২০০৬ সালের অক্টোবর মাসে চীনের লিয়াও নিং প্রদেশের তালিয়েন শহরের ফুলান তিয়েন লিয়েনশান চেন নগরের চেন আন চিয়া গ্রামের ৭ বছর বয়সী মেয়ে স্যুয়েলিয়েনের পেটে একটি বড় টিউমার ধরা পড়েছে । এটা একটা অতি খারাপ রোগ । তার বাবা ও মা তাকে নিয়ে অনেক হাসপাতালে ঘুরে বেড়িয়েছেন । কিন্তু কোনো হাসপাতালে এই রোগ চিকিত্সা করা যাবে না এবং কেউই জানেন না , কোথায় চিকিত্সা করা যাবে ? স্যুয়েন লিয়েনের বাবা মা এর জন্য অস্থির হলেন ।
তালিয়েনের একজন ডাক্তার স্যুয়েলিয়েনের বাবাকে বললেন, এত কম বয়সী মেয়ের পেটে এত বড় টিউমার হতে পারে এবং টিউমারের আকার এত বড় হতে পারে কথাটা তার গত ২০ বছরের ডাক্তারী জীবনে তিনি কখনো দেখেননি এবং শুনেননি । এধরণের টিউমার কোথায়ও চিকিত্সা করানো যাবে না । এ সময় স্যুয়েলিয়েনের মা ইন্টারনেট থেকে জানতে পেরেছেন , স্যুয়েলিয়েনের মতো মাত্র দুজন রোগী ছিলেন । একজন এখন চেতনাহীন অবস্থায় আছেন । আরেকজন শল্যচিকিত্সার সময়ে মারা গেছেন ।
স্যুয়েলিয়েন এখনো স্বাভাবিকভাবে চলাফেরা করতে পারলেও তার জীবন যেকোনো সময় শেষ হয়ে যাবে । স্যুয়েলিয়েনকে পেইচিং বা সাংহাইয়ের বড়বড় হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার প্রস্তাব করলেন ডাক্তাররা । হয়ত সেখানে স্যুয়েলিনের আরোগ্য হওয়ার সম্ভাবনা থাকবে । কিন্তু শল্যচিকিত্সা করাতে কমপক্ষে ৩ লাখ ইউয়ান লাগবে । স্যুয়েলিয়েনের বাবা মা দুজনেই কর্মচ্যুত শ্রমিক । তাদের আয় নাই বলা যায় । ৩ লাখ ইউয়ান তাদের পক্ষে অতি বিরাট পরিমান যা পরিশোধ করতে তারা কোনো দিনই সক্ষম হবেন না । স্যুয়েলিয়েনের গল্প স্থানীয় সংবাদমাধ্যমের দ্বারা ছড়িয়ে পড়ে । ২০০৬ সালের ৯ নভেম্বর স্থানীয় পত্রিকায়" ফুলের মতো সুন্দর জীবন বাচাও" শিরোনামে একটি প্রবন্ধ প্রকাশের মাধ্যমে সমাজের কাছে আর্থিক সাহায্যের আবেদন জানানো হয় । পত্রিকাটির সাধারণ সম্পাদক মালি বলেন, যদিও তালিয়েন শহরের হাসপাতালে এ ধরণের রোগ চিকিত্সা করা যাবে না বলে কোনো কোনো ডাক্তার মনে করে । তবু দেশের অন্যান্য জায়গা বা বিদেশে চিকিত্সা করতে সক্ষম এমন হাসপাতাল আছে কী না ? ৩০ শতাংশের আশা থাকলে আমারা এই পরিবারকে সাহায্য করব ।
তালিয়েন শহরের চিনইয়াং থিয়েন হোটেলের সকল কর্মীরা স্যুয়েলিয়েনের জন্য চাঁদা সংগ্রহ করেছেন । কেউ ১০ ইউয়ান , কেউ ৫ ইউয়ান আবার কেউ ২ ইউয়ান জমা দেন । তাদের মধ্যে একজন মধ্যবয়সী মহিলা "লিয়েনসিন" নামে চাঁদাও দিয়েছেন । এর পর সবাই এই মহিলার মতো "লিয়েনসিন" নামে চাঁদা দিলেন । "লিয়েনসিন" নামটি আসলে কোনো লোকের নাম নয় । নাম প্রকাশ অনিচ্ছুক নাগরিকরা "লিয়েনসিন" নামটির মাধ্যমে স্যুয়েলিয়েনের প্রতি আন্তরিক শুভেচ্ছা জানিয়েছেন । সবাই যখন স্যুয়েলিয়েনের স্বাস্থ্যের জন্য চিন্তা করেন ঠিক এ সময় একজন নাগরিক টেলিফোনে বলেন , সাংহাই শিশু হাসপাতালের ডাক্তার ছেন ছিমিন হয়ত স্যুয়েলিনের রোগ চিকিত্সা করতে পারেন । স্থানীয় পত্রিকার সাধারণ সম্পাদক মালি তাড়াতাড়ি ডাক্তার ছেন ছিমিনের সঙ্গে যোগাযোগ করেছেন এবং ইমেলের মাধ্যমে স্যুয়েলিয়েনের সব তথ্য পাঠিয়েছেন । ২০০৬ সালের ২৮ নভেম্বর ডাক্তার ছেন বিশেষভাবে বিমানে করে তালিয়েন এলেন । তালিয়েন শহরের কেন্দ্রীয় হাসপাতালের সহযোগিতায় তিনি স্যুয়েলিনের ওপর সার্বিক পরীক্ষা চালিয়েছেন । পরীক্ষার ফলাফলের মাধ্যমে স্যুয়েলিয়েনের শল্যচিকিত্সার সম্ভাবনা নিশ্চিত হয় বটে । তবে এর ঝুঁকিও প্রমাণিত হয় । ডাক্তার ছেন বলেন, শল্যচিকিত্সার ব্যাপারে সফল হওয়ার সম্ভাবনা ৭৫শতাংশ । কিন্তু সাংহাই শহরে আরেকবার পরীক্ষা করানো দরকার । ডাক্তার ছেন সবাইকে এক সুখবরও জানিয়েছেন যে, তাদের হাসপাতালে স্যুয়েলিয়েনের জন্য শল্যচিকিত্সা করাতে মাত্র ৫০ হাজার ইউয়ান লাগে তিন লাখ নয়। এ কথা শুনে সবাই খুশি হলেন । কারণ তাদের চাঁদা সংগ্রহের অর্থ স্যুয়েলিয়নের শল্যচিকিত্সার জন্য যথেষ্ট হয়েছে ।
ডাক্তার ছেন তালিয়েন শহরে মাত্র ৭ ঘন্টা অবস্থান করে শাংহাই ফিরলেন । স্যুয়েলিয়েনের জন্য আশা বয়ে আনার পাশাপাশি তালিয়েন শহরের "লিয়েনসিন"-এর কাহিনী তাকে গভীরভাবে মুগ্ধ করেছে । তিনি নিজের খরচে সাংহাই থেকে তালিয়েনে আসা যাওয়া করেন এবং বিনাখরচে স্যুয়েলিয়নের জন্য চিকিত্সা করেন । তিনি স্যুয়েলিয়েনের দাদাকে ৫০০ইউয়ান দেন এবং তাকে বলেন , আমাকে শাংহাইয়ের "লিয়েনসিন" হিসেবে গ্রহণ করুন । যাতে তালিয়েন ও সাংহাই মনেপ্রাণে সংযুক্ত হয় ।
২০০৬ সালের ৯ ডিসেম্বর তালিয়েন শহরের মেয়র সিয়া ত্যরেনকে পাঠানো চিঠিতে স্যুয়েলিয়েন বলে, আমাকে স্বপ্ন বাস্তবায়নে সাহায্য করুন । যে দাদাদাদি,নানানানি এবং চাচাচাচি আমাকে সাহায্য করেছেন আমি তাদেরকে একবার দেখতে চাই । মেয়র সিয়া স্যুয়েলিয়েনের চিঠি পেয়ে ভাবলেন, যদি আমি তাকে একটি চিঠি লিখি এবং সামান্য টাকাপয়সা পাঠাই । টাকাপয়সা বেশি না হলেও মানসিক দিক থেকে তাকে প্রেরণা দিতে পারে এবং এই সাহায্য তার আরোগ্য হওয়ার ব্যাপারে টাকার চেয়ে বেশি ভূমিকা পালন করবে । মেয়র সিয়া সময় করে স্যুয়েলিয়েনকে এক আন্তরিকতাপূর্ণ চিঠি ও ২০০০ ইউয়ান পাঠান । চিঠির সবশেষে লেখা আছে, তোমার বড় বন্ধু সিয়া ত্যরেন ।
২০০৬ সালের ২০ ডিসেম্বর বাবামার সঙ্গে স্যুয়েলিয়েন বিমানযোগে সাংহাই শিশু হাসপাতালে যায় । ২৬ ডিসেম্বর সকাল ১০টায় ডাক্তার ছেন ছিমিন নিজেই স্যুয়েলিয়েনের শল্যচিকিত্সা করলেন । শল্য চিকিত্সায় মোট ৫ ঘন্টা লেগেছে ।তিনি স্যুয়েলিয়েনের পেট থেকে ২কেজি ওজনের ডিউমার বের করলেন । শল্যচিকিত্সা অত্যন্ত সফল হলো । স্যুয়েলিয়েনের বাবামা আনন্দিত ও আবেগপূর্ণ হয়ে কেঁদে উঠলেন । তারা মনে করেন, তাদের জীবনযাপন আশায় ভরপুর ।স্যুয়েলিয়েনের স্বাস্থ্য খুব তাড়াতাড়ি আরোগ্য হয়ে উঠেছে । তালিয়েন শহরের পত্র-পত্রিকায় স্যুয়েলিয়েনের শল্যচিকিত্সা সম্পর্কে রিপোর্ট ও প্রবন্ধ প্রকাশিত হয় । এই সব খবর ও প্রবন্ধ পড়ে সবার মনে হয় , ভালবাসার পথে কেউই নিঃসংগ ও অসহায় অনুভব করতে পারে না ।
স্যুয়েলিয়েনের শল্যচিকিত্সা করানোর ব্যাপারে অর্থ ব্যবহার করা ছাড়া চাঁদা থেকে প্রাপ্ত অর্থের অনেক বাকি রয়ে গেছে । স্যুয়েলিয়েন ও তার বাবা মার অনুমোদনক্রমে বাকি চাঁদা অর্থ দিয়ে " লিয়েনসিন" নামে এক ত্রাণ তহবিল গড়ে তোলা হয় । দরিদ্র পরিবারের জন্মগত হৃদরোগে আক্রান্ত শিশুদের চিকিত্সায় এই ত্রাণ তহবিল কাজে লাগানো হবে । এ পর্যন্ত এই ত্রাণ তহবিল গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে । মোট ৯টি জন্মগত হৃদরোগে আক্রান্ত শিশু এ থেকে সাহায্য পেয়েছে ।
"তোমাকে হারাতে চাই না" শিরোনামে গল্পটি শুনলেন । কন্যা জায়া জননী অনুষ্ঠান আজকের মতো এখানে শেষ হল । শোনার জন্য ধন্যবাদ ।
|