চিং জাতি চীনের অন্যতম সংখ্যালঘু জাতি । তার লোকসংখ্যা ২০ হাজার । তারা দক্ষিণ চীনের ওয়ান ওয়েই , উ থৌ ও শাংসিন দ্বীপে বসবাস করে । আজ এ অনুষ্ঠানে চিং জাতির অধ্যুষিত তিনটি দ্বীপের সবচেয়ে দক্ষিণের দ্বীপ ওয়ান ওয়েই-এর গ্রামবাসীদের জীবনযাত্রা ও তাদের রীতি-নীতি সম্পর্কে আপনাদের জানাচ্ছি আমি…
সংবাদদাতা ওয়ান ওয়েই গ্রামে প্রবেশ করার সাথে সাথে চোখে পড়ল পথের দু'পাশে বেশ কিছু পাকা বাড়ি সারিবদ্ধ । গ্রামাবাসীদের বাড়ির সামনে নতুন নতুন মোটর গাড়ি দাঁড়ানো । গ্রামের সড়ক ও যানবাহন ব্যবস্থা উন্নত । গ্রামবাসীরা গাড়িতে মাছ ও চিংড়ি শহরে পাঠাতে ব্যস্ত ছিল । ওয়ান ওয়েই গ্রামের প্রধান সু মিং ফাং বলেন , ৩০ বছরেরও বেশি সময় আগে ওয়ান ওয়েই গ্রামটি খুব অনুন্নত ছিল । গ্রামবাসীরা যুগ যুগ ধরে সমুদ্রে মাছ ধরতো । সমুদ্রের তীরে আবাদী জমির অভাব বলে খাদ্য শস্য চাষ করা যেতো না । খাদ্যের জন্য গ্রামবাসীদের চল্লিশ পঞ্চাশ কিলোমিটার দূরে পাহাড়ী এলাকা হেঁটে যেতে হতো । খাদ্যের জন্য তারা মাছ ও চিংড়ি বিনিময় করতো ।
তখন গ্রামের সড়ক ছিল না । বাইরে যাওয়ার জন্য সমুদ্রপথের ওপর নির্ভর করতে হতো ।
সু মিং ফাং বলেন , গত শতাব্দির ষাটের দশকে সরকারের উদ্যোগে সমুদ্রের উপকূলীয় অঞ্চলের পরিবর্তে কৃষি জমি গড়ে তোলার অভিযান চালানো হয় । তখন সমুদ্রে বাঁধের মাধ্যমে ওয়ান ওয়েই , উ থৌ ও শানসিন দ্বীপকে মূলভূভাগের সঙ্গে সংযুক্ত করা হয়েছে । ফলে কৃষি জমির আয়তন বিপুলমাত্রায় বেড়ে গেছে । ১৯৭৮ সালে চীন সংস্কার ও উন্মুক্তকরণ চালু করায় চিং জাতির তিনটি দ্বীপের জন্য উন্নয়নের প্রাণবন্ত শক্তি বয়ে এনেছে । চীন ও ভিয়েতনামের মধ্যে সীমান্ত বাণিজ্য আবার শুরু হওয়ার পর সরকার স্থানীয় অর্থনৈতিক উন্নয়নকে উত্সাহ দেয়ার জন্য চিং জাতিকে বেশ কিছু অগ্রাধিকার দিয়েছে । এতে চিং জাতির সচ্ছল হওয়ার প্রত্যয় আরো উদ্দীপ্ত হয়েছে । সমুদ্রের উপকূলে অবস্থিত ওয়ান ওয়েই গ্রামে প্রাকৃতিক পরিবেশ ও বৈশিষ্ট্যকে কাজে লাগিয়ে ওয়ান ওয়েই গ্রামে মত্সসহ নানা রকম জলজ দ্রব্য চাষ করার কাজ শুরু হয়েছে । কিছু কিছু গ্রামবাসী ভিয়েতনামী ভাষা জানেন । তারা সীমান্ত বাণিজ্য চালু করেছেন । এ ছাড়াও চিং জাতির লোকেরা নিজের জাতির আচার ব্যবহার ও পরিবেশের বৈশিষ্ট্যকে কাজে লাগিয়ে পর্যটন শিল্পের উন্নয়ন করতেও শুরু করেছেন । তাদের বিখ্যাত নাচ ও গান পর্যটন শিল্পের একটি অনন্য প্রাধান্য হয়ে দাঁড়িয়েছে ।
এতক্ষণ আপনারা যা শুনলেন , তা চিং জাতির লোকদের গাওয়া লোক সংগীত । চিং জাতির সবাই নৃত্য ও সংগীত পরিবেশনে পারদর্শী । চিং জাতি অধ্যুষিত এলাকায় প্রতি দশ দিনে একবার নাচ-গান সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয় । তখন গ্রামের সকল সদস্য উত্সবের পোষাক পরে নাচেন ও গান করেন । ওয়ান ওয়েই গ্রামের প্রধান সু মিং ফাং বলেন , সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান চিং জাতির সবচেয়ে আড়ম্বরপূর্ণ ও জাঁকজমক উত্সব ।
এ ধরনের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান প্রতি মাসে তিনবার আয়োজন করা হয় । গায়ক-গায়িকাদের মধ্যে নিজেদের গ্রামবাসীসহ বিদেশে বসবাসকারী প্রবাসী চীনারাও রয়েছেন । তারা সবাই নিজের ইচ্ছানুসারে আসেন । সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে অংশ নেয়ার জন্য তাদের বিশেষভাবে আমন্ত্রণ জানানোর দরকার নেই ।
সীমান্ত বাণিজ্য ও পর্যটন শিল্পের উন্নয়নে ওয়ান ওয়েই গ্রামের চিং জাতির অধিবাসীরা সচ্ছল হয়ে উঠেছেন । ওয়ান ওয়েই গ্রামবাসীদের বর্তমান জীবনধারা প্রসঙ্গে ৬৪ বছর বয়স্ক বৃদ্ধ চেন সিয়ান ফাং বলেন ,
গ্রামবাসীদের জীবনযাত্রার মান অনেক উন্নত হয়েছে । ওয়ান ওয়েই গ্রামে বেশ কিছু পাকা বাড়ি নির্মাণ করা হয়েছে । বহু গ্রামবাসী ব্যক্তিগত মোটর গাড়ি কিনেছেন । তার নতুন পাকা বাড়িও নির্মাণ করেছেন । এ পর্যন্ত তিনি ও তার পরিবার পরিজনরা একটি মোটর গাড়ি , দু'টো মোটর সাইকেল এবং তিনটি সাইকেল কিনেছেন । তার পরিবারে ৬জন সদস্য আছেন । তাদের জীবনযাত্রার মান ব্যাপক উন্নত হয়েছে । আগে ওয়ান ওয়েই গ্রামে এ সব জিনিস একদম ছিল না ।
ওয়ান ওয়েই গ্রামের প্রায় ৯০ শতাংশ গ্রামবাসী কংক্রিট দিয়ে নির্মিত পাকা বাড়িতে থাকেন । আগে বেশির ভাগ গ্রামবাসী খড়ের বাড়িতে থাকতো । এখন প্রত্যেক গ্রামবাসীর বাড়িতেই টেলিভিশন রয়েছে । ২ হাজারেরও বেশি গ্রামবাসীর মোবাইল ফোন রয়েছে । গ্রামের অল্পবয়সীরা নেট নাগরিক হয়েছেন । তারা ইন্টারনেটের মধ্য দিয়ে বাইরের প্রচুর তথ্য অর্জন করতে পারেন ।
গ্রামবাসীরা বলতে গেলে সচ্ছল হয়ে উঠেছেন । তাদের অবসর সময় সাংস্কৃতিক জীবনের চাহিদা মেটানোর জন্য গ্রামের প্রধানরা নানা রকম ব্যবস্থা নিয়েছেন । গ্রামের একজন প্রধান সু মিং ফাং বলেন ,
গ্রামবাসীদের জীবনযাত্রার মান উন্নত হয়েছে । তাদের আমোদ প্রমোদের চাহিদাও অনেক বেড়েছে । সুতরাং গ্রামে প্রবীণদের জীবনযাপন ও আমোদ প্রমোদের সুব্যবস্থা করা হয়েছে । ফলে কৃষি কাজ ও ব্যবসা করার জন্য অল্পবয়সীদের এখন আর কোন চিন্তা নেই । কর্তৃপক্ষের উদ্যোগে গত বছর গ্রামের বিশ- তিরিশ জন বৃদ্ধ ও বৃদ্ধা পেইচিং ভ্রমণে যান । তারা রাজধানী পেইচিং ঘুরে ঘুরে দেখেছেন । মাতৃভূমির ব্যাপক পরিবর্তনের জন্য তারা খুব গর্বিত ও খুশি হয়েছেন । পরে আরো বেশি বৃদ্ধ ও বৃদ্ধারা অন্যান্য শহর ঘুরে দেখতে যাবেন । মাতৃভূমির সংস্কার ও উন্মুক্তকরণের উদ্দীপনায় গ্রামবাসীরা উত্ফুল্ল হয়ে উঠেছেন ।
গত বছরের জুন মাসে বৃদ্ধ চেন সিয়ান ফাং একটি প্রবীণ পর্যটক দলের সঙ্গে পেইচিং ভ্রমণে গিয়েছেন । তার ভ্রমণের অভিজ্ঞতা প্রসঙ্গে তিনি আবেগের সঙ্গে বলেন ,
তার বয়স ষাটেরও বেশি । আগে পেইচিং ভ্রমণে যাওয়ার কথা কখনো ভাবেন নি । এবারে যখন তিনি পেইচিং ঘুরে দেখছিলেন , তখন তার বাবা রোগে আক্রান্ত হন । পর্যটন শেষে বাবা তার ছবি দেখে খুব খুশি এবং স্বাস্থ্য পুনরুদ্ধার হয়েছে ।
চিং জাতির বসবাসকারী তিনটি দ্বীপের অনন্য বৈশিষ্ট্য রয়েছে । এখানে ভ্রমণে আসার জন্য তারা বন্ধুদের স্বাগত জানাচ্ছেন ।
|