ছাং জাতি চীনের একটি প্রাচীন সংখ্যালঘু জাতি । তারা প্রধানতঃ দক্ষিণ পশ্চিম চীনের সিছুয়ান প্রদেশের লি জেলাসহ কয়েকটি জেলায় বসবাস করে । ছাং জাতির জনসংখ্যা ২ লাখেরও বেশি । তাদের সৌন্দর্যময় স্থাপত্য কৌশল দেশ-বিদেশে সুবিদিত ।
ছাং জাতির বাড়িঘর সাধারনতঃ নদীর তীরে ও পাহাড়ের পাদদেশে নির্মিত । ছাং জাতির গ্রাম সে জাতির লোক চারুকলার এক অংশ হিসেবে অভিহিত করা হয় । গ্রামবাসীদের বাসস্থান হিসেবে ছাং জাতির গ্রাম যেমনি সে জাতির স্থাপত্য শৈলী প্রকাশ পায় , তেমনি তা পানি সরবরাহ , দমকল ও যুদ্ধ ক্ষেত্রে কাজে লাগানো হয় । লি জেলার থাওপিং গ্রাম সে জাতির একটি দৃষ্টান্ত । এই গ্রামের একজন তরুণী উ লি বলেন ,
এতে আসলে ছাং জাতির আচার ব্যবহার , যুদ্ধের ভূমিকা ও জনজীবনকে তুলে ধরা হয়েছে । ছাং জাতির গ্রাম নির্মাণের জন্য ব্যবহার্য সামগ্রী ও বাড়িঘর নির্মাণ কৌশলকে আত্মরক্ষার কথা বিবেচনা করা হতো বলে মনে করা হয়। আত্মরক্ষার জন্য নির্মিত জানালা , ভূগর্ভে পানি সরবরাহ ও নিষ্কাশন ব্যবস্থা এবং প্রচুর সুড়ঙ্গ শত্রুদের প্রতিহত করার জন্য নির্মাণ করা হয় ।
আত্মরক্ষা ছাড়া ছাং জাতির গ্রাম বিজ্ঞান , প্রযুক্তি ও শিল্পকলার ক্ষেত্রেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতো । গ্রামবাসীদের বাড়িঘরের বিন্যাস , নির্মান সামগ্রী ও স্থাপত্য শৈলীর দিক থেকেও ছাং জাতির স্থাপত্যের রীতি-নীতি রূপ পায় । ছাং জাতির গ্রামে গ্রামবাসীদের বাড়ি যে পিঠা পিঠি বা ঘেঁষাঘেঁষি নির্মিত হয়েছে , তাতে বেশি দেয়াল কমানোর জন্য বহু নির্মাণ সামগ্রী ও শ্রম শক্তি সাশ্রয় হয়েছে । তাতে দুর্গ নগর হিসেবে শক্রুসৈন্যের আগমন ঠেকানো যেতো । গ্রামবাসীদের বাড়িঘর নির্মাণ সামগ্রী হিসেবে অল্প কিছু কাঠ ছাড়া বেশির ভাগ পাথর ব্যবহার করা হতো । বাড়ির বিভিন্ন অংশ যুক্ত করার জন্য কোনো পেরেকও ব্যবহার করা হতো না । এ সব বাড়িঘর নির্মাণের জন্য আধুনিক যুগের কন্ক্রিট ব্যবহার হয় নি । কিন্তু তার বয়স কয়েক শ' বছর পুরনো । এর মধ্যে প্রবল ভূমিকম্প ও পর্বত ধসে পড়ার পরীক্ষায়ও উত্তীর্ণ হয়ে গেছে ।
ছাং জাতির স্থাপত্যের বৈশিষ্ট্য হচ্ছে উপর দিক চওড়া এবং নীচের দিক খাটো । বাড়ির ছাদ অর্ধেক খোলা এবং বাকী অর্ধেক বন্ধ । এটা যেমনি যুদ্ধ তেমনি ধর্মীয় উপাসনার জন্য উপকৃত । প্রতি গ্রামে ডে দুর্গ রয়েছে , তা সাধারনতঃ পাথর বা মাটি দিয়ে নির্মাণ করা হয়েছে । এই ধরনের দুর্গের মাধ্যমে শক্র সৈন্যের আগমন জ্ঞাপন করা যেতো । প্রাচীন দুর্গ নির্মাণ ও তার ভূমিকা প্রসঙ্গে একটি স্থানীয় হোটেলের মালিক চৌ লি চি বলেন ,
পাহাড়ের উপরে দুর্গ নির্মাণের উদ্দেশ্য হল দূর থেকে শক্র সৈন্যকে আবিষ্কার করা এবং তাদের আক্রমণ প্রতিহত করা ।
ছাং জাতির পাহাড়ী গ্রামের পেছনে একটি ঝরনা আছে , যেখানে বরফ গলে যাওয়ায় পানি জমে থাকে । গ্রামবাসীদের বাড়িঘরের ভূগর্ভে বিশুদ্ধ পানি সরবরাহ ও দূষিত পানি নিষ্কাশনের ব্যবস্থা আছে । এই ব্যবস্থাকে কাজে লাগিয়ে গ্রামবাসীদের পানি সরবরাহ ও বর্জ্য পানি নিষ্কাশন নিশ্চিত করা যায় । ছাং গ্রামের পানি সরবরাহ ব্যবস্থা বিশ্বের গ্রাম্য স্থাপত্য কর্মের জন্য একটি হিতকর দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে । কলের পানির মতো ছাং জাতির এই পানি ব্যবস্থা দমকল কাজের লক্ষ্যেও কার্যকর আগুণ নেবানোর ভূমিকা পালন করে । গরমকালে এই ধরনের পানি ব্যবস্থার মাধ্যমে ঘরের তাপমাত্রা কমানোও যায় । কৃষি জমিতে এই ব্যবস্থাকে কাজে লাগিয়ে জলসেচও করা যায় । এই ব্যবস্থা ছাং গ্রামবাসীদের জন্য দারুণ উপকার বয়ে এনেছে । ছাং জাতির একজন মেয়ে উ লি বলেন ,
ছাং জাতির গ্রামে ব্যবহার্য পানি পাহাড়ী ঝরণা থেকে পাওয়া যায় । পানির সরবরাহ ব্যবস্থার মাধ্যমে বাড়িতে বাড়িতে কাপড়-চোপড় ও সবজি ধোয়া যায় । ছাং জাতির একটি ঐতিহ্য ও আচার ব্যবহার আছে । এই আচার ব্যবহার অনুযায়ী , মানুষের পা দিয়ে খাল পারাপার করা উচিত নয় ।
ছাং জাতির স্থাপত্যশৈলী অনুযায়ী , ভূর্গভ , ও আকাশ থেকে একটি পূর্ণাঙ্গ যোগাযোগ ব্যবস্থা তৈরি হয়েছে । এই ধরনের রহস্যময় প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা কাজে লাগিয়ে শত্রু পক্ষের আক্রমণ কার্যকরভাবে প্রতিরোধ করা যায় । চীন ও বিদেশের স্থাপত্য শিল্পের ক্ষেত্রে এটা নজির বিহীন ।
বর্তমানে ছাং জাতি অধ্যুষিত অঞ্চলে বেশ কিছু গ্রামবাসীদের বাড়ি সংস্কার করা হচ্ছে । বাড়িঘরের বাইরের অংশ সাজানোর জন্য নতুন ধরনের গৃহসজ্জার সামগ্রী ব্যবহার করা হচ্ছে । মহাসড়ক নির্মাণের জন্য বিপুল পরিমাণে ইট ও পাথর কাজে লাগানো হচ্ছে । গত কয়েক বছর ধরে পর্যটন শিল্প বিকাশের পাশাপাশি ছাং গ্রামের বাড়িঘরের স্থাপত্যের পুরানো ঐতিহ্য ও বৈশিষ্ট্য পুনরানয়ন হয়েছে । বর্তমানে অধিক থেকে অধিকতর পর্যটক ছাং গ্রাম ভ্রমণে আসছেন। এ ক্ষেত্রে ছাং গ্রামের একটি হোটেলের মালিক চো লি চি বলেন ,
বর্তমানে মালয়েশিয়া , তাইওয়ান ও সিংগাপুর , ব্রিটেন , ফ্রান্স ও যুক্তরাষ্ট্রসহ বিভিন্ন দেশ ও অঞ্চলের পর্যটকরা ছাং জাতির গ্রাম ভ্রমণে আসেন ।
পাঁচ বছর আগে ইউনেস্কোর ডক্টর হ্যানরি থাওপিং ছাং গ্রাম পরিদর্শন করেছেন । তিনি ছাং জাতির স্থাপত্য শিল্পের ভূয়সী প্রশংসা করেছেন । হ্যানরির মূল্যায়ন প্রসঙ্গে উ লি বলেন ,
২০০১ সালে ইউনেস্কোর ডঃ হ্যানরি থাওপিং এসেছিলেন । তিনি ছাং জাতির গ্রামবাসীদের বাড়িঘরের স্থাপত্য শিল্পের খুব প্রশংসা করেছেন ।
|