এখন চীনে প্রায় ২কোটি গ্রামীন ছেলে মেয়ের বাবা মা শহরে চাকরি করছেন। সেজন্য ঐ সব ছেলে মেয়েরা হয় অন্য পরিবারে কিংবা নিজস্ব ব্যবস্থায় বসবাস করে। প্রশ্ন হচ্ছে এসব ছেলে মেয়ে কিভাবে অন্য সাধারণ ছেলে মেয়েদের মত শিক্ষা-দীক্ষা স্বাস্থ্য রক্ষা কিংবা অনন্দের সঙ্গে বড়ো হয়ে উঠবে? এটি চীনের শিক্ষা বিভাগের একটি গুরু দায়িত্বে পরিণত হয়েছে। বৃহত্তর কৃষি প্রদেশ চীনের মধ্য আঞ্চলের আনহুই এ সমস্যা সমাধানের চেষ্টা করছে। আজকের অনুষ্ঠানে আমি আপনাদেরকে আনহুই প্রদেশের লিংবি জেলার ছানথাং গ্রামাঞ্চলে কেন্দ্রীয় স্কুলে বসবাসকারী কিছু কৃষক শ্রমিকের ছেলে মেয়ের এসব সমস্যা কিভাবে সমাধান করা হচ্ছে সে সম্পর্কে কিছু জানাবো।
হাসি খুশি ছাত্রছাত্রী, ঝকঝকে ক্লাসরুম, পরিস্কার পরিচ্ছন্ন বাসস্থান ও খাবার ক্যান্টিন এবং আধুনিক খেলার মাঠ এটি হল সাংবাদিকদের চোখে ছানথাং কেন্দ্রীয় স্কুল। ছানথাং কেন্দ্রীয় স্কুলের অধ্যক্ষ চৌ ছাংবিন বলেন, কয়েক বছর আগে তাঁরা এই সরকারী প্রাথমিক স্কুলটি অবাসিক স্কুলে রুপান্তর করেছেন। এর কারণ সম্পর্কে তিনি বলেন, '২০০৪ সালে আমাদের স্কুলের একজন ছাত্রের কোনো কিছুই যেন ঠিকঠাক মতো চলছিল না। সে সবসময় দেরি করে ক্লাসে আসতো লেখাপড়ায় মনোযোগী ছিল না, ফলে ফলাফল ভালো হচ্ছিল না। আমরা জানতে পারি যে তার বাবা মা শহরে কাজ করেন। ছেলেটি তার দাদা দাদির সঙ্গে থাকতো। কিন্তু দাদা দাদি তাকে ঠিক মতো দেখাশুনা বা শাসন করতেন না।'
এরপর স্কুল কর্তৃ পক্ষ সব ছাত্রছাত্রীর মধ্যে জরিপ চালিয়ে আবিষ্কার করে যে, ছানথাং কেন্দ্রীয় স্কুলের অনেক ছাত্রছাত্রীর বাবা মা বাইরে কাজ করেন। এসব ছাত্রছাত্রীর পরিবারে প্রশিক্ষণের অভাব রয়েছে। সেজন্য গ্রামাঞ্চলে বসবাসকারী অনেক কৃষক শ্রমিকের ছেলে মেয়েদের সুষ্ঠু লালন পালন ও স্বাস্থ্য পরিচর্যা হয় না। তারা স্কুলে যাওয়া পছন্দ করে না এবং প্রায়ই স্কুল থেকে ঝরে পড়ে ও লেখাপড়া বন্ধ করে দেয়।
এ পরিস্থিতিতে ছানথাং কেন্দ্রীয় স্কুলের নেতারা ভাবলেন, এ সমস্যা সমাধান করার একমাত্র পদ্ধতি হলো স্কুলেই এ সব ছাত্রছাত্রীর বসবাস ও লেখাপড়ার ব্যবস্থা করা। ২০০৫ সালে ছানথাং কেন্দ্রীয় স্কুল আনুষ্ঠানিকভাবে গ্রামাঞ্চলে বসবাসকারী কৃষক শ্রমিকদের ছেলে মেয়েদের আবাসিক স্কুলের পরিকল্পনা শুরু করে। যাতে এ ধরণের ছাত্রছাত্রীরা ২৪ ঘন্টায় স্কুলে লেখাপড়া ও বাস করতে পারে। চৌ ছাংবিন বলেন, 'আমরা শিক্ষকদের বসতবাড়ীগুলো সম্প্রসারণ করে ছাত্রছাত্রীদের বাসস্থানে ও কোনো কোনো ক্লাসরুমকে ক্যান্টিন হিসেবে পুনর্নির্মাণ করেছি। এর মাধ্যমে ছাত্রছাত্রীদের আবাসিক ও খাদ্য সমস্যা সমাধান করা হয়েছে। এছাড়াও আমরা ৫জন বিশেষ শিক্ষিকা নিযুক্ত করে ছাত্রছাত্রীদের বসবাস তত্ত্বাবধানের দায়িত্ব দিয়েছি। এ ৫জন শিক্ষিকা মায়েদের মতো করে ছাত্রছাত্রীদেরকে পরিচর্যা করেন।'
চৌ ছাংবিন আরো বলেন, পেশাগত রাঁধুনি নিযুক্ত করে ছাত্রছাত্রীদের জন্য রুচিসম্মত ও সুস্বাদু খাবার রান্না করার ব্যবস্থা করেছে স্কুল।
প্রবীণ ওয়াংয়ের ছেলে মেয়েরা কয়েক বছর আগেও বাইরে কাজ করতেন। তখন তার নাতি নাতনিরা ওয়াংয়ের বাড়িতেই থাকতো। ওয়াং ছানথাং অনেক বার কেন্দ্রীয় স্কুল দেখতে গেছেন। তিনি নিজের চোখে দেখে উপলব্ধি করেন, ছানথাং কেন্দ্রীয় স্কুল ছাত্রছাত্রীদের লেখাপড়া ও থাকার ভাল ব্যবস্থা করেছে। সেজন্যই তিনি তার চার নাতি ও নাতনীকে এ স্কুলে পাঠানোর সিদ্ধান্ত নেন। তিনি এ সম্পর্কে বলেন, '২০০৫ সালে আমি চারটি শিশুকে এখানে পাঠানোর সিদ্ধান্ত নেই। ছানথাং কেন্দ্রীয় স্কুলে আসার পর শিশুদের অনেক উন্নতি হয়েছে। তাদের লেখাপড়ার মান অনেক ভালো হচ্ছে। আমার এবং তাদের বাবা মা সবাই এখন ভাবেন ছানথাং কেন্দ্রীয় স্কুল প্রত্যয় ও প্রাণচাঞ্চল্যে ভরপুর।'
এছাড়াও, ছানথাং কেন্দ্রীয় স্কুল নিয়মিত টেলিফোন যোগাযোগের ব্যবস্থা ও করেছে। এর ফলে ছাত্রছাত্রীরা নিয়মিত বাবা মার সঙ্গে টেলিফোনে কথা বলতে পারে। একজন ছাত্রের বাবা চাং বলেন, টেলিফোন চালু হওয়ায় তিনি আরো নিশ্চিন্তে বাইরে কাজ করতে পারেন। এ সম্পর্কে তিনি আরো বলেন, 'আমার ছেলের লেখাপড়ার মান স্কুলে বাস করার আগের চেয়ে অনেক ভালো হয়েছে। লেখাপড়ার ক্ষেত্রে স্কুল ছাত্রছাত্রীদেরকে কড়াকড়িভাবে পরিচালনা করে এবং স্কুলে বসবাসের পরিবেশ অনেক ভাল। সেজন্য আমরা আমাদের সন্তান নিয়ে উদ্বিগ্ন নই।'
গ্রামাঞ্চলে বসবাসকারী কৃষক শ্রমিকের ছেলে মেয়েদের লেখাপড়ার মান উন্নয়নের পাশাপাশি একসাথে বসবাস করার কারণে ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে মৈত্রী ও সৌহার্দ্য বেড়েছে। এছাড়া তাদের স্বতন্ত্রভাবে বসবাস করার সামর্থ্যও বেড়েছে। ছাত্রী চাং ফিংফিং ছানথাং কেন্দ্রীয় স্কুলে তিন বছর ধরে আছে। তিনি বলেন, 'আমি এ স্কুলে আসার পর আমার লেখাপড়ার মান অনেক ভালো হয়েছে। আমি এখানে অনেক বন্ধু পেয়েছি। বন্ধুদের মধ্যে আমি অনেক উষ্ণ বোধ করি। এখানে আমার লেখাপড়া ও বসবাস অনেক শৃঙ্খলাপূর্ণ। আমি বন্ধুদের ব্যাপারেও আন্তরিক ও মনোযোগী। আমরা অনেকটি ভাইবোনের মত।'
এতো কিছুর পরও কিন্তু ছানথাং কেন্দ্রীয় স্কুল চাহিদা মেটাতে পারছিল না। লিংবি জেলার সরকার এ সমস্যায় সাড়া দিয়েছে। লিংবি জেলার শিক্ষা ব্যুরোর পরিচালক লিউ চাইবিন বলেন, সংশ্লিষ্ট বিভাগ ধারাবাহিকভাবে আবাসিক স্কুলের নির্মাণ জোরদার করার ব্যবস্থা নিয়েছে। এ সম্পর্কে তিনি বলেন, 'বর্তমান প্রেক্ষাপটে অবাসিক স্কুলের নির্মাণ কাজ আরো এগিয়ে নেয়ার জন্য ২০০৬ সালে কেন্দ্রীয় সরকার ২০লক্ষাধিক ইউয়ান ব্যয়ে অবাসিক স্কুলের নির্মাণ কাজ শুরু করে। এছাড়া, রুপান্তর পরিকল্পনায় কেন্দ্রীয় সরকার ও স্থানীয় সরকার ৭কোটিরও বেশি ইউয়ান বরাদ্দ করে। আমরা প্রধানত আবাসিক স্কুলের নির্মাণে এ বরাদ্দ ব্যবহার করেছি।'
এসব ব্যবস্থার মাধ্যমে ছানথাং কেন্দ্রীয় স্কুল নতুন ক্যান্টিন, খেলার মাঠ ও ছাত্রছাত্রীদের আবাসিক ভবন নির্মাণ করছে। এছাড়া এ স্কুলের শিক্ষকের সংখ্যা ২০ জন থেকে ৩০জন হয়েছে কিংবা তার চেয়েও বেড়েছে। চৌ ছাংবিন বলেন, বর্তমানে বাইরে কাজ করা কৃষক শ্রমিকরা আরো অধিকহারে নিজেদের সন্তানদের এ স্কুলে পাঠাচ্ছেন। তিনি আরো বলেন, '২০০৫ সালে ছানথাং গ্রামাঞ্চলে কেন্দ্রীয় স্কুলে কৃষক শ্রমিকদের ছেলে মেয়েদের জন্য আবাসন পরিকল্পনা যখন শুরু হয়েছিল তখন মাত্র ১৪৬জন ছাত্রছাত্রী স্কুলে থাকতে আসে। এখন সেই সংখ্যা ৪১৪। এরমধ্যে প্রায় ৯০ শতাংশ হলো গ্রামাঞ্চলে বসবাসকারী কৃষক শ্রমিকের ছেলে মেয়ে। বর্তমানে আরো বেশি গ্রামাঞ্চলে বসবাসকারী কৃষক শ্রমিকের ছেলে মেয়ে আমাদের স্কুলে লেখাপড়া করতে চায়।'
গ্রামাঞ্চলে বসবাসকারী কৃষক শ্রমিকের ছেলে মেয়েরা ছানথাং কেন্দ্রীয় স্কুলের তত্ত্বাবধান ও আন্তরিকতা অনুভব করতে পারে। একজন ছাত্র চাং সিওয়ে বলেন, 'আমরা এ স্কুলে বড়ো হয়ে উঠছি। এ স্কুল হল আমাদের বাড়ি। আমি এ স্কুল খুব পছন্দ করি।'
|