মধ্য চীনের চিয়াংশি প্রদেশের কুইশি শহরে শে জাতির একটি থানা আছে । এই থানা চিয়াংশি প্রদেশ ও ফুচিয়ান প্রদেশের সীমান্ত রেখায় উ ই পাহাড়ের পশ্চিম দিকে অবস্থিত । এই থানার আয়তন ১২২ বর্গ কিলোমিটার , জনসংখ্যা ১ হাজার ৯০ জন ।
শে জাতির নিজের ভাষা আছে , লিখিত ভাষা নেই । তাদের অধ্যুষিত অঞ্চলে হান ভাষা প্রচলিত । শে জাতির নিজের উত্সব নেই । তারা হান জাতির মতো বসন্ত উত্সবসহ নানা রকম ঐতিহ্যবাহী উত্সব পালন করেন ।
শে জাতির চাংপিং থানা উঁচু পর্বতমালায় বেষ্টিত । এই থানা নিবিড় বনাঞ্চলে সমৃদ্ধ । প্রাকৃতিক পরিবেশ মনোরম এবং আবহাওয়া আরামদায়ক । থানার মাঝখানের দিকে শে জাতির প্রাচীন ইতিহাস , সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যে সমৃদ্ধ একটি মহাচত্বর আছে ।
মহাচত্বরের মেঝের আয়তন ১ হাজার বর্গ মিটার । এর কেন্দ্রস্থলে এক মিটার চওড়া ও ৫ মিটার দীর্ঘ চারটি বড় রেলিং দাঁড়িয়ে আছে । এই ৪টি বড় রেলিংয়ের উপরে রকমারি ও সৌন্দর্যময় দেয়াল চিত্র ও ভাস্কর্য দেখা যায় । এ সব দেয়ালচিত্র ও ভাস্কর্য কর্মে রহস্যময় পরিবেশ বিরাজমান । তাহলে এ সব চারুকলা কর্মের তাত্পর্য কী ? সে সম্পর্কে চিয়াংশি প্রদেশের কুইশি শহরের যাদুঘরের শে চিয়ান কেং বলেন ,
এই দেয়ালচিত্রে কুকুর রাজার জন্মগ্রহণ ,
যুদ্ধ, শিকার , স্থানান্তর ও নিত্য দিনের জীবনযাপন ফুটে উঠেছে । শে জাতি যুগ যুগ ধরে কুকুরকে তাদের পূর্বপুরুষ বলে অভিহিত করে । তারা কুকুরের প্রতি খুব শ্রদ্ধা নিবেদন করে । তাদের মনে হয়, পূর্বপুরুষ হিসেবে কুকুর আসলে ছিলিন নামে এক ধরনের কল্পিত প্রাণী থেকে পরিবর্তিত হয়েছে ।
শে চিয়ান কেং বলেন , শে জাতি কুকুরের প্রতি যে শ্রদ্ধা নিবেদন করে , তার মূলে রয়েছে তাদের আগেকার শিকার জীবন । এখন শে জাতির মধ্যে ড্রাগন ছিলিন নামে এক ধরনের বিশেষ কল্পিত প্রাণীর প্রতীক খুব প্রচলিত । এই প্রাণীর মাথা ড্রাগণের এবং তার শরীর ছিলিনের মতো ।
শে জাতির পূর্বপুরুষরা ড্রাগন ছিলিনের প্রতি যে শ্রদ্ধা নিবেদন করে , সে ব্যাপারে একটি সুন্দর রূপকথাও ব্যাপক প্রচলিত । অনেক আগের কথা । বিভিন্ন উপজাতির মধ্যে দারুণ যুদ্ধ চলছে । একজন রাজা এই প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন যে , যে লোক শত্রু পক্ষের রাজাকে পরাজিত করতে পারবে , তিনি তার সঙ্গে তার মেয়ের বিয়ে দেবেন । ড্রাগন ছিলিন শত্রু পক্ষের রাজাকে মেরে ফেলেছে এবং তার মাথা নিজ দেশের রাজাকে উপহার দেয় । সে রাজার সেজো মেয়েকে বিয়ে করেছে । ড্রাগণ ছিলিন কর্মকর্তা হতে চায় না । স্থায়ী বসবাস ও বংশ বিস্তারের জন্য সে রাজার সেজো মেয়েকে কুয়াংতুং প্রদেশের ফুংহুয়াং পাহাড়ে নিয়ে যায় ।
এখন চুয়াংপিংয়ের শে জাতির বৈচিত্র্যময় রীতি-নীতি সম্পর্কে আপনাদের কিছু বলা হবে ।
শে জাতির বহু সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ও আচার ব্যবহার স্থানীয় বৈশিষ্ট্যে ভরপুর । বিয়ের অনুষ্ঠান তো অন্যতম বৈশিষ্ট্যপূর্ণ রীতি-নীতি । প্রেমিক ও প্রেমিকা বাছাই করার জন্য অল্পবয়সীরা লোক সংগীত্ গাওয়ার মাধ্যমে নিজের প্রিয় লোককে অন্বেষণ করে । মেয়েকে ভালবাসা এবং তার বাবা মায়ের কাছে বিয়ের আবেদন জানানোর জন্য ছেলে ঘটককে অনুরোধ করে । মেয়ে ও তার পরিবার পরিজন ভাল বাসলে ছেলেকে স্বাগত জানাবে । চিয়াং শি প্রদেশের কুইশি শহরের যাদুঘরের ডেপুটি অধ্যাপক শে চিয়ান কেং বলেন ,
বিয়ের বিষয় খুব মজা । মেয়েকে ছেলের বাড়িতে নিয়ে যাওয়ার জন্য গ্রামের সামনের দিকে দু'পক্ষের মধ্যে গান গাওয়ার প্রতিযোগিতা আয়োজনে করা প্রয়োজন । পাত্র পক্ষকে পাত্রী পক্ষের নানা প্রশ্নের উত্তর দিতে হয় । পাত্রী পক্ষ সন্তুষ্ট হলেই পাত্র পক্ষের লোকেরা গ্রামে প্রবেশ করতে পারে । নইলে পাত্র পক্ষের লোকদের গ্রামে প্রবেশ করতে দেয়া হবে না ।
দীর্ঘকাল ধরে হান জাতির সঙ্গে বিনিময়ের কারণে হান জাতির চেয়ে শে জাতির বিয়ের রীতি-নীতিতে তেমন বেশি পাথর্ক্য নেই । তাদের বিশেষ চাল-চলন শুধু বিয়ের অনুষ্ঠান ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানেই দেখা যায় ।
শে জাতি গান ও নাচ পরিবেশনায় দারুণ পারদর্শী । তাদের নৃত্য বৈচিত্র্যপূর্ণ । চুয়াংপিং গ্রামে শে জাতির ঐতিহ্যবাহী নৃত্য সুষ্ঠুভাবে সংরক্ষিত এবং তা ভালভাবে বিকাশ লাভ করেছে ।
বাম্পার ফলন ও নববর্ষ উপলক্ষে শে জাতির গ্রামবাসীরা সাধারনতঃ ঘোড়ার বাতি নাচ করতে পছন্দ করেন । বিশ বাইশ জন গ্রামবাসীরা একদিকে গান করেন , অন্য দিকে তারা নাচ করেন । এই ধরনের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে প্রাণঢালা পরিবেশ বিরাজমান । অনুষ্ঠানে ঘোড়ার বাতি ছাড়া অন্যান্য রকম রঙবেরঙের বাতিতেও সুসজ্জিত করা হয় । ঘোড়ার বাতি নাচ প্রসঙ্গে শে জাতির একজন গ্রামবাসী লেই মান কুও বলেন ,
রকমারি ঘোড়ার বাতি নাচ বিভিন্ন তাত্পর্যপূর্ণ । এ সব নাচে বাম্পার ফলন , সফলতা ও ভালবাসা প্রতিফলিত হয় ।
যারা ঘোড়ার বাতি নাচ পরিবেশন করেন , তারা শে জাতির জাতীয় পোষাক পরেন এবং তাদের মাথায় কুকুরের মাথার মতো পাগড়ি জড়ানো থাকে । এর মাধ্যমে তারা পূর্বপুরুষদের প্রতি ধন্যবাদ ও শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করেন এবং ভবিষ্যতের শুভকামনা করেন । বর্তমানে শে জাতির ঘোড়ার বাতি নাচও বিকশিত হয়েছে । চিয়াংশি প্রদেশের কুইশি শহরের যাদুঘরের ডেপুটি অধ্যাপক শে চিয়ান কেং বলেন ,
বসন্ত উত্সব উপলক্ষে শে জাতির গ্রামবাসীরা বহু দিন ধরে নাচ করেন । এখন যখন উত্সব পালিত হয় , তখন ঘোড়ার বাতি নাচ পরিবেশন করা হয় । ১৯৯৬ সাল থেকে শে জাতির ঘোড়ার বাতি নাচ চীনের সংখ্যালঘু জাতির চতুর্থ গেমসে পরিবেশিত হয় । ১৯৯৯ সালে পেইচিংয়ে চীনের ৫০তম প্রতিষ্ঠা বার্ষিকী উপলক্ষে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে শে জাতির ঘোড়ার বাতি নাচ দর্শকদের ভূয়সী প্রশংসা পেয়েছে । (থান ইয়াও খাং)
|