চীনের তিব্বত স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চলের রাজধানী লাসা শহরের উত্তর উপকন্ঠে অবস্থিত তিব্বতী চিকিত্সা পদ্ধতি ও ওষুধ বিষয়ক থাংখা নামে চিত্র প্রদর্শনী ভবন এ বছরের অক্টোবর মাসে চালু হয়েছে । এ প্রদর্শনী ভবনে তিব্বতী চিকিত্সা পদ্ধতি ও ওষুধ এবং ক্যালেন্ডার ভিত্তিক ৮৪টি সুন্দর থাংখা প্রদর্শিত হচ্ছে । আজ এ অনুষ্ঠানে এ সম্পর্কে আপনাদের কিছু বলছি আমি…
তিব্বতী ভাষায় থাংখার অর্থ চিত্র । তা রঙবেরঙের রেশমী বস্ত্রে সাজানো ধর্মীয় চিত্র । এ ধরনের চিত্র সাধারণতঃ সূতি বা চটের কাপড়ে আঁকা হয় । প্রতিটি থাংখা ১ মিটার দীর্ঘ এবং ৮০ সেন্টিমিটার চওড়া । থাংখা আঁকা শুরু হয় ১ হাজার ৪ শো বছর পূর্বেকার সুংজানকানপু আমলে । থাংখার বিষয়বস্তু তিব্বতী জাতির ইতিহাস , সংস্কৃতি ও আচার ব্যবহারের সঙ্গে সম্পর্কিত ।
লাসায় থাংখা প্রদর্শনীতে যে ৮০টি থাংখা প্রদর্শিত হচ্ছে , তাতে প্রাচীনকালের তিব্বতী চিকিত্সা গ্রন্থের বিষয়বস্তু তুলে ধরা হয়েছে । চিকিত্সা থাংখা প্রাচীনকালের চিকিত্সা কাজকর্মের সবচেয়ে প্রফুল্ল ও প্রাণবন্ত শিক্ষা পদ্ধতির পরিচায়ক । তিব্বতী চিকিত্সা পদ্ধতি ও ওষুধ পন্ডিত ড্রাইদুল বলেন ,
এ সব থাংখা প্রাচীন তিব্বতী চিকিত্সা পদ্ধতি ও ওষুধ সংক্রান্ত ৪টি গ্রন্থের বিষয়বস্তুর সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ । থাংখার মাধ্যমে প্রাচীন তিব্বতী চিকিত্সা পদ্ধতির কথা পুরোপুরি প্রকাশ পেয়েছে । দেশী-বিদেশী চিকিত্সা বিশেষজ্ঞরা মনে করেন যে , এ ৮০টি থাংখা হল চীনের প্রাচীনকালে আঁকা চিত্রসহ চিকিত্সা গ্রন্থ । আনন্দের ব্যাপার এই যে , এ ৪টি প্রাচীন চিকিত্সা গ্রন্থ ভাল অবস্থায় সংরক্ষিত রয়েছে ।
প্রাচীন তিব্বতী চিকিত্সা পদ্ধতি ও ওষুধ বিষয়ক ৪টি গ্রন্থ লেখা হয় অষ্টম শতকে । এ সব গ্রন্থের লেখক তিব্বতী চিকিত্সা পদ্ধতি ও ওষুধ তৈরীকারী ইউথোক ইউনটেন গোনপো । তিনি তিব্বতের স্থানীয় চিকিত্সার অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে প্রাচীনকালের চীনের ঐতিহ্যবাহী চিকিত্সা , আরব চিকিত্সা ও ভারতের চিকিত্সার ফলাফলকে কাজে লাগিয়ে এ চিকিত্সা গ্রন্থ রচনা করেছেন ।
খ্রীষ্টাব্দট দ্বাদশ থেকে সপ্তদশ শতক পর্যন্ত তিব্বতী চিকিত্সা পন্ডিতরা বংশ পরম্পরায় চিকিত্সা গ্রন্থের জন্য ৮০টি থাংখা অঙ্কন করেছেন । এ সব থাংখা তিব্বতী চিকিত্সা পদ্ধতি অধ্যয়নের জন্য উত্ফুল্ল পাঠ্যপুস্তক প্রণয়ন করা হয়েছে । চীনের তিব্বত , ছিংহাই , কানসু ও ইউন্নানসহ তিব্বতী জাতি অধ্যুষিত অঞ্চলগুলোতে থাংখাসহ এ সব চিকিত্সা গ্রন্থ খুব প্রচলিত ।
তিব্বতের তিব্বতী চিকিত্সা ও ওষুধ গবেষণাগারের ডেপুটি অধ্যাপক সিটেন জিগমে বলেন , তিব্বতী চিকিত্সার থাংখার শুরু হয় অষ্টম শতকে । তখন মানুষের শরীর ব্যবচ্ছেদ করার সুবিধের লক্ষ্যে চিকিত্সা বিশেষজ্ঞরা এ ধরনের চিত্র তেরী করতেন ।
তিব্বতী চিকিত্সার ইতিহাস বিষয়ক গ্রন্থ অনুযায়ী , খ্রীষ্টাব্দ৭০৫ থেকে ৭৫৪ সাল পর্যন্ত তিব্বতী রাজার আমন্ত্রণে সিংচিয়ানের চিকিত্সা বিশেষজ্ঞ জানবাসিরাহা তিব্বতে এলেন । তিব্বতে আসার পর তিনি মানুষের শরীর-ব্যবচ্ছেদ -বিদ্যা বিষয়ক কয়েকটি গ্রন্থ রচনা করেছেন ।
জানবাসিরাহার রচিত মানুষের শরীর-ব্যবচ্ছেদ বিষয়ক চিত্রকে তিব্বতী চিকিত্সার প্রাচীনতম থাংখা বলে মনে করা হয় । সিটেন জিগমে বলেন , তিব্বতী চিকিত্সা সম্পর্কিত ৮০টি থাংখা সপ্তদশ শতাব্দিতে তিব্বতী চিকিত্সা পন্ডিত দিসি জানজিগ গিয়াগো ও অন্যান্যদের থাংখার ভিত্তিতে প্রস্তুত করা হয়েছে ।
দিসি জাংজিগের আগে অন্যান্যদের রচিত তিব্বতী চিকিত্সার থাংখা ছিল বিভিন্ন রকমের । দিসি জাংজিগ থাংখার কাজ সংস্কার করার জন্য সংশোধন ও পূর্ণাঙ্গ করে তোলার চেষ্টা করেছেন ।
দিসি জাংজিগ তিব্বত রাজত্বের জন্য পঞ্চম দালাই লামাকে সহায়তা করলেন । তিনিও ছিলেন তখনকার একজন প্রসিদ্ধ তিব্বতী চিকিত্সা পন্ডিত । অন্যান্য তিব্বতী চিকিত্সার থাংখা শিল্পীদের অভিজ্ঞতা বর্ণনা করার জন্য তিনি তিব্বতের বিভিন্ন অঞ্চরের নামকরা চিত্রকরদের আমন্ত্রণ জানান । ১৬৮৮ সালে তাদের মিলিত প্রচেষ্টায় চিকিত্সা বিদ্যা , মানুষের শরীরের অঙ্গ-প্রতঙ্গ এবং চিকিত্সায় ব্যবহার্য সরঞ্জামসহ একটি পূর্ণাঙ্গ ধারাবাহিক চিকিত্সামূলক থাংখা রচনা করা হয় । তিব্বতের তিব্বতী চিকিত্সা ও ওষুধ গবেষণাগারের ডেপুটি অধ্যাপক সিটেন জিগমে বলেন ,
কিন্তু পরে তিনি এ সব থাংখার বেশ কয়েকটি ভুল-ত্রুটি আবিষ্কার করলেন । সেজন্য পুনঃরচনা করার জন্য তিনি আবারও এ সব পন্ডিতকে আমন্ত্রণ করলেন । তুরফান রাজবংশ আমলে রচিত চিকিত্সা পদ্ধতি গ্রন্থ এবং তিব্বতী ওষুধসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রের ভিত্তিতে ১৭০৩ সালে তারা তিব্বতী চিকিত্সা বিষয়ক ৭৯টি ধারাবাহিক থাংখা রচনা সম্পাদন করেছেন ।
১৯২৩ সালে তিব্বতের খ্যাতনামা তিব্বতী চিকিত্সা পন্ডিত ছেনরাও নোর্বু প্রসিদ্ধ চিকিত্সক নামে একটি থাংখাও রচনা করেছেন । ফলে তিব্বতী চিকিত্সা বিষয়ক ৮০টি ধারাবাহিক থাংখা পুরোপুরি সম্পাদিত হয়েছে ।
এ সব থাংখায় যেমন মানুষের শরীর-ব্যবচ্ছেদ ও রোগ ৪ প্রতিরোধ বিষয়ক সাধারণ জ্ঞান বিষয়ক দিক রয়েছে , তেমনি চিকিত্সার নানা ধরনের কৌশলও তুলে ধরা হয়েছে । বহু শত বর্ষ পেরিয়ে যাওয়ার কারণে এ সব থাংখা কিছুটা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে । কিন্তু ত্রয়োদশ দালাই লামা ও প্রসিদ্ধ তিব্বতী চিকিত্সা পন্ডিতদের প্রচেষ্টায় এ সব থাংখা মেরামত ও মজবুত করা হয়েছে । এ ৮০টি থাংখা এখনও তিব্বতের যাদুঘর ও তিব্বতী হাসপাতালগুলোতে সংরক্ষিত রয়েছে । এটা উত্তরসূরীদের তিব্বতী চিকিত্সা পদ্ধতি ও সংস্কৃতি শেখার জন্য মূল্যবান তথ্য প্রদান করেছে । এ পর্যন্ত চীনের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় ও গবেষণাগারগুলোতে এ সব প্রাচীন তিব্বতী চিকিত্সা থাংখা থেকে প্রচুর মূল্যবান জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা পাওয়া যাচ্ছে ।
ভারতের একজন চিকিত্সা বিশেষজ্ঞ এ সব থাংখা দেখার পর বলেন , দ্বাদশ শতাব্দিতে রচিত তিব্বতী চিকিত্সার তত্ত্ব ও জ্ঞানে ভরপুর এ সব থাংখা যেমন চীন তেমনি বিশ্ব চিকিত্সা ইতিহাসেও অভূতপূর্ব । এ সব থাংখা বিপুল সংখ্যক থাংখা শিল্পী ও পর্যটকদের দৃষ্টি আকৃষ্ট করছে ।
|