সংস্কার ও উন্মুক্তকরণ অভিযান শুরু হওয়ার পর চীনের অর্থনীতির দ্রুত উন্নতি হয়েছে । এ উন্নতি ও চীনের সুপ্রাচীন সংস্কৃতি একটি প্রকান্ড চুম্বকের মত বিশ্বের বিভিন্ন স্থানের লোকদের আকৃষ্ট করছে । তাদের অনেকে লেখাপড়া , চাকরী ও পর্যটন করার জন্যে চীনে এসেছেন । তারা ভাষাগত আদান-প্রদান ও সাংস্কৃতিক ব্যবধানসহ নানা ধরণের বাধা-বিপত্তি অতিক্রম করে চীনে নিজেদের স্বপ্ন খুঁজে পেয়েছেন । ৪ বছর আগে সুইজারল্যান্ডের নাগরিক ফাবিয়েন কোলোম্বো দক্ষিণ চীনের কুয়াং সি চুয়াং জাতি স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চলের একটি মনোরম ছোট নগর ইয়াং সুয়োওয়ে আসেন । এখানে তিনি একজন লজ্জিত ছেলে থেকে ধাপে ধাপে একজন প্রাণচঞ্চল ইংরেজী শিক্ষকে পরিণত হয়েছেন । একই সময় তিনি চীনের সংস্কৃতি সম্পর্কে সম্পূর্ণ অচেনা একজন বিদেশী থেকে চীনের জীবন , প্রেম ও কাজকর্মের সংগে মেশানো একজন চীন বিষয়ক বিশেষজ্ঞ হয়ে দাঁড়িয়েছেন ।
একটি প্রবাদে বলা হয় , সারা পৃথিবীতে কুই লিনের নিসর্গ সবচেয়ে সুন্দর এবং সারা কুই লিনে ইয়াং সুয়োওয়ের নিসর্গ সবচেয়ে সুন্দর । অনেকের চোখে বিশ্বে চীনের কুয়াং সি চুয়াং জাতি স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চলের ইয়াং সুয়োও নগরের দৃশ্য সবচেয়ে মনোরম । প্রাকৃতিক চন্দ্র পাহাড় ও স্বপ্নের মত ইয়ু লুং নদী পর্যটকদের মন কেড়ে নেয় । ফাবিয়েনের জন্যে ইয়াং সুয়োওতে তার স্বপ্ন শুরু হয় ।
ফিবিয়েন ইয়াং সুয়োওতে তার প্রথম সফরের অভিজ্ঞতা বর্ণনা করে বলেন ,
২০০১ সালে আমি প্রথমবারের মত ইয়াং সুয়োওতে আসি । তখন সুইজারল্যান্ডে কাজ করতে করতে আমি একটু বিরক্ত হয়েছি । তাই আমি স্থির করি যে , আমি নিরলসভাবে কাজ করে যথেষ্ট অর্থ উপার্জন করার পর নিজে ৬ মাসের ছুটি উপভোগ করবো ।
গত শতাব্দির শেষ দিক থেকে চীনের অর্থনীতির স্থিতিশীল ও বেগবান উন্নতি হতে চলেছে , যা কর্মসংস্থানের যথেষ্ট সুযোগ সৃষ্টি করেছে । পাশাপাশি চীনের জীবনের শান্তিময় ও উদার পরিবেশ ও আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে চীনের ক্রমবর্দ্ধমান প্রভাব বহু সংখ্যক বিদেশীর দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে । অবশ্য ফিবিয়েনও এর ব্যতিক্রম নয় । তিনিও আশা করেন যে , এ প্রাচীন দেশে গিয়ে একবার দেখা যাক ।
যখন তিনি যথেষ্ট অর্থ উপার্জন করতে সক্ষম হন , তখন তিনি বিমানযোগে চীনের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হন । সেই প্রথম চীন সফরের অভিজ্ঞতা বর্ণনা করে তিনি বলেন ,
প্রথমে আমি হংকং এলাম । সেখানকার দৃশ্য দেখে আমি অবাক হলাম । কেন না , আমার দেশের বাড়িতে জনসংখ্যা ৮০০ মাত্র । অথচ ইউরোপ থেকে হংকংয়ে এসে আমি দেখতে পেলাম , এখানে ৭০ লাখ লোক বসবাস করেন এবং অসংখ্য আকাশচুম্বী দালানকোঠা রয়েছে ।
তবে কুয়াং সি স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চলের ইয়াং সুয়োওতে আসার পর ফাবিয়েন আবিষ্কার করেন , তিনি এখানকার সরল , শান্তিময় ও চঞ্চল জীবনকে বেশি পছন্দ করেন । ইয়াং সুয়োওতে বেশ কিছু সংখ্যক বিদেশী বাস করেন । ফাবিয়েন মনে করেন যে , তিনি যেন একটি আন্তর্জাতিক গ্রামে বসবাস করছেন ।
চীনের সংস্কার ও উন্মুক্তকরণের গোড়ার দিকের তুলনায় চীনে অবস্থানরত বিদেশীরা এখন শুধু পেইচিং ও শাংহাইয়ের মত বড় বড় শহরেই সীমাবদ্ধ নয় । গত কয়েক বছরে চীনে বিদেশীদের কর্মসংস্থানের সুবিধার্থে চীন সরকার বেশ কিছু নীতি গ্রহণ করেছে । অতীতে বিদেশীরা চীনে এলে কেবল নির্দিষ্ট অতিথিভবন বা হোটেলগুলোতে বসবাস করতে পারতেন এবং নিজের ইচ্ছামত বাসস্থান বেছে নিতে পারতেন না । ২০০৩ সালে পেইচিং পৌর সরকার বিদেশীদের থাকার ওপর এসব নিষেধাজ্ঞা তুলে নেয় । বিদেশিদের আকৃষ্ট করার জন্যে ইয়াং সুয়োও সরকারও কিছু সুবিধাজনক নীতি গ্রহণ করেছে ।
ফাবিয়েন ইয়াং সুয়োওতে থেকে খুব আনন্দ পান । তবে আনন্দময় সময় তাড়াতাড়ি চলে যায় । সুইজারল্যান্ডের সংশ্লিষ্ট নীতি অনুসারে তাকে স্বদেশে ফিরে তিন সপ্তাহের জন্যে সেনাবাহিনীতি কাজ করতে হবে । কাজেই আপাতত তাকে ইয়াং সুয়োও ত্যাগ করতে হবে । এ সময় একটি দুসাহসিক স্বপ্ন তার মন দখল করেছে । তিনি বলেন ,
ইয়াং সুয়োওতে আমি অনেক ভালো বন্ধুকে পেয়েছি । আমরা একসাথে দু:খ ও আনন্দে সমভাগী হতে চাই । তবে সুইজারল্যান্ডে ফিরে আসার পর আমি লক্ষ্য করেছি যে , প্রত্যেক লোক শুধু নিজের জন্যে জীবন জাটাচ্ছেন । কেউ আশেপামের লোকদের যত্ন নেন না । তখন আমি ভাবতে লাগলাম, ইয়াং সুয়োওতে আমি কত আনন্দ পেতাম । তাই আমি আবার স্থির করি , আমি আরো একবছর ধরে নিরলস কাজ করে যথেষ্ট অর্থ উপার্জন করার পর আবারো চীনে যাবো ।
এক অসম্পূর্ণ হিসাব থেকে জানা গেছে ,. এখন চীনে প্রায় ৫ লাখ বিদেশী অবস্থান করছেন । চীনের শ্রম ও সামাজিক নিশ্চয়তা বিধান মন্ত্রণালয়ের এক পরিসংখ্যান থেকে জানা গেছে , ২০০৬ সালের শেষ নাগাদ ১ লাখ ৮০ হাজার বিদেশী চীনে চাকরী করছেন । এটি ২০০৩ সালের তুলনায় দ্বিগুণ বেশি ।
২০০৩ সালে ফাবিয়েন আবারো ইয়াং সুয়োওতে আসেন । এবার তিনি একজন ইংরেজী শিক্ষক হিসেবে কাজ করছেন । তখন থেকে তিনি আর চীন থেকে চলে যান নি । আনন্দময় জীবন ও কাজকর্মের মধ্যে তিনি পেমিকাও পেয়েছেন ।
তার প্রেমিকা ইয়াং সুয়োওয়ের অধিবাসী । তিনি একটি রেসতোঁরায় কাজ করেন । তার মুখে সবসময় হাসি ফুটে । এটি গভীরভাবে ফাবিয়েনকে আকৃষ্ট করেছে ।
তিনি বলেন ,
কাজের ওপর তার মনোভাব সবার আগে আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে । তিনি সমানভাবে প্রত্যক লোকের সংগে ব্যবহার করেন , যারা বড় লোক হোক বা সাধারণ লোক হোক । এমন কি পথ হারানো বিদেশীদের সংগেও তিনি সুন্দর ব্যবহার করেন । এতে প্রমাণিত হয় , তিনি একজন সরলমনা লোক । তার রয়েছে স্নেহ-মমতা ।
তিনি বলেন , আমাদের দেখা হলে আমি সবসময় দেখি , তার হাতে একটি ইংরেজী-চীনা অভিধান আছে । আমার সংগে আলাপের সময় তিনি মাঝেমধ্যে অভিধান থেকে তার ব্যাখ্যা খুঁজে পান । আমিও এ অভিধান থেকে আমার ইংরেজীর চীনা ব্যাখ্যা খুঁজে পাই । এভাবে কথাবার্তার মধ্য দিয়ে আমার চীনা ভাষার মান যেমন , তেমনি তার ইংরেজীর মান বেশ উন্নত হয়েছে ।
ফাবিয়েন তার বাবা মার একমাত্র সন্তান । তার বাবা মা তার চীনে কাজ করার ব্যাপারে সবসময় বিরোধিতা করে আসছেন ।
২০০৬ সালে ফাবিয়েনের বাবা মা চীনে এসেছেন । চীনে এসে তারাও ছেলেটির বান্ধবীকে থাং চিংকে ভালোবেসেছেন । তার মা নিজের একটি আংটিকে এ চীনা মেয়ের আংগুরে পরিয়ে দিয়েছেন ।
|