সকাল সাড়ে আটটায় কাজাক জাতির মেয়ে মাহিরে সাইকেল চালিয়ে কোম্পানির অফিস ভবনে এসে দিনের কাজ শুরু করেন ।
২৭ বছর বয়সী মাহিরে সিনচিয়াং উইগুর স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চলের ইনিং শহরের একটি পারিবারিক সেবা দান কোম্পানির মালিক । দু বছর আগে কোম্পানিটি গঠনের পর এ পর্যন্ত প্রতিদিনই মাহিরে খুব ভোরে বাড়ি থেকে রওয়ানা দেন এবং রাতের বেলা বাড়ি ফিরে আসার মধ্য দিয়ে জীবনযাপন করে আসছেন । প্রতি দিন সকালে তিনি সবার আগেই কোম্পানিতে এসে দিনের পরিকল্পনা তৈরী করেন ও কর্মীদের জন্য কাজের ব্যবস্থা করেন । সন্ধ্যার দিকে সকল কর্মী অফিস ত্যাগ করার পর তিনি সারা দিনের কাজের সারসংকলন করেন । তার পর বাড়ি ফিরে যান ।
অন্য লোকের দৃষ্টিতে মাহিরে যে অত্যাধিক খাটাচ্ছেন তা তার নিজেরই সৃষ্ট। কারণ দু বছর আগে তিনি সরকারী অফিসের একজন কর্মী ছিলেন । কাজ ভাল এবং বেতনও মন্দ ছিল না । তিনি বলেন ,আমি স্থানীয় নারী ফেডারেশনের এক জন কর্মী ছিলাম । নারী ফেডারেশনে চাকরী করা আমার মারও ইচ্ছা । আমি স্থিতিশীল পরিবেশে কাজ করব বলে তিনি আশা করেন ।
২০০৩ সালে মাহিরে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক হন । সবার মনে , সরকারী অফিসে চাকরী করা যেমন স্থিতিশীল তেমনি ঝুঁকিও কম । সকলের পছন্দের কাজ কিন্তু মাহিরেকে ধরে রাখতে পারে নি তার পুরানো পেশায়। তিন বছর পর মাহিরে এই কাজ ছেড়ে দেন ।
সরকারী অফিসে আমি তিন বছর কাজ করেছি ।কোনো বিশেষ অগ্রগতি হয়নি , নতুন কিছু সৃষ্টি হয়নি । আমি মাকে বলিনি । পরিচালকের কাছে পদত্যাগ পত্র দাখিল করে আমি বেরিয়ে আসি ।
মাহিরে উপলব্ধি করে যে, সরকারী অফিসের কাজ তার চরিত্রের সঙ্গে খাপকায় না । তিনি নতুন চ্যালেঞ্জ পছন্দ করেন । অপছন্দীয় একটি স্থিতিশীল কাজে নিয়োজিত থেকে যায় , না নিজের ইচ্ছানুযায়ী ঝুঁকিপূর্ণ চ্যালেঞ্জের মোকাবেলা করবে ? বারবার চিন্তাভাবনা করার পর মাহিরে ঝুঁকিপূর্ণ চ্যালেঞ্জের মোকাবেলা করাটাকেই বেছে নেন । কিন্তু তিনি জানেন , মা তার সঙ্গে এক মত হবেন না। বাধ্য হয়ে তিনি প্রথমে কাজ তার পর রিপোর্ট দেয়ার পদ্ধতি বেছে নেন। জাতির ঐতিহ্যিক মনোভাবের কারণে কাজাক জাতীয়দের মধ্যে খুবই কম লোক ব্যবসা করেন । আমাদের পূর্বপুরুষদের মধ্যে বেশির ভাগ তৃণভূমিতে বসবাস করতেন । তারা আরামে জীবনযাপন করতেন । তাদের বাজার প্রতিদ্বন্দ্বিতার মনোভাব খুবই দুর্বল । ঐতিহ্যিক মনোভাবের দিক থেকে বাবা মা আমাকে ব্যবসা করার অনুমোদন দেবেন না ।
মা এখনো মাহিরেকেব্যবসা ছেড়ে দেয়ার পরামর্শ দেন । তিনি মাকে শ্রদ্ধা করেন । কখনো মার সঙ্গে ঝগড়া করেন না । এ ব্যাপারে তিনি চুপচাপ করে নিজের ভিন্ন মত প্রকাশ করেন । তার জন্য মার খুব দুঃখ হয় । আমি মার অনুভূতি বুঝি । আমি কথা দিয়ে তাকে উত্তেজিত করি না । আমি ভালভাবে এই কাজ করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি ।
পদত্যাগের পর মাহিরে একটি টাইপিং ও ফটো কপি করা দোকানের দায়িত্বভার নেন । হঠাত করে তিনি জানতে পারলেন , বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতক ছাত্রদের কর্মসংস্থান সম্পর্কে স্থানীয় সরকার সুবিধাজনক কিছু নীতি প্রণয়ন করেছে । ব্যাপারটা মাহিরেকে খুব আকর্ষণ করে । এ সম্পর্কে মাহিরে বলেন, স্থানীয় সরকারের নীতি অনুযায়ী বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতক ছাত্ররা ব্যবসা শুরু করার প্রথম দিকে ৫০ শতাংশ কর মওকুফের সুবিধা পাবে । বড় ভাই আমাকে বললেন , এই নীতির কল্যাণে তুমি কিছু করতে পারো?
মাহিরে মনে মনে ভাবলেন , সুযোগ এসেছে । আমি এই সুযোগকে কাজে লাগাব । তিনি বলেন , আমার প্রথম প্রতিক্রিয়া হল , একটি পারিবারিক সেবা দান কোম্পানি প্রতিষ্ঠা করা । কারণ নারী ফেডারেশনে চাকরী করার সময় আমি পারিবারিক সেবা দানের কাজ সম্পর্কে কিছু জেনে ছিলাম।
পারিবারিক সেবা দান কোম্পানির কথা বলতে গেলে সবাই বলবে যে , পারিবারিক সেবা দান কোম্পানির অর্থ হল , ঘর পরিস্কার করা বা বাচ্চাকে দেখাশোনার কোম্পানি । মাহিরের পারিবারিক সেবা দান কোম্পানি প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর অনেকে তাকে জিজ্ঞাস করেন যে , তিনি কেন পারিবারিক সেবা দানের কাজ করেন ?
মাহিরে মনে করেন , স্থানীয় কাজাক জাতি ও উইগুর জাতির নিজস্ব বৈশিষ্ট্যের অভ্যাস ও রীতিনীতি রয়েছে । এই বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী তিনি ভালভাবে তার পারিবারিক সেবা দান কোম্পানি চালাবেন । তিনি বলেন, জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত আমাদের ধারাবাহিক সেবাদান ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে । যেমন কাজাক জাতির শিশুর জন্মের প্রথম এক মাসপূর্তি অনুষ্ঠান, সাত বছর বয়সী মেয়ের কানে দুল পরানোর অনুষ্ঠান , বিয়ের অনুষ্ঠান অথবা অন্তেষ্টিক্রিয়া এবং গৃহ শিক্ষক সহ ধারাবাহিক সেবা দান ব্যবস্থা ।
কীভাবে নতুন পারিবারিক সেবা দানের কাজ বাস্তবায়ন করা যায় এবং ব্যবহারকারীদের উন্নত মানের সেবাদান করা যায় ? মাহিরে মনে করেন , আমার কোম্পানি শুধু ঘর পরিস্কারের সেবা দান করে না , আমাদের কর্মীদের অন্যান্য কাজের উচ্চ গুণগতমানও থাকতে হবে । তাই তিনি পত্রপত্রিকার মাধ্যমে বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতক ছাত্রছাত্রীদের আবেদন জানান । বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতক ছাত্রছাত্রীরা তার কোম্পানিতে আসবেন কিনা মাহিরে নিজেও জানেন না । কিন্তু তিনি স্বপ্নেও ভাবতে পারেন নি যে, দশ-বারোজন স্নাতক ছাত্র অন্তর্ভুক্তির জন্য নাম পাঠিয়েছে । সেল্কিনুর আসরাফ তাদের মধ্যে একজন । ছেলেটি এখন কোম্পানিতে ফোটোগ্রাফারের দায়িত্বে নিয়োজিত আছেন । তিনি জানান , তার মাধ্যমিক স্কুলে পড়ানোর একটি সুযোগও ছিল । কিন্তু তার চেয়ে তিনি বর্তমানের এই কাজ বেশি পছন্দ করেন । তিনি বলেন, অতীতে সরকারের বন্দোবস্ত অনুযায়ী স্নাতক ছাত্ররা একটি স্থিতিশীল আয়ের সুযোগ পেতো, কিন্তু নিজেদের ইচ্ছানুযায়ী পছন্দনীয় কাজ বেছে নিতে পারত না । এখন তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতার মুখোমুখী হলেও আমরা তা মোকাবেলা করতে যথেষ্ট আস্থাবান ।
এখন চীনে প্রতি বছর প্রায় ৪০ লাখ ছাত্র বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকডিগ্রী লাভ করছে । তারা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের পরিচালনায় নিজেদের পছন্দনীয় কাজ বেছে নিতে পারে । এ সম্পর্কে সিনচিয়াং উইগুর স্বায়ত্বশাসিত অঞ্চলের শ্রম নিরাপত্তা অফিসের কর্মসংস্থান বিষয়ক বিভাগের প্রধান সিয়াও মিং বলেন, আমরা সবসময় জোর দিয়ে উল্লেখ করি ,স্কুলে থাকাকালে ছাত্রদের ধাপেধাপে স্বেচ্ছায় কাজ বেছে নিতে এবং বাজার কর্মসংস্থানের ধারণা নিতে হবে । এখন বেশির ভাগ ছাত্রদের কর্মসংস্থানের ধারণা পরিবর্তন হয়েছে । প্রশিক্ষণ নেয়ার পর যাদের দক্ষতা রয়েছে তারা নিজেদের পছন্দনীয় কাজ বেছে নিচ্ছেন ।
এখন মাহিরের কোম্পানিতে মোট ৯জন কর্মী আছে । তারা সবাই বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতক ছাত্র । বাস্তবতা প্রমাণ করেছে , মাহিরে জীবনক্ষেত্রে ঠিক কাজটিকেই বাছাই করেছেন । ইনিং শহরের সকল নাগরিক জানেন , তাদের শহরে এমন একটি পারিবারিক সেবাদান কোম্পানি আছে সেই কোম্পানির মালিক ও কর্মীরা সবাই উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত । এই কারণে কোম্পানির কাজ দিন দিন বাড়ছে । আরও আনন্দের ব্যাপার হল এই যে , মাহিরের মাও তার বাছাইকে কিছুটা বুঝতে পেরেছেন । তিনি বিশ্বাস করেন, এমন একদিন আসবে যেদিন মা সত্যিই আন্তরিকভাবে তার প্রশংসা করবেন ।
|