চীনের সিছুয়ান প্রদেশের ওয়েনছুয়ানে ভয়াবহ ভূমিকম্পের ৯ দিন পার হলো ২১মে। এ ৯ দিনে ভূমিকম্প দুর্গত অঞ্চলের সাধারণ মানুষ নিজেরা যেমন বাঁচার জন্যে সংগ্রাম করেছে তেমনি পরস্পরকে উদ্ধারের কাজ চালিয়ে গেছে। চীন উদ্ধার ও ত্রাণ কাজের জন্য সারা দেশের শক্তি নিয়োগ করেছে। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ও সহায়তার হাত বাড়িয়ে দিয়েছে। দুর্যোগ মোকাবিলায় মানবজাতির মানবতাবাদী শক্তির প্রমাণ দিয়েছে। মানবতার শক্তিই পারে জীবনের প্রতি সর্বোচ্চ সম্মান প্রদর্শন করতে।
'মানুষের প্রাণ উদ্ধার করা হচ্ছে আমাদের এবারের উদ্ধার ও ত্রাণ কাজের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিক। ক্ষীণতম আশা থাকা পর্যন্ত আমরা প্রাণ বাঁচানোর জন্য সর্বাত্মক চেষ্টা করবো।'
এতোক্ষণ আপনারা চীনের প্রধানমন্ত্রী ওয়েন চিয়া পাওয়ের কথা শুনলেন। তিনি ১৪ মে সকালে সিছুয়ান প্রদেশের পেইছুয়ান জেলার পেইছুয়ান মাধ্যমিক স্কুলে উদ্ধারকারী সশস্ত্র পুলিশ ও দমকলকর্মীদেরকে এই কথা বলেন। ভূমিকম্প কবলিত অঞ্চলে উদ্ধার ও ত্রাণ কাজ পরিচালনার সময় প্রধানমন্ত্রী ওয়েন বহু বার জোরালো ভাষায় বলেছেন, প্রাণ উদ্ধার করা হচ্ছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ। খারাপ আবহাওয়া ও সড়ক যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন থাকা সত্ত্বেও চীনের উদ্ধারকারীরা পায়ে হেঁটে কিংবা জলপথে বা বিমানে করে অতি দ্রুত দুর্গত অঞ্চলে গেছেন। উদ্ধারকারীদের সময়ের সঙ্গে যুদ্ধ করে জীবন বাঁচানোর সংগ্রাম হচ্ছে প্রাণের প্রতি সর্বোচ্চ সম্মানের নিদর্শন।
ভূমিকম্প পীড়িত অঞ্চলে আমরা সাধারণ মানুষকে অনেক হৃদয়স্পর্শী ঘটনার জন্ম দিতে দেখেছি। ভূমিকম্প হওয়ার সময় দেইয়াং শহরের তুংছি মাধ্যমিক স্কুলের শিক্ষক থান ছিয়ান ছিউ দু'হাত দু'দিকে ছড়িয়ে দিয়ে একটি পড়ার টেবিল আগলে উবুড় হয়ে পড়ে ছিলেন। তাঁর চার জন ছাত্র ঔ টেবিলের নিচে লুকিয়ে ছিলো। তাদেরকে বাঁচাতে তিনি নিজেকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করেছেন। কিন্তু শিক্ষক থান চিরকালের জন্য বিদায় নিয়েছেন। প্রবল ভূমিকম্পের সময় তুচিয়াংইয়ান শহরের গণ হাসপাতালে পাঁচ জন শৈল্য চিকিত্সক রোগীকে রক্ষার জন্য সবাই অস্ত্রোপচার-টেবিল আগলে ধরে উবুড় হয়ে ছিলেন। এই সাহস ও দায়িত্ববোধ হচ্ছে মানবতাবাদ।
দুর্যোগ মোকাবেলায় সকলের সম্মিলিত চেষ্টা ও সংহতি দরকার। ওয়েনছুয়ান ভূমিকম্পের পর চীনের জনগণ নজিরবিহীন দ্রুততায় উদ্ধার ও ত্রাণ কাজ শুরু করেন। ছেংতু, পেইচিং, কুয়াংচৌসহ অনেক শহরের অধিবাসীরা স্বতঃস্ফুর্তভাবে রক্তদান কেন্দ্রে গিয়ে দুর্গত অঞ্চলের আহতদের জন্য রক্ত দিয়েছেন। অল্প কয়েক দিনের মধ্যে ছেংতু ও পেইচিং শহরের রক্ত ভান্ডার ভরে গেছে। আরো অনেক মানুষ তার সঙ্গে যোগাযোগের ঠিকানা ও ফোন নম্বর লিখে রাখছেন। তারা বলেন, প্রয়োজনে যে কোন সময় এসে তারা রক্ত দান করবেন। রক্ত দেওয়ার জন্য অপেক্ষামান ছেংতু শহরের একজন অধিবাসী সংবাদদাতাকে বলেন, 'দুর্গত অঞ্চলের অবস্থা গুরুতর। আমরা নিজের সামান্য শক্তি দিয়ে যারযার অবদান রাখতে চাই। যাদের সাহায্য দরকার, তাদের জন্য কিছু করাটা এক ধরনের সংহতি ও নৈতিক মনোবল।'
চীনের রেড ক্রস সোসাইটি জানায়, ভূমিকম্প দুর্গত অঞ্চলের জন্য অর্থ সাহায্য দেয়ার আহ্বান জানানোর পর মাত্র তিন দিনের মধ্যে কেবল চীনের রেড ক্রস সোসাইটির মাধ্যমে ৬২ কোটি ৪০ লাখ ইউয়ান সংগৃহীত হয়েছে।
বিদেশে অবস্থানরত প্রবাসী চীনা ও চীনা বংশোদ্ভুতরাও দ্রুত সাহায্য তত্পরতা শুরু করেন। চীনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্র জানা গেছে, ওয়েনছুয়ান ভূমিকম্পের পর বিদেশে প্রবাসী চীনা ও চীনা বংশোদ্ভুত, চীনা বিনিয়োগের প্রতিষ্ঠান, বিদেশে অধ্যয়নরত চীনা ছাত্রছাত্রীরা সক্রিয়ভাবে চীনের প্রতিনিধিত্বকারী সংস্থায় যান। তারা দেশের প্রতি গভীর ভালোবাসা ও দুর্গত অঞ্চলের জনগণের প্রতি সমবেদনা এবং নিঃস্বার্থ সাহায্য দেয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করেন।
মানবিক শক্তি দেশের সীমারেখার উর্ধে।
১৫ মে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইউসুফ রাজা গিলানি পাকিস্তানে চীনা দূতাবাসে যান। তিনি চীনের সিছুয়ানে ভয়াবহ ভূমিকম্পের ঘটনায় সমবেদনা জানান। প্রধানমন্ত্রী গিলানি চীনের কূটনীতিবিদদের বলেন, 'চীনা জনগণের জানমালের ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। এই ক্ষয়ক্ষতি যেন পাকিস্তানের জনগণের ক্ষয়ক্ষতির মতোই। এ কঠিন সময় পাকিস্তান সরকার ও জনগণ আপনাদের সঙ্গে আছে এবং আপনাদেরকে সমর্থন দিয়ে যাবে। আমরা সর্বাত্মক সাহায্য করে যাবো।'
ওয়েনছুয়ান ভূমিকম্পের পর বিভিন্ন দেশের সরকার ও জনগণ পৃথক পৃথকভাবে চীনকে সমবেদনা জানিয়েছে এবং বিপুল পরিমাণ সহায়তা দিয়েছে। অনেক দেশের সরকার সমবেদনা বার্তা পাঠিয়েছে। আরো অনেক দেশ ও আন্তর্জাতিক সংস্থা চীনের ভূমিকম্প দুর্গত অঞ্চলকে অর্থ সাহায্য দিয়েছে। ১৬ মে জাপানের প্রথম দফা ৩১ জন পেশাদার উদ্ধারকর্মীর একটি দল দুর্গত অঞ্চলে পৌঁছেছে। রাশিয়া, দক্ষিণ কোরিয়া ও সিঙ্গাপুরের উদ্ধারকারীরা যথাক্রমে দুর্গত অঞ্চলে পোঁছেছেন। প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলায় রাষ্ট্রীয় সীমারেখা অতিক্রম করে সেবা ও সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেওয়াই হচ্ছে মানবতা।
মানবতাবাদী শক্তি হচ্ছে সবসময় জীবনমুখী। আশাবাদী মনোভাব নিয়ে কাজ করে যাওয়া এবং কখনোই হতাশ হয়ে পরিত্যাগ না করা।
১৪ মে ভোরে আরেকটি শিশু সিছুয়ান প্রদেশের শিশু ও মাতৃ মঙ্গল কেন্দ্রে জন্ম নিয়েছে। শিশুটির মা হচ্ছেন তুচিয়াংইয়ান থেকে আসা ওয়াং শিয়াও শান। ভূমিকম্প দুর্যোগে আমরা যেমন নিহতদের জন্য নিরবতা পালন করছি ঠিক তেমনি নতুন প্রাণ ওয়েনছুয়ান ভূমিকম্প দুর্গত অঞ্চলে জন্ম নিচ্ছে। অনেক বাচ্চার বাবা-মা জানিয়েছেন, তারা তাদের বাচ্চার নাম দেবেন 'চেন শেং' অর্থাত্ ভূমিকম্পের মধ্যে জন্ম হওয়া। (ইয়ু কুয়াং ইউয়ে)
|