দক্ষিণ পশ্চিম চীনের কুয়াংশি জুয়াং জাতির স্বায়ত্ব শাসিত অঞ্চলের ফাংজেংকাং শহরের ওয়ান হে পাহাড় আগে ছিল একটি অজানা ছোটো পাহাড় । কবে থেকে প্রচুর বক পাখি যে এখানে এসে থাকতে শুরু করে তা কেউ সঠিকভাবে বলতে পারে না ।স্থানীয় অধিবাসীরা এখন ছোটো পাহাড়কে ওয়ান হে পাহাড় বলে ডাকেন । চীনা ভাষায় হের মানে সারস । কৃষক সু জিয়াঙ বাংয়ের পরিবার থাকে এই পাহাড়ের পাদদেশে ।
ফাংজেংকাং শহরের ওয়ান হে পাহাড় নাতিশীতোঞ্চু এলাকায় অবস্থিত । প্রত্যক বছরের এপ্রিল মাসের প্রথম দশদিনে হাজার হাজার সাদা বক উড়ে আসে রৌদ্রদগ্ধ দক্ষিণাঞ্চল থেকে ।
সু জিয়াঙ বাং বলেছেন ,১৯৫২ সালে তাঁর পরিবার ওয়ান হে পাহাড়ের পাদদেশে স্থানান্তরিত হয় । সেই বছরের এপ্রিল মাসের একদিন । ভোরবেলায় সু জিয়াঙ বাংয়ের নানা সু ইয়ং ইং পাখীর ডাকে জেগে উঠলেন , বিছানা থেকে ওঠে পাহাড়ের দিকে তাকিয়ে দেখা গেল , কয়েকটি পাখী গাছের শাখায় লাফাছে ,তাদের পালক সাদা , পা লম্বা ও ঠোঁট সরু । সু ইয়ং ইং আগে কখনো এই পাখী দেখেন নি ।তবে যতটুকু তাঁর মনে পড়ে , আগে তিনি কোনো একটি ছবিতে এই পাখী দেখেছিলেন , এটা সারস না ?তিনি মনে মনে নিজেকে জিজ্ঞেস করলেন ।তারপর আনন্দের আতিশয্যে গদগদ হলেন ,হ্যাঁ সারসই । চীনাদের ধ্যানধারনায় সারস মংগলের প্রতীক । সু ইয়ং ইং অবিলম্বে তাঁর বাড়িতে একটি সভা ডেকে যে তিনটা নিষেধাজ্ঞাজারি করলেন তা হলো : সারস মারা চলবে না , সারস শিকার করা চলবে না এবং সারসের নীড় থেকে ডিম চুরি করা চলবে না ।এরপর তাঁর পরিবারের সদস্যরা প্রায় ৫০ বছর ধরে পাখী সংরক্ষনে আত্মনিয়োগ করলেন ।
সেই পারিবারিক সভা ডাকার সময়ে সু জিয়াঙ বাংয়ের বয়স মাত্র ১৪ বছর ।
পরে জানা গেল , সু জিয়াঙ বাংয়ের পরিবার যে পাখী পালন করেছে তা যাযাবর সাদা বক ,সারস নয় ।সাদা বক জাতীয় পর্যায়ে সংরক্ষিত পাখীগুলোর অন্যতম ।
সাদা বক প্রতিবছরের এপ্রিল মাসে ওয়ান হে পাহাড়ে উড়ে আসে ডিম পাড়ে ডিমে তাপ দেয় । বছরের শেষ দিকে বাচ্চ পাখী উড়তে পাড়লে শীতকাল কাটানোর জন্য মা-বক তাকে নিয়ে দক্ষিণাঞ্চলে উড়ে যায় । তবে কোনো কোনো সাদা বক স্থানীয় আবহাওয়ার সংগে নিজেকে মানিয়ে নিয়েছে বলে সেখানে থেকে যায় । বছরের পর বছর সু জিয়াঙ বাংয়ের পরিবার সাদা বক সংরক্ষনের চেষ্টার ত্রুটি করেন নি । তাঁদের চোখে সাদা বক তাদের পরিবারের সদস্য ,তাদের জীবনে প্রচুর আনন্দ যুগিয়েছে ।
সাদা বক যাতে নিরিবিলি পরিবেশে থাকে তার জন্য সু জিয়াঙ বাংয়ের পরিবার প্রতি বছরে ওয়ান হে পাহাড়ে গাছ ও বাঁশ লাগায় ।তিনি বলেছেন :আমরা সাধ্যমত গাছ লাগাচ্ছি ,যত বেশী গাছ লাগানো হয় ততবেশী সাদা বক এখানে আসে ।
গত ৫০ বছরে সু জিয়াঙ বাংয়ের পরিবার অজস্র বট গাছ, পাইন গাছ ও বাঁশের চারা লাগিয়েছে , ফাংজেংকাং শহরের গণ সরকার বিনা মাসুলে তাঁর পরিবারের জন্য গাছের চারা সরবরাহ করেছে। এখন ওয়ান হে পাহাড় সবুজ বাশঁ ও গাছে ছেয়ে গেছে ।এই আরামদায়ক পরিবেশে সাদা বকের দ্রুত বংশবিস্তার হয়েছে । গত শতান্দীর পঞ্চাশের দশকে সেখানে মাত্র এক জাতের বিশ তিরিশ টি সাদা বক আসত ,কিন্তু এখন তিরিশটিরও বেশী জাতের প্রায় ২৫ হাজার সাদা বক প্রতিবছরে আসে ।
কোনো সাদা বক গোপন শিকারীর গুলিতে বা ঝড়বৃষ্টিতে আহত হলে সু জিয়াঙ বাংয়ের পরিবারের সদস্যরা আহত সাদা বককে কোলে করে বাড়ীতে নিয়ে যান । মাছ সাদা বকের প্রধান খাদ্য ।সাদা বক পুষার জন্য সুজিয়াঙ বাংকে নদীতে জাল ফেলে মাছ ধরতে হয় । প্রচন্ড ঝড়ে আহত হ্ওয়া অনেক বাচ্চা সাদা বক পোষতে তাঁকে মাঝে মাঝে বাজার থেকে মাছ কিনতেও হয় । ফলে তাঁর দৈনন্দিন খরচ অনেক বেড়েছে ।
সুজিয়াঙবাংয়ের নাতি সু ইয়ু জাং স্কুলে পড়াশোনা করছে । আহত সাদা বকের প্রতি তার মায়া-মমতা হয়েছে । স্কুলছুটির পর বাড়িতে ঢুকলে তার কাছ থেকে খাবার পাওয়ার আশায় সাদা বক তার পিছনে ছুটাছুটি করে ।আহত সাদা বকের যত্ন নেয়ার প্রাথমিক জ্ঞান এখন তার হয়েছে ।
সু ইয়ু জাং বলেছে , সে জানে , সাদা বক আহত হলে তাকে বাড়িতে নিয়ে তার ক্ষতস্থান কাপড় দিয়ে বাঁধতে হবে ।সে এক সময়ে আটটি আহত সাদা বক পুষেছে এবং প্রতিদিন তাদের মাছ খাইয়েছে ।তাঁর সংগে থাকতে থাকতে কোনো কোনো বক তার হাতের ইশারার অর্থ বুঝেছে ।
সুজিয়াঙবাংয়ের পরিবার সর্বশক্তি দিয়ে যে সাদা বক সংরক্ষনের প্রচেষ্টা চালিয়ে আসছেন তা সমাজের সমর্থন ও প্রসংশা পেয়েছে ।১৯৯৩ সালে ফাংজেংকাং শহরের গণ সরকার ওয়ান হে পাহাড়কে প্রাকৃতিক সংরক্ষণ এলাকায় অন্তর্ভুক্ত করে সেখানে বক শিকারের উপরে নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে ।গত ফেব্রুয়ারী মাসে চীনের জাতীয় পরিবেশ সংরক্ষণ অধিদফতর সুজিয়াঙবাংকে পরিবেশ সংরক্ষণের অনন্য কীর্তি স্থাপনকারীর মর্যাদা দিয়েছে ।
প্রতি বছরের শরতকাল ও শীতকাল সাদা বক পালে পালে ওয়ান হে পাহাড় ছেড়ে উড়ে যায় ।তখন সুজিয়াঙবাংয়ের পরিবারের সদস্যদের বুকটা খুবই ফাঁকা ফাঁকা লাগে । ৫০ বছের অতিবাহিত হয়েছে । প্রতি বছর সাদা বক পালে পালে উড়ে এলে সুজিয়াঙবাংর মন আনন্দে নেচে ওঠে , সাদা বকের পাল চলে গেলে তিনি উত্কন্ঠিত ও চিন্তিত । যখন দুরদুরান্তের আত্মীয়ের মত সাদা বকের জন্য অপেক্ষা করেন তখন তার মন অস্থিরতায় ছটফট করে।
রেকর্ডিং ৪
সাদা বক ফিরে আসার আগে আমি মনে মনে বলি ,জলদি এস, আমার ছেলে । আমার নাতিনাতনি অস্থীর হয়ে আমাকে জিজ্ঞেসকরে , নানা, সাদা বক এতদিন আসল না কেন , আসলে চিত্কার করব , ওরে সাদা বক বাড়িতে ফিরে এসেছে।
চলতি বছরের এপ্রিল মাসে হাজার হাজার সাদা বক আবার দক্ষিনাঞ্চল থেকে ওয়ান হে পাহাড়ে ফিরে এসেছে ,কোনো কোনে সাদা বক শাখে বসে বিশ্রাম করে , কোনো কোনে সাদা বক বনে ডাকতে ডাকতে উড়ে , কোনো কোনে সাদা বক বা নীড়ে ডীম পাড়ে । শীতকাল না আসার পর্যন্ত তারা প্রতিদিন সুজিয়াঙবাংয়ের পরিবারের সদস্যদের সান্নিধ্যে থাকবে ।
|