এতক্ষণ আপনারা যা শুনলেন , তা চীনের মঙ্গোলীয় জাতির লোক সংগীত । এই ধরনের সংগীত অতি প্রাচীন কালের । গানের সুর থেকে বোঝা যায় , বিস্তীর্ণ অন্তর্মঙ্গোলীয় তৃণভূমির সুন্দর পরিবেশ এবং মঙ্গোলীয় জাতির অনন্য তৃণভূমি সংস্কৃতি । বিস্তীর্ণ তৃণভূমি থেকে সৃষ্ট মঙ্গোলীয় সংগীত তৃণভূমি সংস্কৃতির প্রতীক ।
মঙ্গোলীয় সংগীত বেশ কয়েকটি শাখায় বিভক্ত । পন্ডিতরা মনে করেন , উচুমুসিং নামে সংগীত সার্বিকভাবে মঙ্গোলীয় সংগীতের ঐতিহ্য ও বৈশিষ্ট্যের প্রতিনিধিত্ব করে । উচুমুসিং অন্তর্মঙ্গোলিয়ার একটি জেলার নাম । এ প্রসঙ্গে অন্তর্মঙ্গোলিয়া স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চলের পূর্ব উচুমুসিং জেলার লোক সংগীত সমিতির ভাইস চেয়ারম্যান আহু গৌরবের সঙ্গে বলেন ,
উচুমুসিং জেলায় মঙ্গোলীয় জাতির সংস্কৃতি ও আচার ব্যবহার সবচেয়ে ভাল অবস্থায় সংরক্ষিত ।
পূর্ব উচুমুসিং জেলা অন্তর্মঙ্গোলিয়া স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চলের উত্তরাংশে অবস্থিত । এখানে বসবাসকারী মঙ্গোলীয় জাতির অধিবাসীরা নাচ ও গান পরিবেশনে পারদর্শী । যুগ যুগ ধরে মঙ্গোলীয় জাতির লোক সংগীতের অনন্য বৈশিষ্ট্য ও ঐতিহ্য গড়ে উঠেছে । পূর্ব উচুমুছিং জেলায় যখন বাম্পার ফলন , বিয়ের অনুষ্ঠান ও জন্ম দিবস উদযাপন করা হয় , তখন মঙ্গোলীয় জাতির এই ধরনের অনন্য বৈশিষ্ট্যপূর্ণ লোক সংগীত পরিবেশন করা হয় । উচুমুসিং জেলায় সবাই মঙ্গোলীয় জাতির লোক সংগীত পরিবেশনে দারুণ পারদর্শী । জেলার অধিবাসীরা বংশপরম্পরায় এই ধরনের লোক সংগীতের অনুশীলন করে আসছে । পাতুসুহো তো এই জেলার মঙ্গোলীয় জাতির লোক সংগীতের একজন প্রসিদ্ধ গায়ক । তিনি ছোট বেলা থেকে লোক সংগীত অনুশীলন শুরু করেছেন । তিনি বলেন
তিনি পাঁচ ছয় বছর বয়সে মঙ্গোলীয় জাতির লোক সংগীত চর্চা করতে শুরু করেছেন । বয়স্কদের কাছ থেকে লোক সংগীত অনুশীলন করতেন । তখন তার স্মরণ শক্তি খুবই ভাল ছিল । দশ বারো বছর বয়সে তিনি তিরিশ চল্লিশটি লোক সংগীত পরিবেশন করতে পারলেন ।
বড় হওয়ার পর প্রসিদ্ধ শিল্পীদের কাছ থেকে লোক সংগীত শেখার জন্য তিনি জেলা শহরে যান । অনেকের মনে আছে , বারো তেরো বছরের একটি কিশোর প্রবীণ শিল্পীদের কাছ থেকে লোক সংগীত শেখার জন্য সাইকেলে গ্রামে গ্রামে ঘুরে বেড়াচ্ছে ।
২০০০ সালে পাতুসুহো সিলিংকেলা জেলার একটি লোক সংগীত প্রতিযোগিতায় দ্বিতীয় হন । ২০০৪ সালে লোক সংগীত পরিবেশনের নৈপুণ্য আরো উন্নততর করার জন্য তিনি অন্তর্মঙ্গোলিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিল্পকলা ইনস্টিটিউটে ভর্তি হন । ২০০৭ সালে তিনি চীনের শিল্পী দলের একজন সদস্য হিসেবে প্রধানমন্ত্রী ওয়েন চিয়া পাওয়ের সঙ্গে জাপান সফরে গিয়েছিলেন । টোকিওতে অনুষ্ঠিত একটি সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে তিনি ও অন্য তিনজন মঙ্গোলীয় শিল্পীর সঙ্গে মঙ্গোলীয় লোক সংগীত পরিবেশন করেছেন । তাদের পরিবেশনের চিত্তাকর্ষক নৈপুণ্য জাপানী দর্শকদের ভূয়সী প্রশংসা পেয়েছে । তখনকার সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান প্রসঙ্গে পাতুসুহো বলেন ,
আগে মঙ্গোলীয় লোক সংগীত বিদেশে কখনো পরিবেশন করা হয় নি । এবারে মঙ্গোলীয় জাতির একটি শিল্পী দল প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে বিদেশ সফরে গিয়েছিল । সেজন্য তারা খুব মুগ্ধ হয়েছেন । প্রধানমন্ত্রী ওয়েন চিয়া পাও দেশের উন্নয়নের জন্য আরো ভালভাবে সেবা করা এবং সংখ্যালঘু জাতির ঐতিহ্য ও সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকারকে সূত্রে গ্রহণ করার জন্য তাদেরকে উত্সাহ দিয়েছেন ।
পাতুসুহো বলেন , মঙ্গোলীয় জাতির লোক সংগীতের বিষয়বস্তুতে জন্মভূমির প্রশংসা ও পরিবার পরিজনের ভালবাসাসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রের বিষয় অন্তর্ভুক্ত রয়েছে । এতে অসাধারণ আঞ্চলিক সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য তুলে ধরা হয় । তৃণভূমির অধিবাসীদের বৈশিষ্ট্যপূর্ণ ভাষার মাধ্যমে মঙ্গোলীয় জাতির ইতিহাস , সংস্কৃতি , আচার ব্যবহার পুরোপুরি প্রতিফলিত হয়েছে । মঙ্গোলীয় লোক সংগীত এই জাতির রীতি-নীতি ও উদার স্বভাবের প্রতীক । এই ধরনের লোক সংগীতের মধ্যে এই জাতির আবেগ ও স্বভাবের উদারতা দেখা যায় ।
মঙ্গোলীয় পশু পালকদের জীবনধারা পরিবর্তিত হওয়ার পাশাপাশি অতীতের তৃণভূমির পরিবেশের ব্যাপক পরিবর্তন হয়েছে । নগরায়ন হয়েছে । তৃণভূমির পরিবর্তে শহর গড়ে তোলা হয়েছে । ফলে মঙ্গোলীয় লোক সংগীত সৃষ্টির পরিবেশও নষ্ট হয়ে যাচ্ছে । অন্য দিকে আধুনিক যোগাযোগ ও টেলি-যোগাযোগ ব্যবস্থা বিকশিত হওয়ার কারণে বাইরের নানা ধরনের সংস্কৃতি তৃণভূমির গভীরে অনাহুত অনুপ্রবেশ করছে । মঙ্গোলীয় লোক সংগীতের গায়ক ও গায়িকাদের শিল্পকলা অনুশীলনের ভিত্তিও অনেক দুর্বল হয়ে গেছে । সুতরাং বর্তমানে অন্তর্মঙ্গোলিয়াস্বায়ত্তশাসিত অঞ্চলে মঙ্গোলীয় লোক সংগীত চর্চাকারীদের সংখ্যা দিন দিন হ্রাস পাচ্ছে ।
এই পরিপ্রেক্ষিতে মঙ্গোলীয় লোক সংগীত সুরক্ষা ও বিকশিত করার ক্ষেত্রে চীন সরকার বড় অংকের অর্থ বরাদ্দ করেছে । সংস্কৃতি বিভাগের উদ্যোগে মঙ্গোলীয় লোক সংগীত সংক্রান্ত প্রতিযোগিতা ও সেমিনার আয়োজন করা হয়েছে । বেশ কয়েকটি শিল্পকলা ইনস্টিটিউটের উদ্যোগে মঙ্গোলীয় জাতির লোক সংগীত চর্চা সংক্রান্ত পাঠ্যপুস্তকও রচনা করা হয়েছে । চীনের লোক সংগীত সংগ্রহে মঙ্গোলীয় লোক সংগীত খন্ডও প্রকাশিত হয়েছে । ২০০৫ সালের নভেম্বর মাসে চীন ও মঙ্গোলিয়া প্রজাতন্ত্রের যৌথ উদ্যোগে মঙ্গোলীয় লোক সংগীত বিশ্বের অবস্তুগত সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকার সুরক্ষা সংক্রান্ত তালিকায়ও শামিল হয়েছে । পূর্ব উচুমুসিং জেলার মঙ্গোলীয় লোক সংগীত সমিতির চেয়ারম্যান দেমচিগ আবেগের সঙ্গে বলেন ,
মঙ্গোলীয় লোক সংগীত যেমন চীন তেমনি বিভিন্ন দেশে জনপ্রিয় করে তোলার জন্য তাদের নিরলস প্রচেষ্টা চালাতে হবে । সাক্ষাত্কার শেষে সংবাদদাতা গ্রামবাসীদের কাছ থেকে বিদায় নিচ্ছিলেন । দূর থেকে সুন্দর ও মিষ্টি লোক সংগীতের সুর তখনও ভেসে আসছিল ।
(থান ইয়াও খাং)
|