উ সিউচুনের ব্যাগের মধ্যে একটি লাল খাতা আছে । খাতার প্রথম পৃষ্ঠায় লেখা , অন্ধকার শেষে আলোকোজ্জ্বল দিন আসবে । মানুষের মনোবল দৃঢ় হতে হবে । ২০০২ সালের ১৪ ডিসেম্বর তারিখটি চিরকালই স্মৃতিতে থাকবে । জিজ্ঞেস করে জেনেছি, স্বামী জীবিত থাকাকালে আত্মীয়স্বজন বা বন্ধুদের কাছ থেকে যে টাকাপয়সা ধার নিয়েছিলেন তার সব বিবরণ উ সিউচুন খাতাটিতে লিখে রেখেছেন। স্বামীর পক্ষ থেকে এ সব ঋণ পরিশোধ করবেন বলে তিনি মনে মনে প্রতিজ্ঞা করেন ।
২০০২ সালের ১৪ ডিসেম্বর ছিল উ সিউচুনের কাছে এক দুঃখজনক ও নিষ্ঠুর দিন । বিশ বছরের জীবনসঙ্গী , নিজের প্রিয় স্বামী এক গাড়ি দুর্ঘটনায় তাদের আদরের মেয়ে ও বৃদ্ধবৃদ্ধা বাবা মাকে ছেড়ে চিরতরে চলে যান । শুধু তাই নয় । স্বামীর জিনিসপত্র গোছানোর সময় উ সিউচুন জানতে পারেন, স্বামী তার ওপর দুর্বহ শোক মৃত্যু ছাড়াও ২৭ লাখ ইউয়ানের মোটা ঋণের বোঝাও রেখে গেছেন ।
আইনগত দিক থেকে উ সিউচুন স্বামীর রেখে যাওয়া সম্পদ ও ঋণের উত্তরাধিকার ছেড়ে দিতে পারেন । কিন্তু দেখতে দুর্বল উ সিউচুন সবাইকে বিস্মিত করার মতো সিদ্ধান্ত নিলেন যে , তিনি স্বামীর পক্ষ থেকে এই সব ঋণ পরিশোধ করবেন । বিগত ৪ বছর ধরে উ সিউচুন অক্লান্ত চেষ্টায় স্বামীর রেখে যাওয়া ২০লাখ ৩০ হাজার ইউয়ানের ঋণ পরিশোধ করেছেন ।
টাকা পয়সা ধার করলে তা পরিশোধ করতেই হবে । মাত্র ১৮ দিন নিম্ন মাধ্যমিক স্কুলে লেখাপড়া করা এবং জীবনে মাত্র দুবার বাড়ির বাইরে যাওয়া এই গ্রামীণ নারী নিজের বাস্তব কাজ দিয়ে নিজের বিশ্বাসযোগ্যতা প্রমাণ করেছেন ।
উ সিউচুন একটি ছোটো পাহাড়ী গ্রামে থাকেন । আঁকাবাঁকা ও উঁচুনিচু একটি গিরিপথ গ্রাম থেকে বাইরে যাওয়ার এক মাত্র পথ । এই পথে কোনো গাড়ি বা বাস আসা-যাওয়া করে না । গ্রাম থেকে সবচেয়ে কাছের বাস স্টেশনটিও কম পক্ষে তিন-চার কিলোমিটার দূরে ।এই গিরিপথে প্রায় প্রতিদিন ভোরে বা রাতে একজন ছুটন্ত নারীকে দেখা যায়, তিনিই উ সিউচুন ।
কেন তিনি ছুটোছুটি করে গ্রামে আসা যাওয়া করেন –এ প্রশ্নে তার উত্তর সত্যিই মুগ্ধ হওয়ার মতো । তিনি বলেন , ছুটোছুটির মধ্যে থাকলে অন্য কোনো কিছু আর ভাবতে পারি না । স্বামী জীবিত থাকাকালে স্বামী-স্ত্রী দুজন হাতেহাত ধরে অনেকবার গিরিপথে যাওয়া-আসা করেছেন । স্বামী মারা যাওয়ার পর পারিবারিক বোঝা সব তার একার কাঁধে পড়ল । প্রতিদিনের জটিলতা ও ঝামেলা অজস্র । ছুটোছুটির কারণেই তিনি সব দুঃখ ভুলে থাকতে পারেন ।
২৭লাখ ইউয়ান মোটেও ছোট অংক নয় । উ সিউচুনের কাছে এটা কতো বড় বোঝা তা সহজেই অনুমেয় । তিনি বলেন, স্বামী সত্যিই ভাল একজন মানুষ ছিলেন । তাকে ভালবাসলে তার ব্যক্তিত্ব ও মর্যাদার বিন্দুমাত্র হানি হতে পারে এমন কিছু করা উচিত নয় । তাই আমি তার পক্ষ থেকে ঋণ পরিশোধ করে দেবই । উ সিউচুন বেশ কয়েকবার মৃত স্বামীকে চিঠি লিখেছেন , তুমি নিশ্চিন্তে থাকো । তোমার রেখে যাওয়া মোটা ঋণ আমি তোমার জন্যই শোধ করে দেব ।
বেদনা ভারাক্রান্ত উ সিউচুন পরিবারপরিজনের হাত ধরে ঋণ পরিশোধ করতে শুরু করলেন । প্রথমে অনেকে তার এই ঋণ পরিশোধকে সন্দেহের চোখে দেখতেন । সবার অবিশ্বাসের দৃষ্টি দেখে উ সিউচুন সবচেয়ে বেশি যেটা বলতেন , তা হলো, চিন্তা করবেন না । আমাকে কিছু সময় দেন । আপনাদেরকে আমি এক পয়সাও কম দেব না । তিনি ধার শোধ করে রসিদ স্বাক্ষর করিয়োএ নিতেন । ২০০ ইউয়ান এমনকি ৫ লাখ ইউয়ানের রসিদও তার কাছে আছে । এভাবেই উ সিউচুন নিজের আন্তরিকতা দিয়ে সবাইকে মুগ্ধ করেছেন এবং আস্থা অর্জন করেছেন ।
উ সিউচুন বলেন, তিনি যে প্রথম ঋণ পরিশোধ করেছেন তা স্থানীয় ক্রেডিট কোঅপারেটিভের ৫ লাখ এবং কয়েক ডজন শ্রমিকের বেতন । উ সিউচুন বলেন , ব্যাংকের ঋণ স্বামীর মর্যাদার সঙ্গে জড়িত, তাই আমাকে এই ঋণ শোধ করতে হবেই । আর নির্মাণক্ষেত্রের প্রতিটি শ্রমিক পরিবারের স্তম্ভ । সংসার চালানোর জন্য তারা আয় করতে আসে । তাদের বেতন দেরী করে দেওয়া উচিত নয় ।
আরেক শ্রমিক উ সিউচুনের স্বামীর নির্মাণক্ষেত্রে কাজ করতেন । স্বামী মারা যাওয়ার পর শ্রমিকটি নির্মাণক্ষেত্র ত্যাগ করে কোথায় চলে গেলেন কেউই জানেন না । এজন্য উ সিউচুন খুব চিন্তিত । কারণ শ্রমিকটিকে ৩০০ইউয়ান বেতন দেয়া হয়নি । দু-এক বছর পরের এক দিন উ সিউচুন হঠাত রাস্তার পাশে তাকে দেখলেন । তখন তিনি জুতা মেরামত করছিলেন । কেন তিনি বেতন নিতে আসেন না –এ প্রশ্নের উত্তরে শ্রমিকটি বললেন, যেখানে অনেক মালিক সময়মতো শ্রমিকদের বেতনই দিচ্ছেন না , সেখানে মালিক মারা গেলেও বেতন পাবেন এমন কথা সে ভাবতে পারেনি । কিন্তু এটা সত্য যে , তার মালিক মারা যাওয়ার পর মালিকের স্ত্রী ব্যাপারটা মনে রেখেছেন এবং নিজ হাতে তিনি তাকে ৩০০ইউয়ান পৌঁছে দিতে এসেছেন ।
৪ বছর সময়ের মধ্যে কয়েক হাজার লোক উ সিউচুনের হাত থেকে নিজেদের টাকাপয়সা ফিরে পেলেন ।
উ সিউচুনের বিশ্বাসযোগ্যতা প্রচুর মানুষকে মুগ্ধ করেছে এবং তাদের উপর এক ধরণের প্রভাবও পড়েছে। উ সিউচুন শ্বশুরশাশুড়ির ভাল বৌমা । বিয়ের দিন থেকে এ পর্যন্ত উ সিউচুন শ্বশুরশাশুড়ির সঙ্গে বসবাস করছেন । যাতে শ্বশুরশাশুড়ি সুখশান্তিতে তাদের বৃদ্ধবয়সের জীবনযাপন করতে পারেন সেজন্য স্বামী মারা যাওয়ার পর উ সিউচুন তাদের সামনে কখনো দুঃখ বা কষ্টের কথা বলতেন না । মাঝেমাঝে চিঠি লিখে স্বামীকে নিজের মনের কথা জানাতেন । " প্রিয় ইয়ুং , চিন্তা করবে না । আমি ভালভাবে বাবা মা ও দুই ছেলেকে লালন পালন করার দায়িত্ব পালন করব । বিশ্বাস করো, তোমার স্ত্রী পড়ে যাবে না । সে দৃঢ়তার সঙ্গে উঠে দাঁড়াবে ।
মায়ের দৃষ্টান্ত থেকে দুই ছেলে নানা নানীকে এবং মাকে খুব ভাল বাসে । ছোটো বেলা থেকেই শিক্ষা পেয়েছে যে , ভাল খাবার থাকলে নানা নানী ও বাবা মাকে খাওয়াতে হয় । বাবা মারা যাওয়ার পর ঋণ পরিশোধে মাকে সাহায্য করার জন্য ছেলেরা মিত্যব্যয়িতার সঙ্গে প্রতিটি পয়সা খরচ করত। ছেলেদের সদগুণের কথা বলতে গিয়ে মুগ্ধতায় উ সিউচুননের দু'চোখ জলে ভরে যেতো ।
|