২০০৮ সালের পেইচিং অলিম্পিক গেমস দিন দিন ঘনিয়ে আসার সঙ্গেসঙ্গে অধিক থেকে অধিকতর লোক স্বেচ্ছাসেবক দলে যোগ দিয়ে নিজদের বাস্তব কার্যকলাপের মধ্য দিয়ে অলিম্পিক গেমসের জন্য সেবা করছেন । পেইচিংয়ের ৯৬ বছর বয়সী নাগরিক লি সুফেন তাদের মধ্যে একজন । তিনি নিজের বৈশিষ্ট্যপূর্ণ পদ্ধতি-- কাগজ কাটা দিয়ে অলিম্পিক গেমসের প্রতি নিজের ভালবাসা ও সমর্থন ব্যক্ত করেন ।
৯০ বছর বয়সের সময় বুড়িমা লি সুফেন এক আছাড় খেয়েছেন । বাড়িতে বিশ্রাম নেয়াকালে সময় কাটানোর জন্য তিনি কাগজ কাটার কাজ শুরু করেন এবং এতে মোহিত হন । প্রথমদিকে তিনি শুধু কিছু অতি সাধারণের ফুল, ঘাস বা মানুষের আকার কাটতেন । কাগজ কাটার মানের দিন দিন উন্নতির সাথেসাথে তিনি সাধারণ ফুল, ঘাস বা মানুষের আকার কাটতে আর সন্তুষ্ট নন । ২৯তম অলিম্পিক গেমসের স্বাগতিক রাষ্ট্র হওয়ার পর বুড়ি লি সুফেন ভাবেন , বিদেশীরা নিশ্চয়ই চীনের কাগজ কাটা পছন্দ করবেন । আমি নানা ধরণের কাগজ কাটা উপহার হিসেবে দূর থেকে আসা বিদেশী বন্ধুদের দিতে পারি ।
বুড়ি লি সুফেন নিজের ইচ্ছা বাস্তবায়ন করতে শুরু করেছেন । তিনি অলিম্পিকের প্রতিমূর্তির সঙ্গে চীনের ঐতিহ্যবাহী কাগজ কাটা সমন্বয় করে প্রথম সেটের ২০টি কাগজ কাটার নকশা করেছেন । তার পর তিনি নকশা অনুযায়ী ২০ ধরণের কাগজ কাটা বানালেন এবং এগুলোকে পুস্তকে বাঁধাই করলেন । বুড়ি লি সুফেনের প্রথম উপহার বানানো হল ।
নিজের উপহার দেখে বুড়িমা লি মনে করেন , আমার তৈরী এ ধরণের উপহার অলিম্পিক গেমসের প্রতিনিধি দলকে দিতে পারলে কত ভাল হত । তখন থেকেই বুড়িমা লি তাঁর অলিম্পিক গেমসের স্বেচ্ছাসেবকেরকার্যক্রম শুরু করেন । তিনি কী কী বিষয় তাঁর কাগজ কাটার মর্মবস্তু হিসেবে গ্রহণ করেন ? প্রথমে তিনি চীনের কানফুসিয়াস, ছু ইউয়ান , লি পাই সহ চীনের প্রাচীনকালের জ্ঞানী লোকদের প্রতিমূর্তি তাঁর মডেল হিসেবে কাগজ কাটার কাজ করেছেন । কিন্তু অলিম্পিক গেমসের দর্শনের প্রতিমূর্তির প্রকাশের সঙ্গেসঙ্গে বুড়িমা লি সুফেনের কাগজকাটার বিষয়েরও পরিবর্তন হয় । যেমন ফুওয়া আছে তেমনি আছে সিলমোহর ও মশাল । তিনি বলেন , তিনি কাগজকাটার মাধ্যমে বিশ্বকে চীনের ইতিহাস , সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য অবহিত করতে চান । নিজের কাগজকাটার মর্মবস্তুর বেড়ে যাওয়াকে দেখে বুড়িমা লি মনে করেন , নিজের অলিম্পিকের স্বপ্ন বাস্তবায়নের জন্য শুধু কাগজকাটার ওপর নির্ভর করা যথেষ্ট নয় । তাঁকে আরও অনেক বাস্তব ও কার্যকর প্রস্তুতি নিতে হবে ।
২০০১ সাল থেকে লি নানি ইংরেজী শিখতে শুরু করেন । সুযোগ পেলেই তিনি মন দিয়ে ইংরেজীর কথাবার্তা অনুশীলন করতে থাকেন । আজকাল পর্যন্ত তাঁর এই অভ্যাস বজায় রয়েছে । লি নানির পরিকল্পনা অনুযায়ী মুখোমুখী বিদেশী বন্ধুদের কাগজকাটা উপহার দেওয়ার সুযোগ থাকলে তিনি ইংরেজী ভাষায় সরাসরি বিদেশী খেলোয়াড়দের সঙ্গে কথাবার্তা বলবেন ।
প্রতিদিন সকাল সাড়ে ৫টায় লি নানি উঠেন । তারপর তিনি নিজেই ইংরেজী শিখতে শুরু করেন । এখন তিনি অল্প অল্প ইংরেজী দিয়ে অন্য লোকের সঙ্গে সহজ কথাবার্তা বলতে পারেন ।
কিন্তু শুরুতে সবাই বিশ্বাস করেন না যে , লি নানির অলিম্পিকের উপহার প্রদান করার ধারণা বাস্তবায়িত হতে পারবে । তিনি স্থির করলেন । কেউই তাঁর এই সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করাতে পারবে না । তিনি একটি হিসাব করলেন । তিনি মাসে পাঁচটি কাগজকাটার বই কাটতে পারেন । প্রতি বইতে ২০টি কাগজকাটা আছে । এক বছরে তিনি ৬০টি কাগজকাটার বই বানাতে পারেন । ২০০৮ সাল পর্যন্ত তিনি ২০০টি বই সম্পন্ন করতে পারবেন ।
অন্যান্যদের সন্দেহ বিন্দুমাত্র এই নব্বই বছর বয়সী স্বেচ্ছাসেবকের কাগজকাটা তৈরীর আগ্রহের ওপর প্রভাব বিস্তার করেনি । প্রতিদিন সকাল ঠিক আটটায় তিনি দিনের কাজ শুরু করেন । একটা ছোট কাঁচি, পাতলা পাতলা ও নরম লাল রংয়ের কাগজ , মাপদন্ড ও এক ছোট মদের কাপ লি নানির কাগজকাটা তৈরীর যন্ত্রপাতি । কাজ শুরু করার পর লি নানি সময়কে খুব মূল্যবান করেন । কাজের মাঝখানে তিনি অল্প বিশ্রাম নিতে পারেন যাতে শরিরটা ভাল করে রাখা যায় । দুপুরবেলায় তিনি এক ঘন্টার মধ্যে রান্না করেন, লাঞ্চ খান এবং টেলিভিশন দেখেন । দিন পর দিন , বছর পর বছর লি নানি কাজ করে গেছেন । এক দিনও থামেননি । তিনি বলেন ,আমি কাগজকাটা থেকে আনন্দ পাই এবং কখনো ক্লান্ত অনুভব করিনি ।
লি নানি কাগজকাটার আনন্দের মাধ্যমে তাঁর স্বপ্ন বাস্তবায়নের দিনের জন্যঅপেক্ষা করছেন । ২০০৬ সাল নাগাদ তাঁর কাটা কাগজকাটার সংখ্যা ২৪০টিতে দাঁড়িয়েছে । এই পরিমাণ তাঁর পরিকল্পিত ২০০টি অনেক আগেই ছাড়িয়ে গেছে । তাঁর কাগজকাটার পরিমাণ সুষ্ঠুভাবে চলছে । কিন্তু তিনি আবার একটা নতুন সমস্যার সম্মুখীন । সমস্যা হল , কী ভাবে অলিম্পিক গেমসে অংশ নিতে পেইচিংয়ে আসা বিদেশী প্রতিনিধিদের হাতে কাগজকাটাগুলো পৌঁছানো যায় । ঠিক এ সময়ে আবাসিক এলাকার কর্তৃপক্ষ এ কথা জানতে পেরেছেন । তাঁরা ব্যক্ত করেন, তারা বুড়ি লির ইচ্ছা বাস্তবায়নের জন্য পদ্ধতি খুঁজে বের করবেন । লি নানির সমস্যা খুব তাড়াতাড়ি সমাধান হয়েছে । গত বছরের ডিসেম্বর মাসের এক দিন বুড়ি লি খবর পেলেন যে , চীনা কমিউনিষ্ট পার্টির পেইচিং পৌর কমিটির সম্পাদক লিউ ছি তাঁকে দেখতে তাঁর বাড়ি আসবেন । ৯৫ বছর বয়সী লি নানিকে দেখে লিউ ছি খুব মুগ্ধ হলেন । তিনি বলেন ,অবশ্যই লি নানির কাগজকাটাগুলোকে রাষ্ট্রের এক শ্রেণীর উপহার হিসেবে অলিম্পিক গেমসে অংশ নিতে পেইচিং আসা বিভিন্ন বিদেশের বিশিষ্ট অতিথিদের প্রদান করা হবে ।
|