উত্তর পশ্চিম চীনের ছিংহাই প্রদেশের স্যুনহুয়া সারা জাতি স্বায়ত্তশাসিত জেলায় চীনের প্রাচীনতম হাতের লেখা কোরান সংরক্ষিত রয়েছে । প্রাচীনকালে পুরাকীর্তি রক্ষার ব্যবস্থার অভাবের দরুণ এই কোরানের বেশ কয়েকটি অংশ অস্পষ্ট হয়ে গেছে । কিছু দিন আগে চীনের বেশ কয়েকজন পুরাকীর্তি সংরক্ষণ বিশেষজ্ঞের প্রচেষ্টায় এই কোরানের পুনরানয়ন করা সম্ভব হয়েছে । আজ এই অনুষ্ঠানে এই কোরান সম্পর্কে আপনাদের কিছু বলছি আমি…
চীনের ছিংহাই প্রদেশের স্যুনহাই সারা জাতি স্বায়ত্তশাসিত জেলা সারা জাতি অধ্যুষিত এলাকা । সেখানের লোকসংখ্যা আশি হাজারের কাছাকাছি । সারা জাতি ইসলাম ধর্মাবলম্বী । লোক কাহিনী অনুযায়ী , ৭ শো বছরেরও বেশি সময় আগে সারা জাতির পূর্বপুরুষরা দূরের মধ্য এশিয়া থেকে পূর্ব দিকে স্থানান্তরিত হয়ে ছিলেন । যখন তারা স্যুন হুয়া জেলায় পৌঁছান , তখন তারা লক্ষ্য করেন , সেখানের ভূমি সমতল , নদ-নদী বহুল এবং চার দিক পাহাড় ও বনে বেষ্টিত । সেখানে একটি ঝরনা ছিল । পানি স্বচ্ছ ও মিষ্টি । হঠাত্ লোকেরা আবিষ্কার করেন , তাদের সংগী একটি উট ঝরনায় শুয়ে থাকে । পানির বাইরে উটের পিঠ দেখা দিল । তা সাদা পাথরে পরিণত হয়েছে । উটের পিঠের উপরে হাতের লেখা কোরান গ্রন্থ রাখা ছিল । এই ধর্মীয় গ্রন্থ দেখে সারা জাতির পূর্বপুরুষরা খুব উত্ফুল্ল হয়ে উঠলেন । ফলে তারা ওখানে বসবাস করতে শুরু করেছেন ।
জানা গেছে , স্যুন হুয়া সারা জাতি স্বায়ত্তশাসিত জেলায় ৩০ খন্ড বিশিষ্ট কোরান সংরক্ষিত রয়েছে । সৌন্দর্যময় চিত্রে সাজানো কোরান গ্রন্থে আরবী ভাষায় লিখিত । গোটা গ্রন্থের ওজন ১২ কিলোগ্রামেরও বেশি ।
দু' বছর আগে চীনের পুরাকীর্তি বিশেষজ্ঞ গ্রুপ হাতে লিখে রাখা এই কোরান নিয়ে আলোচনা করেছেন । তারা মনে করেন , এই কোরান রচনা করা হয় অষ্টম থেকে ত্রয়োদশ শতক পর্যন্ত । এটা চীনের প্রাচীনতম কোরান । ছিংহাই প্রদেশের সারা জাতির আচার -ব্যবহার বিষয়ক বিশেষজ্ঞ হান চিয়ান সিয়াং বলেন , ইসলাম জগতে এই প্রাচীন কোরানের অনন্য মর্যাদা রয়েছে ।
চীন ছাড়া রাশিয়া ও ব্রিটেনেও এই ধরনের কোরান সংরক্ষিত রয়েছে । ১৯৫৪ সালে সিরিয়ায় বিশ্ব ইসলাম ধর্ম গ্রন্থ প্রদর্শনীতে চীনের এই কোরান চীনা মুসলমানদের পক্ষ থেকে প্রদর্শিত হয় । ১৯৬২ সালে ইরানেও চীনের এই কোরান প্রদর্শিত হয়েছে । এটা বিশ্ব মুসলমানদের ভূয়সী প্রশংসা পেয়েছে ।
চীনের এই কোরানের বয়স ৭ শ' বছরেরও বেশি পুরনো । সময় ও পোকার ক্ষয়ক্ষতির কারণে এই কোরানের বেশ কিছু অংশ নষ্ট হয়ে যাচ্ছে । সুতরাং তাকে জরুরীভাবে পুনরানয়ন করতে হবে ।
দীর্ঘকাল ধরে চীন সরকার এই কোরানের ওপর ব্যাপক মনোযোগ দিয়ে আসছে । এই কোরান সুরক্ষার জন্য চীনের রাষ্ট্রীয় পুরাকীর্তি ব্যুরো ১৫ লাখ ইউয়ান বরাদ্দ করেছে । সম্প্রতি চীনের পুরাকীর্তি বিশেষজ্ঞ শি সান ছাই ও নানচিং যাদুঘরের অন্যান্য ৪জন বিশেষজ্ঞের উদ্যোগে এই কোরানের পুনরানয়ন ও মজবুত করা হয়েছে । তিনি বলেন ,
পুরাকীর্তি সুরক্ষার জন্য তার পুরানো বৈশিষ্ট্য বজায় রাখা উচিত । পুরানো বৈশিষ্ট্য মেনে নেয়ার ভিত্তিতে তার মেরামত ও মজবুত করা দরকার ।
বিশেষজ্ঞ গ্রুপ পরিষ্কার , পোকা ও জীবাণু নাশক, পুনরানয়ন ও মজবুত পদ্ধতিতে এই কোরানের আয়ু বাড়ানোর চেষ্টা করেছেন । ঐতিহ্যবাহী ও আধুনিক পদ্ধতির সমন্বিত ব্যবহারে তারা সফলভাবে এই কোরানের মেরাত ও মজবুত করার কর্তব্য সম্পন্ন করেছেন ।
সারা জাতির জাতীয় অনুভূতি এবং এই কোরানের সঙ্গে তাদের অসাধারণ সম্পর্কের কথা বিবেচনা করে চীন সরকার ও স্থানীয় সংশ্লিষ্ট বিভাগ সারা জাতি অধ্যুষিত অঞ্চলে এই কোরান সংরক্ষণের সিদ্ধান্ত নিয়েছে । স্যুন হুয়া জেলার ধর্ম ব্যুরোর প্রধান হো ইয়ুন চুং বলেন ,
এই কোরানের সঙ্গে সারা জাতির ইতিহাসের সম্পর্ক নিবিড় । তারা এই কোরানকে সারা জাতির এক অংশ হিসেবে মনে করেন । সুতরাং সারা জাতি অধ্যুষিক অঞ্চলে এই কোরান সংরক্ষণের ব্যবস্থা নেয়ার ফলে সারা জাতির আত্মমর্যাদা আরো বেড়ে গেছে । এতে তাদের ধর্মীয় বিশ্বাসের প্রতিও পুরোপুরি মর্যাদা প্রদর্শন করা হয়েছে ।
বর্তমানে নতুনভাবে পুনরানয়ন ও মজবুত করা এই কোরান ছিংহাই প্রদেশের স্যুন হুয়া সারা জাতি স্বায়ত্তশাসিত জেলায় নতুনভাবে প্রতিষ্ঠিত কোরান যাদুঘরে সংরক্ষিত রয়েছে । ব্যাপক দর্শকদের দর্শনের সুবিধার লক্ষ্যে এই কোরান একটি স্বচ্ছ সেলফে সংরক্ষিত রয়েছে । এ ছাড়া এই কোরানের আয়ু আরো বেশি বাড়ানোর জন্য বিশেষজ্ঞরা এই কোরানের একটি অনুলিপি তৈরি করেছেন । প্রয়োজন হলে প্রাচীন কোরান গ্রন্থের পরিবর্তে কোরানের অনুলিপি দর্শকদের জন্য প্রদর্শন করা হবে ।
নানচিং যাদুঘরের পুরাকীর্তি বিশেষজ্ঞ শি সান ছাই মনে করেন , সারা জাতির এই কোরানের পুনরানয়ন ও মজবুত কাজের সুদূরপ্রসারী তাত্পর্য রয়েছে । কারণে এই কোরানের মাধ্যমে যেমনি সারা জাতির উত্পত্তি ও ইতিহাস প্রকাশ পেয়েছে , তেমনি বিশ্ব ইসলাম ধর্মের সংস্কৃতি বিষয়ক গবেষণার ক্ষেত্রেও সুগভীর তাত্পর্য সৃষ্টি হয়েছে ।
এই কোরান সারা জাতি অধ্যুষিত অঞ্চলে সংরক্ষিত হওয়ার পর সারা জাতির ইতিহাস , হস্তান্তর ও তখনকার ধর্ম ও সংস্কৃতি গবেষণার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে । ৭ শো বছরেরও বেশি পুরনো এই কোরানে সারা জাতির পূর্বপুরুষদের পূর্বমুখী স্থানান্তরের ইতিহাস তুলে ধরা হয়েছে । একটি মহা ধমীয় গ্রন্থ হিসেবে তা ইতিহাসের একটি নতুন অধ্যায়ের সূচনা করেছে । এ থেকে বোঝা যায় , সারা জাতি নিজেদের বিলুপ্ত সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য রক্ষার চেষ্টা করছে । কোরানের পুনরানয়ন ও মজবুত করা চীনের ৫৫টি সংখ্যালঘু জাতির ইতিহাস ও ঐতিহ্য রক্ষার ব্যাপারে চীন সরকারের প্রতিশ্রুতিও রূপ লাভ করেছে ।
(থান ইয়াও খাং)
|