১৯ মে দুপুর ২টা ২৮ মিনিটে বিপদসঙ্কেত ও গাড়ির শিঙা সারা চীনে একসঙ্গে বাজে । পেইচিং শহরে লোকেরা হাতের কাজ বন্ধ করে দাঁড়ায় , রাস্তায় গাড়িরাও থেকে গেছে । এসব একটি কারণের জন্য হয় , এ দিন হল "জাতীয় শোক দিন" , এ দিন চীনারা একসাথে সি ছুয়ান ভূমিকম্পে নিহতদের জন্য শোক প্রকাশ করে । তা হল চীনের ইতিহাসে প্রথমবারের মত সাধারণ লোকজনের নিহতের জন্য "জাতীয় শোক দিন" স্থাপন করেছে । তিন মিনিটের নীরবতায় সবার শোক চিরদিনের মত ইতিহাসে থাকবে , এ দিন প্রাণের মর্যাদা ইতিহাসের সর্বোচ্চ উচ্চ পর্যায়ে বেড়েছে ।
একই দিন , পেইচিংয়ের দক্ষিণাঞ্চলে অবস্থিত পেইচিং ত্রাণ দান পরিচালনা কেন্দ্রে লিউ বাও লি সকাল থেকে অফিসে পৌঁছার পর পরই পেইচিং নাগরিকদের অসংখ্য টেলিফোন পেয়েছে । তারা ফোনে তাকে কিভাবে ত্রাণ সামগ্রী ও অর্থ দান করার পদ্ধতি জানতে চান । ঠিক ১৯ মে দুপুর ২টা ২৮মিনিটে লিউ বাও লি'র অফিসে হঠাত্ শান্ত হয়েছে ।
যখন সবাই ভূমিকম্পে নিহতদের প্রতি শোক প্রকাশ করেন এবং নীরবতা পালন করেন , তখন আমার অফিসে ফোন সবচেয়ে কম । আমি এ রুমে ছিলাম , তখন সবচেয়ে শান্ত ।
পেইচিং থেকে ওয়েন ছুয়ান প্রায় ১৫৩০ কিলোমিটার দূরে । এ দূরত্ব দুর্গত এলাকা জনগণকে পেইচিংয়ের সাধারণ মানুষের উদ্বেগ বিভক্ত করে নি । ভূমিকম্প প্রত্যেক সাধারণ পেইচিং নাগরিকদের হৃদয়ও কম্পন করেছে । পেইচিং দান কেন্দ্রে লিউ পাও লি অসংখ্য পেইচিং নাগরিকদের ফোন পেয়েছেন ।
এ নাগরিক শুনেছেন যে ভূমিকম্প দুর্গত এলাকায় জনগণের স্বাস্থ্য অবস্থা ততটা ভালো নয় । তাই তিনি দুর্গত এলাকায় প্রয়োজনীয় পানি ও ডিসিনফেক্টারসহ দৈন্দিন পণ্য দান করতে চান । এমন হৃদয়বান লোকজনের ফোন প্রতিদিন অনেক ।
লিউ পাও লি ভূমিকম্পের বিপর্যয় ঘটার পর প্রতিদিন সাধারণ পেইচিং নাগরিকদের ফোন ধরেন এবং তাদেরকে দানের পদ্ধতি জানান । এ দিকে তার অফিসের বিপরিতে ঔ অফিসে অনেকেই সরাসরি অর্থ ও সামগ্রী দান করেন । তাদের মধ্যে রয়েছে শিল্প প্রতিষ্ঠান , অবসর নেয়ার বৃদ্ধা এবং শিশু , যদিও তাদের মধ্যে কেউ কেউ এখন পেইচিংয়ের বাইরে আছেন , তারা পেইচিংয়ে তাদের বন্ধুদেরকে তাদের পক্ষ থেকে দান করার অনুরোধও করেন । যাতে দুর্গত এলাকার জনগণকে সামান্য কিছু করতে পারে । দান কেন্দ্রে আমরা পেইচিংয়ের দ্বিতীয় রেলপথ মাধ্যমিক স্কুলের কার্যালয়ের পরিচালক ম্যাডাম ইউয়েনকে দেখেছি । তিনি তার স্কুলের অবসর নেয়া দু'জন কর্মীদের পক্ষ থেকে দান করেছেন। তিনি বলেন :
তারা এখন হু পেই প্রদেশের উ হানে আছেন । তারা ভূমিকম্পের পর আমাকে ফোন করেছেন এবং বলেছেন , দুর্গত এলাকার জনগণ বিপর্যয়ে পড়েছে দেখে আমরা খুব মর্মাহত হয়েছি । আমরা এখন পেইচিংয়ে নয় , তবে আমরা নিজের ভূমিকা পালন করতে চাই । আমরা ১০ হাজার ইউয়ান দান করবো । যাতে দুর্গত এলাকার জনগণের পুণর্নির্মাণে কিছু সাহায্য করতে পারি । তারা স্বামী স্ত্রী । স্বামীর নাম ওয়াং বাই থিয়েন, তার বয়স ৮০ বছর , তার স্ত্রীর বয়স ৭৮ বছর । ওয়াং বাই থিয়েনের পা আগেই আহত ছিল । তিনি একজন প্রতিবন্ধী । জীবনযাপনের অনেক অসুবিধা আছে। তাদের বেতনও সামন্য । তবে তারা ভূমিকম্পের খবরে শুনে নিজের টাকা দান করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন । তাদের আচরণ আমাদেরকে অনেক মুগ্ধ করেছে ।
টেক্সি ড্রাইভার ওয়াং জি চোন সম্প্রতি টেক্সি চালাতে চালাতে ভূমিকম্প সম্পর্কিত রেডিও অনুষ্ঠান শুনেন । রাতে কাজ শেষে বাসায় গিয়ে টি ভি অনুষ্ঠান দেখেন। তিনি দুর্গত এলাকার জনগণের জন্য অনেক উদ্বেগ্ন । এ দিন তিনি অনেক আগেই কাজ শুরু করেছেন । দুপুরের সময় তিনি পেইচিং দান কেন্দ্রে এসেছেন । তিনি আজকে পাওয়া সব টাকা দুর্গত এলাকার জনগণকে দান করতে চান । তিনি বলেন :
আসলে এ সম্পর্কে কোনো কিছু বলার দরকার নেই । সত্যি । আজ দুপুর পর্যন্ত আমি কয়েক ডজন আয় পেয়েছি । আমি নিজের টাকা নিয়ে মোট এক শো টাকা করে দান করেছি । আসলে আমি টাকা এখানে রেখে সজা চলে যেতে চাই । তবে এখানকার কর্মী আমাকে বলেন , না , আপনাকে দানের সার্টিফিকেট দিতে হয় । আমরা খুব সামান্য কিছু আয় পাই । প্রতিদিন রাতে আমি টি ভি অনুষ্ঠান দেখতে দেখতে চোখে পানি আসে । আগে আমি কখনই টাকা দান করি নি । তবে এ বিপর্যয় আমাকে মুগ্ধ করেছে ।
ওয়াং জি চোন দান কেন্দ্রে আসার আরেকটি কারণ হল তিনি ১৯৭৬ সালের ভয়াবহ থাং সান ভূমিকম্পের প্রতক্ষদর্শী । ভূমিকম্প সম্পর্কিত মর্মাহত স্মৃতির কারণে তিনি সিদ্ধান্ত নিয়েছেন যে নিশ্চয়ই দুর্গত এলাকার জনগণকে সাহায্য করতে হয় । তিনি বলেন :
ছোটবেলায় আমি থাং সান ভয়াবহ ভূমিকম্প উপভোগ করছিলাম । তখন পেইচিংয়ে কিছু কিছু বাড়িঘরও ধ্বংসিত হত । তখন তথ্য মাধ্যমের প্রচারের অবস্থা বর্তমানের চেয়ে ততটা উন্নত নয় । তবে আমি টি ভিতে দেখেছি সৈন্যদের কোনো যন্ত্রপাতি নেই , নিজের হাতেই ধ্বংসস্তূপ থেকে লোকজনের উদ্ধার করে । আমি তা দেখে খুব মর্মাহত । এখন এমন দুর্ঘটনা পুনরায় ঘটে । যদিও আমি কখনই কাঁদে নি । তবে এবার আমিও এমন অবস্থা দেখে অনেক মুগ্ধ হয়েছি । আমার বেতন ততটা বেশি নয় । তবে এতে আমি নিজের ভূমিকা পালন করতে চাই ।
দান কেন্দ্রে আরো বেশি পেইচিং নাগরিক টাকা বা সামগ্রী দান করার পর সজাই চেলে গেছেন । নিজের নামও রেখেন নি । সাংবাদিকদের প্রশ্নে তারা শুধু হাসির মুখ দেখান । তাদের কথাও প্রায় একই , তা হল : আসলে কোনো কিছু বলার দরকার নেই । এক জায়গায় দুর্গত হলে আমাদের সাহায্য করা উচিত ।
ভূমিকম্পের পর শুধু কয়েক দিনের মধ্যে পেইচিংয়ে বহু পরিমাণের ত্রাণ সামগ্রী ও অর্থ সংগ্রহ হয় । তা সব হুদয়বান পেইচিং নাগরিকদের ভালোবাসা । প্রতিদিন বিশেষ ত্রাণ ট্রেন পেইচিং থেকে এসব ত্রাণ সামগ্রী বহন করে দুর্গত এলাকায় যায় এবং দুর্গত এলাকার জনগণকে আশা , উষ্ণ ভালোবাসা ও মুগ্ধ পাঠায় । পেইচিং দান কেন্দ্রের উপ পরিচালক ছেং লি ইয়ানের কাছ থেকে আমরা সর্বশেষ দান তথ্য পেয়েছি।
সারা দেশের মধ্যে পেইচিং সবচেয়ে অল্প সময়ের মধ্যে দুর্গত এলাকায় ওষুধসহ প্রয়োজনীয় ত্রাণ সামগ্রী পাঠিয়েছে । ১২ মে অর্থাত্ ভূমিকম্প হওয়ার এই দিনে প্রথম দফা ত্রাণ সামগ্রী ইতোমধ্যেই পাঠানো হয় । ১৬ মে দ্বিতীয় দফার সামগ্রীও পাঠানো হয়েছে । এসব সামগ্রী প্রধানত ওষুধ ও দৈনন্দিন পণ্যদ্রব্য । এখন পর্যন্ত প্রায় ৫০ ক্যারিজেরও বেশি সামগ্রী পাঠানো হয়েছে । ত্রাণ অর্থের গ্রহণ ক্ষেত্রে সারা পেইচিং শহরের ২ হাজারেরও বেশি কমিউনিটিতে চারটি দান নেট গঠিত হয় । এতে পেইচিং নাগরিকদের দান করার অনেক সুবিধা হয় । লোকেরা প্রতিদিন খুব সক্রিয়ভাবে অর্থ দান করেন এবং নিজের ভালোবাসা প্রকাশ করেন । ১৯ মে সন্ধ্যা ৭টা পর্যন্ত পেইচিং শহরে মোট ৮১ কোটি ত্রাণ অর্থ পাওয়া হয় । সম্প্রতি আমরা দুর্গত এলাকায় ৯ কোটিরও বেশি ইউয়ান মূল্যের ত্রাণ সামগ্রীও পাঠিয়েছি । এসব যোগে ৯০ কোটি ইউয়ান ছাড়িয়েছে ।
৯০ কোটি হাজার , তা শুধু একটি সংখ্যান নয় , তা অসংখ্য সাধারণ লোকজনের ভালোবাসার প্রতীক । দুর্গত এলাকার জনগণের জন্র তা যেন স্বাজনের যত্নের মত । আমরা পেইচিং দান কেন্দ্র থেকে এ তথ্য পেয়েছি যে , পরবর্তী পর্যায়ে পেইচিং দান কেন্দ্র সি ছুয়ান প্রদেশের বেসামরিক প্রশাসন ব্যুরোর সঙ্গে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ বজায় রাখবে । যাতে সেখানকার লোজকনের চাহিদা জানতে পারে এবং পরিস্থিতি অনুযায়ী সংশ্লিষ্ট দান অনুষ্ঠান আয়োজন করতে পারে ।
এখানে আমরা অনুষ্ঠানের মাধ্যমে দুর্গত এলাকার জনগণকে বলতে চাই , আপনারা একাই বিপর্যয় মোকাবেলা করছেন তা নয় , আমরা আপনাদের সঙ্গে আছি , আমাদের ভালোবাসা আপনাদের সঙ্গে আছি । যখন দুর্ঘটনা সি ছুয়ানের ওপর আঘাত হানে , যখন বিপর্যয় সাধারণ লোকজনের হৃদয়ে আঘাত হানে , কেউ পালিয়ে যান নি । এমন সময় আমরা হাতে হাত মিলিয়ে যৌথভাবে দুর্ঘটনার মোকাবেলা করার সিদ্ধান্ত নিয়েছি । কারণ , আমাদের দৃঢ় বিশ্বাস , বৃদ্ধির পর নিশ্চয়ই রংধনু দেখা যাবে ।
|