যে চীন আমার স্বপ্ন ছিল
রেহানা সুলতানা রোজি
এই সব ট্রেন দেখে দেখে মনে হতো আমার দেশেও যদি এ রকম সুব্যবস্হা সম্পন্ন বৈদ্যুতিক ট্রেন থাকতো ? তাহলে আমাদের দেশৈর মানুষ-জন ভালোভাবে যাতায়াত করতে পারতো । এমনকি খুব দ্রুত গন্তব্য স্হলে যেতে পারতো । আমাদের দেশেও আন্তনগর ট্রেন আছে, তবে বলতে গেলে তাতে যাত্রীদের জন্য তেমন একটা সুযোগ সুবিধা নেই । এখানকার দ্রুতগামী ট্রেনেতো বিমানের চেয়েও আরামদায়ক সব ব্যবস্হা ।
এখানকার রাস্তা-ঘাট বেশ প্রশস্ত এবং ফুটপাত সবুজ গাছের ছায়ায় ঢাকা । এ ছায়া অবশ্য বসন্ত এবং গ্রীষ্ম কালের কথা । শীতকালে প্রকৃতিটা একদম ভিন্ন । সব গাছই ন্যাড়া । ফুল ফল পাতা দূরে থাক নিদেনপক্ষে একটা কুঁড়িও খুঁজে পাওয়া যাবেনা । মনে হবে যেন মৃত নগরী । সে কথায় না হয় পরে যাওয়া যাবে । এখানে আমার ভালো লাগছে । যখন দেখি তরুণী থেকে বয়স্ক মহিলারা বড় বড় বাস চালাচ্ছে । কী সুন্দর ট্রেন চালাচ্ছে । সবাই মিলে মিশে কাজ করছে । রাতের বেলায় তারা সবাই একসাথে চলাফেরা করছে । কাজে ফাঁকি কী ভাবে দিতে হয় তা তারা যেন জানেনা । নারী পুরুষ সবাই মিলে কাজ করা মানেই একটা দেশের উন্নতির জন্য উল্লেখযোগ্য অবদান রাখা । একটা দেশের তর তর করে উঠে যাওয়া । শুধু অট্টালিকার সমাহার নয়, অর্থনীতিতেও তারা এখন আকাশ ছুঁই ছুঁই করছে । এই সুন্দর প্রকৃতি ও পরিবেশ সবই আমার ভাল লাগছে । বাজারে প্রচুর শাক সব্জি পাওয়া যায় । সবই টাটকা । বাজারে গেলে আমি তাল গোল পাকিয়ে ফেলি । কোনটা রেখে কোনঠা কিনবো ভেবে পাইনা । কারন সব কিছুই আমার পছন্দ । না, ভাষা জানিনা বলে বাজার করতে কোন প্রকার কষ্ট হয়না । বিশেষ করে প্রতিদিন ই ফল খাওয়ার অভ্যাস আমাদের পরিবারের সবার । ফলের দোকানে গেলে পছন্দের সব ফলই কিনতে ইচ্ছে করে । এ দেশে যে কত রকমের ফল পাওয়া যায় তা হিসেব করে দেখিনি । বেশির ভাগ ফলেরই নাম জানি না । বলতে গেলে হাজারো ফল আর স্বাদও প্রতিটারই ভিন্ন । এ এক দারুন অভিজ্ঞতা ।
দেশে থাকতে চীনা খাবারের কথা শুনলেই আমার স্বামী ও ছেলেরা খুব খুশি হতো । বাংলাদেশের সবাই চীনা খাবার খুব পছন্দ করে । অবশ্য আমাদের দেশের চাইনিজ খাবারের সঙ্গে এখানকার খাবারের অনেক পার্থক্য । আমাদের খাবারকে বাংলাদেশি স্টাইলের চীনা খাবার বলা যায় । এখানে আসার পর চীনা খাবার খেতে একটু কস্ট হতো । এখন বলতে গেলে সয়ে গেছে । উহান বিশ্ববিদ্যালয়ের ছুটির সময় আমার বড় ছেলে দীপ্ত এখানে এসে একদিন আমাকে বলে তুমিতো কখনো হট পট খাওনি , তাইনা ? আমরা রেস্টুরেন্টে রান্না করে খাবো । শুনে আমিতো অবাক ! আমি বলি তুমি রান্না শিখলে কবে ? ও বললো চলোই না দেখবে নিজে রান্না করে খাওয়ার মতই । ছেলেদের অনুরোধে শেষ পর্যন্ত গেলাম । সেদিন আমার সঙ্গে আরো গিয়েছিল বাংলাদেশ থেকে বেড়াতে আসা আমার বড় বোন মিনু আপা, তার মেয়ে তানি ও তার নাতি ..........সহ সবাই মিলে সেই মজার জিনিষটি খেতে গেলাম একটি মুসলিম রেস্টুরেন্টে । রেস্টুরেন্টটি ছিল সি আর আই'র কাছেই । আমার বড় ছেলে খাবার অর্ডার দিল । কিছুক্ষণ পর দেখি একটি পাতিলের মত চুলা নিয়ে এলো । তার পর দেখি খুব পাতলা করে কাটা কাঁচা মাংশ, সম্ভবত খাসির মাংশ, শাক সবজি, ধনিয়ার পাতা ও মশলা একটার পর একটা নিয়ে আসছে । কিছু সসও দিয়ে গেল । আমার বোন বললো কাঁচা মাংশ খাবো কী করে ? চুলা সংযুক্ত হাড়ির মধ্যে টগবগ করে পানি ফুটছে.। তার ভেতর কিছু মশলাও দেয়া আছে । আমার বড় ছেলে তার ভেতর আরো কিছু মশলার উপাদান ঢেলে দিল । এরপরে স্লাইসড মাংশ ও সব্জিসহ একটার পর একট দিচ্ছে আর সংগে সংগে উঠিয়ে খাচ্ছে । মনে হচ্ছে খুব মজা করে খাচ্ছে । সবার খাওয়া দেখে আমাদেরও খুব খেতে ইচ্ছে হলো । খেলাম বটে । ততটা স্বাদ পাইনি । তবে মশলার গন্ধটা খারাপ লাগে নি । আসলে এটাতো জীবনে প্রথমবারের মত খেলাম । হয়তো তাই । এ খাবার খেতে গিয়ে আমাদের দেশের একটা খাবারের কথা মনে পড়ে গেল । সেটা হলো চট পটি । এ খাবারে সব কাঁচা না হলেও ধনে পাতা, কাঁচা মরিচ, পেয়াজ ও কদম লেবু কাঁচাই থাকে । ডাবরি, আলু আর ডিম সিদ্ধ আগের থেকেই প্রস্তুত থাকে । এ ছাড়া আরো থাকে পাঁকা তেতুল দিয়ে বানানো পাতলা রস। দোকানে বা বিক্রয়কারীর চারপাশ ঘীরে বসে থাকা লোকজন অর্ডার দিলেই দোকানি ঝট পট প্রস্তুত করে দেয় । যেমনি গন্ধ তেমনি তার স্বাদ । জিহ্বায় পানি এসে যায় ।
চীনে আসার পর খুব একটা কোথাও বেড়াতে যাওয়া হয় নি । একদিন ইয়াও ভাই বোটানিক্যাল গার্ডেনে যাওয়ার কথা বললেন । লুফে নিলাম প্রস্তাবটি । কারণ সবাই মিলে কোথাও যাওয়ার আনন্দই আলাদা । শুনেছি এ বাগানটি খুব সুন্দর । গ্রীষ্মকালের এ সময়ও ফুলে ফুলে ছেয়ে থাকে । আমরা সবাই মিলে উৎসাহের সংগে বাসে করে রওয়ানা দিলাম । কুংজুফেন থেকে আমাদের সংগী হলেন ইয়াও ভাই এবং তার স্ত্রী । বোটানিক্যাল গার্ডেনের গেটে গিয়ে জানলাম যে, ষাট বছরের বেশি বয়স্ক এবং ছাত্রদের জন্য প্রবেশ মূল্য অর্ধেক । এ দেশে বয়স্ক ও শিশুদের প্রতি সেবামূলক সচেতন দৃষ্টি রাখা হয় । বাগানে ঢুকতেই মুগ্ধ হয়ে গেলাম । চারদিকে সবুজের সমারোহ । মাঝখান দিয়ে বয়ে গেছে একটি স্বচ্ছ জলের লেক । লেকটি জুড়ে অসংখ্য শাপলা ফুল ছড়িয়ে রয়েছে । আর সারা বাগান জুড়ে লাল, নীল, সাদা, সবুজ, কালো, হলুদ, বেগুনী ও কমলাসহ কতনা রংয়ের ফুল বাতাসের ঢেউয়ের সাথে দুলছে । শুধু ফুল আর ফুল । নানান স্বাদের সৌরভে মৌ মৌ করছে চারদিক । আমরা অনেক ছবি তুললাম । আমার কর্তাটিতো তার ক্যামেরাগুলো নিয়ে ঘুরে ঘুরে ছবি তোলায় ব্যস্ত হয়ে পড়লো । ছবি তুললাম ফুলের পাশে, লেকের পাশে, পাহাড়ের পাদদেশে আর পাহাড়ের উপরে ভাজে ভাজে । কখোনো বা পাহাড়ের পেট চিড়ে বেড়িয়ে আসা উচ্ছল ঝর্ণা ধারার পানি ছুঁয়ে। কখোনো বা আঁকাবাকা ছায়াঢাকা সবুজ পথের গাছগুলো জড়িয়ে ধরে । এ এক অনাবিল আনন্দ ।
|