মধ্য চীনের হুপেই প্রদেশের পশ্চিমাংশ ও দক্ষিণ পশ্চিম চীনের সিছুয়ান প্রদেশে থুচিয়া জাতি নামক একটি সংখ্যালঘু জাতি বসবাস করে । এ জাতি নৃত্য ও সংগীত পরিবেশনে দারুণ পারদর্শী । এ জাতির বয়স ৩ হাজার বছরেরও বেশি । এ জাতির ইতিহাসের পাশাপাশি শেষকৃত্যানুষ্ঠানে ব্যবহার্য শারহো নামক নৃত্য ও সংগীত এখনও প্রচলিত । আজ এ অনুষ্ঠানে হুপেই প্রদেশের পাতুং জেলার শানকুয়ান থানায় থুচিয়া জাতির শোকাচার পালনের প্রচলিত নৃত্য সংগীত সম্পর্কে আপনাদের কিছু বলছি আমি…
এতক্ষণ আপনারা যা শুনলেন , তা শারহো নামক শেষকৃত্যানুষ্ঠানের প্রচলিত থুচিয়া জাতির নৃত্য সংগীত । থুচিয়া জাতির অধ্যুষিত গ্রামে যখন বৃদ্ধরা বৃদ্ধারা মৃত্যুবরণ করেন , তখন তাদের স্মৃতির উদ্দেশ্য শ্রদ্ধা নিবেদন করার জন্য গ্রামবাসীরা এমন কি বিশ তিরিশ কিলোমিটার দূরের আত্মীয় স্বজনরাও চলে আসেন । তারা শোক প্রকাশের কক্ষে ঢোল বাজান এবং নাচ গান করেন । তাদের মধ্যে বেশ কিছু লোক এক রাত এমন কি তিন চার রাতও নাচ করেন । জানা গেছে , শারহো নামক নৃত্য ও সংগীত থুচিয়া জাতির পূর্বপুরুষদের যুদ্ধের নৃত্য ও ধর্মীয় উপাসনা অনুষ্ঠান থেকে এসেছে । হুপেই প্রদেশের এনশি বিভাগের থুচিয়া জাতি মিয়াও জাতি স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চলের সংখ্যালঘু জাতি ও ধর্মীয় কমিশনের ভাইস চেয়ারম্যান , সংখ্যালঘু জাতি বিষয়ক গবেষণা কেন্দ্রের ভাইস চেয়ারম্যান থিযান কাং ফা শারহো'র ইতিহাস সম্পর্কে সংবাদদাতাকে বললেন ,
শারহো আসলে থুচিয়া জাতির লোক নৃত্য সংগীতের বৈশিষ্ট্যের পরিচায়ক । থুচিয়া জাতির প্রতিটি গানের শেষ অংশের সঙ্গে শারহো যুক্ত হয় ।
শারহোর উত্পত্তিস্থল ইয়ানসানচেন থানা । সংবাদদাতা শারহো সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান দেখেছেন । ৭০ বছর বয়সী বৃদ্ধা থিয়ান সুও চ্যু মারা যাওয়ার পর তার পরিবার পরিজন তার স্মৃতির উদ্দেশ্যে বাড়িতে শারহো অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছেন । বৃদ্ধার প্রতি অন্তিম শ্রদ্ধা নিবেদন করার জন্য আশেপাশের আত্মীয় স্বজনরাও এসেছেন । এ দিন রাতে পাহাড়ী গ্রামে জাঁকজমকপূর্ণ নৃত্য সংগীত চলচ্ছিল । শোক প্রকাশের কক্ষে বাজানো হচ্ছিল ঢোল। থুচিয়া জাতির একজন পুরুষ একটি বড় ঢোল বাজাচ্ছেন । ঢোলের সংগীতের তালে তালে তিনজন তরুণ গান গাওয়ার পাশাপাশি নাচছেন । শোক প্রকাশ কক্ষের আশেপাশের গ্রামবাসীরা ও আত্মীয় স্বজনরাও নাচ দেখছেন , গান শুনছেন এবং অবশেষে শারহো অনুষ্ঠানেও যোগ দিয়েছেন । এ সব বিস্ময়কর নাচ গান প্রসঙ্গে থিয়ান ফা কাং বলেন ,
শারহো নাচ গান পরিবেশনের জন্য আত্মহারা অনুভূতির প্রয়োজন । শারহো নাচ গানের মধ্য দিয়ে নিহত ও নিহতের পরিবার পরিজনের প্রতি গ্রামবাসী ও আত্মীয় স্বজনের সহানুভূতি ও মায়া-মমতা পুরোপুরি প্রকাশ পেয়েছে।
থুচিয়া জাতির লোকেরা আবেগের সঙ্গে নাচ গান পরিবেশন করেন । তারা নাচ -গানের মাধ্যমে ভাব বিনিময় করেন । তারা চড়া কন্ঠে গান করেন , গানের বিষয়বস্তু খুব প্রাচুর্যময় । এভাবেই তারা নিহতদের স্মৃতির উদ্দেশ্যে শ্রদ্ধা নিবেদন করেন । এর মধ্যে বেশ কিছু নাচ -গানে নিহতদের জীবনী , পূর্বপুরুষদের প্রশংসা , ইতিহাস ও রূপ -কথার বর্ণনাও তুলে ধরা হয় । থুচিয়া জাতির নৃত্যের বৈশিষ্ট্য খুব আকর্ষণীয় । এ প্রসংগে থুচিয়া মিযাও জাতি স্বায়ত্তশাসিত বিভাগের সংখ্যালঘু জাতি ও ধর্মীয় কমিশনের ভাইস চেয়ারম্যান , সংখ্যালঘু জাতি গবেষণা কেন্দ্রের ভাইস চেয়ারম্যান থিয়ান ফা কাং বলেন ,
থুচিয়া জাতির লোকদের স্বভাব খুব উদার । তাদের নৃত্যের বৈশিষ্ট্যও খুব শক্তিশালী । এই ধরনের নৃত্য পরিবেশনের জন্য সাধারনতঃ চল্লিশ পঞ্চাশ ধরনের ডিজাইনের প্রয়োজন । শুধু দক্ষ শিল্পীরাই এ ধরনের নৃত্য পরিবেশন করতে পারেন ।
হুপেই প্রদেশের সংখ্যালঘু জাতি ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক থিয়ান ওয়ান চেন বলেন , থুচিয়া জাতির চিত্র আঁকার সঙ্গে শারহো নৃত্যের ঘনিষ্ঠ সম্পর্কও রয়েছে ।
শারহো বাঘের বৈশিষ্ট্য ও রীতি-নীতিরও পরিচায়ক । শারহো নৃত্য ভালভাবে চর্চা করতে চাইলে বাঘের বৈশিষ্ট্য অনুসরণ করা দরকার ।
শারহো নাচ গানে যেমনি থুচিয়া জাতির পূর্বপুরুষদের ছবি আঁকা ও ধর্মীয় বিশ্বাস বজায় রয়েছে , তেমনি এতে থুচিয়া জাতির সংস্কৃতি , ঐতিহ্য ও জীবন মরণ ধারণাও উত্তরাধিকার সূত্রে গ্রহণ করা হয়েছে । নিহতদের প্রতি শোক প্রকাশের জন্য থুচিয়া জাতির লোকেরা নৃত্যের মাধ্যমে তাদের শেষ বিদায় জানান । তারা চড়া কন্ঠে জীবন ও প্রাণের প্রশংসা করেন । থুচিয়া জাতির সংখ্যালঘু জাতি গবেষণা কেন্দ্রের ভাইস চেয়ারম্যান থিয়ান ফা কাং বলেন , জীবন মরণের প্রতি থুচিয়া জাতির এই ধারনার ওপর নির্ভর করে তাদের দীর্ঘায়ু মনও গড়ে তোলা হয়েছে ।
নিহতদের স্মৃতির উদ্দেশ্যে পরিবার পরিজন , আত্মীয় স্বজন ও গ্রামবাসীরা শোক ও অন্তিম শ্রদ্ধা নিবেদন করেন । তারা সবাই নিহতদের জন্য শোকাচার করেন । এতে এ জাতির আচার ব্যবহার ও স্বভাবও প্রতিফলিত হয়েছে । তারা মনে করেন , মানুষের মৃত্যুর পর পুনরুজ্জীবনও হতে পারে । সুতরাং জীবন-মরণের ব্যাপারে থুচিয়া জাতি খুব উদার । থুচিয়া জাতি নাচ গানে খুব পারদর্শী । সুতরাং নিহতদের স্মৃতির উদ্দেশ্যে শোকাচার অনুষ্ঠান আসলে আবেগপূর্ণ একটি নাচ- গানের অনুষ্ঠানেও পরিণত হয়েছে ।
সংস্কৃতির আধুনিকায়ন ও বাজার অর্থনীতি বিকাশের প্রভাবে থুচিয়া জাতির মধ্যে শারহো পরিবেশনের যোগ্য শিল্পী ও আগ্রহও ধীরে ধীরে হ্রাস পাচ্ছে । এই পরিপ্রেক্ষিতে শারহো শিল্পকলা সুরক্ষা ও বাঁচানোর জন্য স্থানীয় সরকার কার্যকর ব্যবস্থা নিয়েছে । ২০০২ সালে হুপেই প্রাদেশিক সরকার লোক শিল্পীদের মর্যাদা প্রদর্শন করার একটি কর্মসূচী এবং তাদেরকে যথাযথ ভর্তুকী প্রদানের ব্যবস্থা নিয়েছে । এ প্রদেশের ১৬জন প্রসিদ্ধ শিল্পী এপর্যন্ত স্থানীয় সরকারের বিশেষ সুযোগ-সুবিধা অর্জন করেছেন ।
স্থানীয় সরকারের উত্সাহ ও সমর্থনে লোক শিল্পীরা শারহো শিল্পকলা উত্তরাধিকার সূত্রে গ্রহণ করা এবং তাকে বিকশিত করাকে নিজেদের দায়িত্ব বলে মনে করেন । প্রাদেশিক সংস্কৃতি ও শিল্পকলা ব্যবস্থাপনা বিভাগ শারহো'র বিকাশ লাভ করার ওপর ব্যাপক গুরুত্ব দিচ্ছে ।
(থান ইয়াও খাং)
|