এতক্ষণ আপনারা যা শুনেছেন , তা হলো চীনের তিব্বত স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চলের লাসা শহরের একটি লোক শিল্পী দলের পরিবেশিত তিব্বতী অপেরার একটি অংশের রেকর্ডিং। তিব্বতী অপেরা তিব্বতী জাতি অধ্যুষিত অঞ্চলগুলোতে খুব জনপ্রিয় । নাচ ও গান ভিত্তিক অনুষ্ঠান এই অপেরার একটি বৈশিষ্ট্য । গত কয়েক বছরে তিব্বতের আর্থ-সামাজিক অগ্রগতি এবং উন্মুক্তকরণ ক্রমাগত দ্রুততর হওয়ার কারণে একটি প্রাচীন সংস্কৃতি হিসেবে তিব্বতী অপেরা বেশ সবর হয়ে উঠেছে । তিব্বতী অপেরার বিলুপ্ত হয়ে যাওয়া বহু অনুষ্ঠান আবার জীবন্ত হয়ে উঠেছে । চিজা এমন একজন তিব্বতী নাগরিক যিনি প্রায় ৩০ বছর ধরে তিব্বতী অপেরা পরিবেশন করেছেন । তিনি বলেন , তিব্বতী অপেরা চর্চা ও পরিবেশনকালে তিনি খুব আবেগপূর্ণ থাকেন ।
তিনি ছোট বেলা থেকেই তিব্বতী অপেরা পরিবেশন করতে পছন্দ করেন । তখন শুধু নিজের আনন্দের জন্য তিনি তিব্বতী অপেরার অভিনয় চর্চা করতেন । শিল্পী দলের সদস্য হওয়ার পর তিনি পেশাগতভাবে তিব্বতী অপেরার অনুষ্ঠান চর্চা ও পরিবেশন শুরু করেন । বর্তমানে বহু সংখ্যক দেশী-বিদেশী পর্যটক তিব্বতী অপেরা উপভোগ করতে পছন্দ করেন । শিল্পী দলের সদস্য সংখ্যা ক্রমাগত বেড়েছে , তাদের আয়ও বৃদ্ধি পেয়েছে । তিব্বতী অপেরা যে এত বিকাশ লাভ করেছে , তার মূলে রয়েছে সংখ্যালঘু জাতির ঐতিহ্য বিকশিত করার বিষয়ে সরকারের উদার ও সহায়ক নীতি । সরকারের লালন পালন ও উত্সাহের মাধ্যমে তিব্বতের প্রাচীন সংস্কৃতি ও শিল্পকলা আরো প্রসারিত হয়েছে । চিজার মতো বহু তিব্বতী শিল্পীরা এখন স্বাচ্ছন্দ্যে তাদের পছন্দের ঐতিহ্যবাহী অপেরা চর্চা ও পরিবেশন করতে পারছেন ।
৮৫ বছর বয়স্ক সামড্রুপ তিব্বতী জাতির একজন বিখ্যাত প্রবীণ লোকশিল্পী । তিনি তিব্বতী মহা -কাব্য - রাজা গেসার পরিবেশনে পারদর্শী । রাজা গেসারের মতো উত্কৃষ্ট তিব্বতী মহাকাব্য যাতে বংশ পরম্পরায় উত্তরাধিকার সূত্রে গ্রহণ করা যেতে পারে , সেজন্য স্থানীয় সরকারের আমন্ত্রণে তিনি ও অন্যান্য তিব্বতী শিল্পীরা তিব্বত বিশ্ববিদ্যালয় ও তিব্বত সমাজ বিজ্ঞান একাডেমীসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের আয়োজনে গিয়ে তিব্বতী অপেরা পরিবেশন করে থাকেন । এর পাশাপাশি সংশ্লিষ্ট বিভাগ তাদের থাকা-খাওয়া ও যোগাযোগের ব্যবস্থা করে এবং উপযুক্ত ভর্তুকি দেয় । ১৯৮০ সাল থেকে তিব্বত প্রতি বছর রাজা গেসার মহাকাব্য বিষয়ক দু' একটি বই প্রকাশ করে । এ পর্যন্ত তিব্বতে রাজা গেসার সংক্রান্ত মোট ৩০ খন্ড বই প্রকাশিত হয়েছে । রাজা গেসার মহাকাব্য শিল্পীদের মৌখিক পরিবেশিত তথ্যের ওপর নির্ভর করে প্রচলিত । বর্তমানে রাজা গেসার বেশির ভাগ শিল্পীদেরই বয়স হয়েছে । তাদের মধ্যে কেউ কেউ মারা গেছেন । এটা এই মহাকাব্য প্রচলনের জন্য বিপুল বাধা-বিঘ্ন ডেকে এনেছে । তিব্বত স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চলের সংখ্যালঘু জাতি গবেষণাগারের অধ্যাপক রিগজিন বলেন ,
বর্তমানে শিল্পীদের অনুষ্ঠানঅডিও ভিডিও পদ্ধতিতে বজায় রাখা খুবই প্রয়োজন । এসব গল্প প্রকাশনালয়ের মাধ্যমে প্রকাশ করাও খুব দরকার । পরিকল্পনা অনুযায়ী ৫ থেকে ৮ বছরের মধ্যে প্রকাশনালয় সংস্থা সামড্রুপের পরিবেশিত ষাটেরও বেশি গল্প প্রকাশ করবে । দীর্ঘকাল ধরে তিব্বতীরা তাদের বুদ্ধি ও প্রতিভা দেখিয়ে আসছেন । এতে তিব্বতী জাতির সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকার বিপুলভাবে সমৃদ্ধ হয়ে উঠেছে । তিব্বতী অপেরা ও রাজা গেসার মহাকাব্য ছাড়া তিব্বতের লোকনৃত্য , প্রবাদ ও সংগীতের বয়সও অনেক পুরানো । বর্তমানে বিপুল সংখ্যক লোক তিব্বতের ঐতিহ্যবাহী সংস্কৃতি ও শিল্পকলা সংরক্ষণে অংশ নিচ্ছেন । তারা তিব্বতের প্রাচীন ও মূল্যবান সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকার সংরক্ষণ ও বিকাশের জন্য অবদান রেখেছেন । গত বিশ বছরেরও বেশি সময় ধরে তিব্বত স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চলের সমাজ বিজ্ঞান একাডেমীর আচার ব্যবহার গবেষণা ক্ষেত্রের অধ্যাপক সেরিং পুন্টসোক্ তিব্বতের লোক সাহিত্য ও শিল্পকলা সমৃদ্ধ করে তোলার কাজে নিয়োজিত রয়েছেন । তিনি বলেছেন , চীন সরকার তিব্বতের লোক সাহিত্য ও শিল্পকলা সংরক্ষণ ও সমৃদ্ধ করে তোলার ওপর খুব গুরুত্ব দিয়েছে ।
গত শতাব্দির আশির দশকের শেষ দিক ও নব্বইয়ের প্রথম দিকে তিব্বতের বিভিন্ন অঞ্চল , শহর ও জেলায় তিব্বতী জাতির সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকার সংরক্ষণের একটি অভিযান চালানো হয়েছে । এ ক্ষেত্রে সংগ্রহ , সংশোধন , গবেষণা , সম্পাদনা ও বই প্রকাশের মাধ্যমে তিব্বতী জাতির লোক সাহিত্য ও শিল্পকলা অভূতপূর্ব সাফল্য অর্জন করেছে । তিব্বতে পোতালা ভবন , নরবু লিংখা ও সাগিয়া মন্দিরের মতো বহু প্রসিদ্ধ পুরাকীর্তি রয়েছে । এ সব পুরাকীর্তিতে স্থানীয় সংস্কৃতি ও ধর্ম বিশ্বাসের বৈশিষ্ট্য তুলে ধরা হচ্ছে । তিব্বত স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চলের সংস্কৃতি বিভাগের কর্মকর্তা সিং কাও সু বলেন , বহু বছর ধরে চীনের কেন্দ্রীয় ও স্থানীয় সরকার এই সব মন্দিরের সংস্কার ও মেরামতের জন্য বিপুল পরিমান অর্থ বরাদ্দ করেছে।
১৯৪৯ থেকে ২০০৫ সাল পর্যন্ত তিব্বতে চীন সরকার পুরাকীর্তি সংস্কার ও মেরামতের ক্ষেত্রে ৫০ কোটি ইউয়ানেরও বেশি অর্থ বরাদ্দ করেছে । একাদশ পাঁচসালা পরিকল্পনার মেয়াদ অর্থাত্ ২০০৬ থেকে ২০১০ সাল পর্যন্ত তিব্বতের বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ পুরাকীর্তি সংরক্ষণের ব্যাপারে ৬০ কোটি ইউয়ানেরও বেশি অর্থ বরাদ্দ করবে । চীন সরকার অবস্তুগত উত্তরাধিকারের জরিপ ও সংরক্ষণের কর্মসূচী চালু করার পাশাপাশি তিব্বতের স্থানীয় সরকার কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে তিব্বতের দুই দফা অবস্তুগত সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকার রক্ষার আবেদন জানিয়েছে । প্রথম দফায় ১৪টি প্রধান পুরাকীর্তি অন্তর্ভুক্ত হয়েছে । দ্বিতীয় দফার তালিকা এবছরের শেষ নাগাদ প্রকাশিত হবে । গত কয়েক বছরে তিব্বতের উন্মুক্তকরণ আরো সম্প্রসারিত হয়েছে । ফলে বিপুল সংখ্যক দেশী-বিদেশী পর্যটক তিব্বত ভ্রমণে আসছেন এবং বিদেশের সঙ্গে তিব্বতের সাংস্কৃতিক বিনিময়ও দ্রুত বৃদ্ধি পাচ্ছে ।
(থান ইয়াও খাং)
|