার্যসূচী সম্পন্ন হলেও নেপালের সামনে এখনো অনেক কাজ বাকি। মন্ত্রিসভায় আরো ২৬ জন গণ পরিষদ প্রতিনিধিকে নিয়োগ যেমন বাকি রয়ে গেছে তেমনি রাষ্ট্র প্রধান অর্থাত্ প্রজাতন্তের প্রেসিডেন্ট এখনো নির্বাচিত হয় নি। বিভিন্ন পক্ষের মধ্যে সংবিধান সংশোধন প্রশ্নে মতভেদ এখনো রয়েছে। নির্বাচনে বিজয়ী মাওবাদী কমিউনিস্ট পার্টি সুষ্ঠুভাবে নতুন সরকার গঠন করতে পারে কিনা, এখনো তা নিশ্চিত নয়।
বিশ্লেষকরা উল্লেখ করেছেন, নেপালের নতুন যুগ শুরুর সঙ্গে সঙ্গে নেপালের বিভিন্ন পার্টি নতুন দেশের নির্মাণকাজে অংশ নেয়ার ব্যাপারে আশাবাদী ও আত্মবিশ্বাসী। এ অধিবেশনে নেপালের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী গিরিজা প্রসাদ কৈরালা বলেন, ২৮ মে হচ্ছে নেপালের নতুন যুগ শুরুর দিন। গণ পরিষদের গঠন ও প্রথম অধিবেশন আয়োজনের সঙ্গে সঙ্গে নেপালী জনগণের নিজের একটি সংবিধান প্রণয়নের স্বপ্ন বাস্তবায়িত হবে। গণ পরিষদের প্রতিনিধিরা সংবিধান প্রণয়ন ও দেশকে গড়ে তোলার গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করবেন। এর জন্য বিভিন্ন রাজনৈতিক দল অব্যাহত সহযোগিতা ও সংহতি দরকার। (ইয়ু কুয়াং ইউয়ে)
|