পাঁচ বছর আগে স্বামী-স্ত্রী দুজনের মধ্যে ছাড়াছাড়ি হয়ে যায় । তাদের একমাত্র ছেলে ওয়েন ওয়েন ৬ বছর বয়সে লিউকেমিয়ায় আক্রান্ত হয়েছে । ৫ বছর পর দুজনের প্রথমবার সাক্ষাত্ হয়েছে হাসপাতালে ছেলের শয্যার সামনে । দুজনের কেউই কাউকে ইমেল পাঠাননি । কিন্তু তারা দুজনই বারবার পরস্পরের মোবাইল থেকে পাঠানো ইমেল পান । রহস্যের এ ইমেল তাহলে কে পাঠিয়েছেন ?
২০০৭ সালের ২২ মে ৬ বছর বয়সী ছেলে ওয়েন ওয়েন লিউকেমিয়ায় আক্রান্ত হয়েছে বলে চিহ্নিত হয় । ওয়েন ওয়েনের অবস্থা কখনো কখনো ভাল আবার কখনো কখনো খারাপ । যখন ম্বাস্থ্যের অবস্থা একটু ভাল তখন ওয়েন ওয়েন একটি গোপন পরিকল্পনা বাস্তবায়নের চেষ্টা করত ।
ওয়েন ওয়েনের গোপন পরিকল্পনাটা কী ? সেটা হল বাবা ও মা-র ওপর তৈরী করা পরিকল্পনা । কিন্তু হঠাত ওয়েন ওয়েনের খুব জ্বর হল এবং প্রায় দশ দিন ধরে জ্বর স্থায়ী হয় । ডাক্তাররা আপ্রাণ চেষ্টা করলেও জ্বর সেরে যায় না । ওয়েন ওয়েনের জন্য সবাই খুবই চিন্তাশীল । ওয়েন ওয়েন নিজেও মনে করে, আমার অবস্থা যদি সত্যিই ভাল না হয়, তাহলে পরিকল্পনার জন্য এতদিন যে প্রচেষ্টা চালিয়েছি এবং এখনো চালাচ্ছি তা সবই আমার জীবনের সঙ্গে বুদ্বুদে পরিণত হবে ।
ডাক্তার ওয়েন ওয়েনকে পরীক্ষা করার সময় ওয়েন ওয়েনের মা কো লিতান রোগী কক্ষের বাইরে পরীক্ষার ফলাফলের অপেক্ষায় অস্থির ছিলেন । তিনি ছেলের মনের গোপন কথা বিন্দুমাত্রও টের পাননি । যখন তিনি ছেলের অবস্থার জন্য চিন্তিত তখন এক আশ্চর্য ও রহস্যময় বিষয় তাকে ঘিরে ধরে । ব্যাপারটা হল এই যে , ছেলে অসুস্থ হওয়ার এই আধা মাসে তিনি মোবাইল ফোনের মাধ্যমে কিছু ইমেল পেয়েছেন। এই সব ইমেল পড়ে তিনি বিষ্মিত হন । ইমেলগুলোর অর্থ হল এই যে,প্রিয় স্ত্রী,আমি তোমাকে ভালবাসি । ওয়েন ওয়েনের বাবা ওয়াং হোংস্যুয়ের মোবাইল থেকে এই সব ইমেল পাঠানো হয় ।
কো লিতান ও ওয়াং হোংস্যুয়ের বিবাহ ছাড়াছাড়ি হওয়ার ৫ বছর ধরে তাদের মধ্যে একবারও দেখা হয়নি । ছেলে ওয়েন ওয়েন লিউকোমিয়ায় আক্রান্ত হওয়ার কারণে তারা এই প্রথমবারের মতো মিলিত হন । মোবাইলের ইমেল বারবার পড়ে কো লিতানের খুব দুঃখ হল। তিনি ভাবলেন , যদি এই সব ইমেল ৫ বছর আগে তিনি পেতেন,তাহলে তাদের বিবাহ বিচ্ছিন্ন হত না এবং ছেলে ওয়েন ওয়েন রোগেও আক্রান্ত হত না । তিনি বুঝতে পারেন না ,কেন এখন ওয়াং হোংস্যুয়ে তাকে এমন ইমেল পাঠান ?তার উদ্দেশ্য কী?
যখন তিনি ওয়েন ওয়েনের বাবাকে জিজ্ঞেস করতে চাচ্ছিলেন ঠিক এই সময় ওয়েন ওয়েনের নাক থেকে রক্ত ঝরতে শুরু লাগল । বিপুল পরিমাণের রক্তস্রাব লিউক্যামিয়া রোগীর পক্ষে অত্যন্ত বিপদজনক । এত বেশী রক্ত ঝরার ফলে মৃত্যু যেন ঘনিয়ে আসছে দেখে ওয়েন ওয়েন আপ্রাণ চেষ্টা করে ডাক্তারকে জিজ্ঞেস করে,ডাক্তার সাহেব,আমি আর বাঁচতে পারব ?
কেউই জানেন না,এই ৬ বছর বয়সী ছেলে প্রশ্ন করার আসল উদ্দেশ্য কী? সে মৃত্যুকে ভয় করছে ? হ্যাঁ সে মরতে চায় না । এ ছাড়াও আরেক গুরুত্বপূর্ণ কারণ আছে তা হল,সে বাবা ও মা সম্পর্কিত নিজের মনের গোপন পরিকল্পনা বিফলে যেতে দিতে চায় না ।
ওয়েন ওয়েনের রক্তস্রাব দেখে কো লিতানের ভয় হল । ৫ বছর আগে স্বামী-স্ত্রী দুজনের বিবাহ বিচ্ছিন্ন হওয়ার পর তিনি ছেলে ওয়েন ওয়েনকে স্বামী ওয়াং হোংস্যুয়ের কাছে রেখে চলে গেছেন । এরপর ৫ বছর ধরে ছেলেকে দেখেননি । তিনি ভাবতে পারনেনি,৫ বছর পর ছেলের সঙ্গে দেখা হয়েছে এবং ছেলের মুখে ডাকা"মা"শুনেছেন হাসপাতালে । তিনি খুব অনুতপ্ত হন । কেন যে আগে ছেলেকে দেখাশুনা করতে আসিনি । একটু আগে আসতে পারলে কত ভাল হত ।
অবশেষে ছেলের রক্তস্রাব থামানো হল । কো লিতানের পাশে বসে থাকা ওয়াং হোংস্যুয়ে দাঁড়িয়ে উঠে রোগীর কক্ষ থেকে বের হয়ে গেলেন । ওয়াং হোংস্যুয়ের পিঠ-গঠন দেখে কো লিতান এই ১০-১২ দিন ধরে নিজের মনে জমে থাকা সন্দেহ আর গোপন রাখতে পারলেন না । তিনি ওয়াং হোংস্যুয়েকে জিজ্ঞেস করবেন । কিন্তু যখন তিনি ওয়াং হোংস্যুয়ের পাশে এসে দাঁড়ান তখন কীভাবে বলবেন তিনি জানেন না । দুজন চুপচাপ করে সারা রাত হাসপাতালের উঠানে ঘুরে বেড়ালেন । ভোর বেলার সময় হঠাত ওয়াং হোংস্যুয়ের মোবাইলের টি টি শব্দ হল । কে তার মোবাইলে এই ইমেল পাঠাল । ইমেলে বলা হয় যে, প্রিয় স্বামী, আমি তোমাকে ভালবাসি । ওয়াং হোংস্যুয়ে অবাক হলেন । এ সময় কো লিতান তার কাছে আছেন এবং তিনি মোবাইল ব্যবহার করেননি । ইমেলটা কোথা থেকে পাঠাল? কো লিতানেরও সন্দেহ হয় । কারণ তিনি কখনো ওয়াং হোংস্যুয়েকে এ ধরণের ইমেল পাঠাননি । এ সময় তার মোবাইলও কাছে নেই । আসলে ওয়াং হোংস্যুয়েও জানতে চেয়েছেন কো লিতান তাকে এ ধরনের ইমেল পাঠিয়েছেন কী না । কারণ এ ১০-১২ দিন ধরে তিনিও " প্রিয় স্বামী, আমি তোমাকে ভালবাসি", "প্রিয় স্বামী, কেমন আছ, অত ব্যস্ত হয়ো না"সহ বেশ কয়েকবার ইমেল পেয়েছিলেন । ওয়াং হোংস্যুয়ের মোবাইলে ইমেল দেখে কো লিতান হঠাত বুঝলেন, এই সব ইমেল তাদের ৬ বছর বয়সী ছেলে ওয়েন ওয়েনের তৈরী? কারণ রুম থেকে বের হওয়ার সময় তিনি মোবাইল আনেননি । ওয়েন ওয়েনের শয্যায় রেখে এসেছেন। একথা ভেবে দুজন তাড়াতাড়ি ওয়েন ওয়েনের রুমে ফিরলেন । ওয়েন ওয়েন ঘুম থেকে জেগে উঠেছে । মা'র মোবাইল তার দুই হাতে ধরা আছে । এই দৃশ্য দেখে ওয়াং হোংস্যুয়ে ও কো লিতান সব বুঝলেন । এটাই ওয়েন ওয়েনের গোপন পরিকল্পনা । সে চায় বাবা ও মা আগের মতোই একই পরিবারে থাকুক । সে চায় একটি পরিবার । বাবা মা ও সে তিনজনের পরিবার চায় ।
এই পাঁচ বছরে ওয়েন ওয়েন এক দিনও মাকে ভুলেনি । এখন মা তার পাশেই আছেন । সে বাবা মার ভালবাসা ও যত্ন অনুভব করছে । সে আনন্দিত ও খুশী । সে এই আনন্দ ও সুখের দিন হারাতে চায় না । সে চিরকালই মাকে কাছে রাখতে চায় । তাই যখন শরীর কিছু ভাল তখন সে কৌশল করে আলাদা আলাদাভাবে বাবা মাকে ইমেল পাঠায় । ছেলের কথা শুনে স্বামী-স্ত্রী দুজন খুব মুগ্ধ হন । তাদের ছাড়াছাড়ি ছেলের জন্য দুঃখ-কষ্ট বয়ে এনেছে । তাদের ছাড়াছাড়িতে দীর্ঘকাল ধরে অখুশীর কারণে ছেলে লিউকোমিয়ায় আক্রান্ত হয়েছে ।
কয়েক দিন পর ওয়েন ওয়েনের পরীক্ষার ফলাফল বের হল । কি আশ্চর্য ,ওয়েন ওয়েনের রোগ নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব হয়েছে । এর কিছু দিন পর ওয়েন ওয়েনের সেল ট্রানস্প্লান্ট সাফল্যমন্ডিত হয়েছে ।
ওয়েন ওয়েনকে দেখাশুনার সময় পরিবারের তিনজন কত যে খুশী কত যে আনন্দিত তা ভাষায় প্রকাশ করা যায় না । গোপন পরিকল্পনার যে ফল হয়েছে তা ওয়েন ওয়েনের চাওয়া ফল । সেল ট্রানস্প্লান্টের এক সপ্তাহ পর ওয়েন ওয়েনের সাক্ষ্যে হাসপাতালে কো লিতান ও ওয়াং হোংস্যুয়ের সরল ও রোমান্টিক বিয়ের অনুষ্ঠান অনুষ্ঠিত হয় । পরবর্তী কালে ওয়েন ওয়েন বাবা মার সযত্নে আনন্দ ও সুখশান্তিতে জীবনযাপন করবে বলে আশা করা হচ্ছে ।
|