কার্ল ক্রুক নয়া চীনের সমবয়সি । নয়া চীন প্রতিষ্ঠার ১৯৪৯ সালে কার্লের জন্মগ্রহণ হয়েছে চীনের পেইচিংয়ে । কার্ল চীনের উন্নয়নের সঙ্গে বড় হয়েছে । একজন বিদেশি হিসেবে তিনি চীনের বিরাট পরিবর্তন সবই দেখেছেন এবং এ সম্পর্কে খুব ভালো জানেন ।
এখন কার্ল ও তার মার্কিন স্ত্রী পেইচিংয়ের একটি ঐতিহ্য চক-মেলানো বাড়িতে থাকেন । এখন এ বাড়ির চার পাশে অনেক আধুনিক উঁচু ভবন নির্মিত হয়েছে । তাদের বাসায় অনেক বই , সি ডি , নীল ও সাদা রঙয়ের চীনামাটি , শ্রোতা বন্ধুরা হয়তো জানেন না , নীল ও সাদা রঙ হল চীনামাটির সবচেয়ে বৈশিষ্টময় রঙ , তা ছাড়া , তাদের বাসার আসবাবপত্র সবই চীনের তৈরি । তারা বাসার বিভিন্ন জায়গায় অনুভব করা যায় চীনের গন্ধ। যদিও কার্ল চীনের একটি পশ্চাত্য রেস্তোরাঁর পরিচালক , তবে তার বাসায় কোনো মদ নেই । তাদের বাসায় কয়েকটি পুরোনো ছবি তার পরিবার ও চীনের ইতিহাসের সম্পর্কের কথা প্রমাণ করছে । ছবিতে কার্লের বাবা মা জাপ বিরোধী যুদ্ধের সময় চীনের কমিউনিস্ট পার্টির অষ্টম ফৌজের উর্দি পরেন ।
কার্ল ক্রুক পরিবারের চীনের গল্প কার্লের বাবা থেকে শুরু করতে হয় । কার্লের বাবা ডেভিড ক্রুক ১৯৩৬ সালে ব্রিটেনের কমিউনিস্ট পার্টিতে যোগ দেন , পরে তিনি আন্তর্জাতিক ব্রিগেটের সদস্য হন এবং কয়েকটি যুদ্ধে অংশ নেন । তবে একটি যুদ্ধে তিনি আহত হন । হাসপাতালে থাকার সময় তিনি মার্কিন সাংবাদিক এডগার স্নোর লেখা "রেড স্টার ওভার চায়না" পড়েছেন এবং এর থেকে অনুপ্রেরণা পেয়েছেন । তাই ১৯৩৮ সালে তিনি সাংহাইয়ে এসেছেন এবং সেখানে একটি স্কুলে ইংরেজী ভাষা এবং সাহিত্য শেখান । এক বছর পর তিনি চীনের সি ছুয়ান প্রদেশের ছেং তু শহরে যান । সেখানে তিনি একজন কানাডিয়ান মেয়ে ইসাবেল ব্রোনকে পছন্দ করেন । বিয়ে করার পর ১৯৪৭ সালে তারা চীনের উত্তরাঞ্চলে গিয়ে হো পেই প্রদেশের সি লি তিয়ান নামে একটি জায়গায় বসবাস শুরু করেন । তারা স্থানীয় লোকজনের সঙ্গে খান এবং জীবনযাপন করেন । ১৯৫৯ সালে তাদের সেখানকার জীবন নিয়ে "সি লি তিয়ান--চীনের একটি গ্রামের বিপ্লব" নামে একটি বইয়ের লেখা শেষ করেন এবং তা লন্ডন থেকে প্রকাশিত হয় । এ বইয়ের মাধ্যমে পশ্চিমা দেশগুলোর লোকেরা তখনকার চীনের পরিস্থিতি সম্পর্কে ভালোভাবে জানতে পেরেছেন । আসলে নয়া চীন প্রতিষ্ঠার পর কার্লের বাবা মা'র ব্রিটেনে যাওয়ার কথা । তবে তারা এভাবে করেন নি , তারা চীনের আমন্ত্রণে চীনের প্রথম ইংরেজী ভাষার বিদেশি শিক্ষক হিসেবে পেইচিংয়ে ছিলেন। কার্ল ছোটবেলার সময় স্মরণ করে সংবাদদাতাকে জানিয়েছেন , তিনি স্থানীয় পেইচিং নাগরিকদের মত হু থুংয়ে বড় হয়েছেন তাই নয় । তাকে নতুন যুগের পেইচিং নাগরিক হিসেবে বলা যায় । সে সময় শহরে বিদেশি শিশু খুব কম দেখা যেত। তাই তার পাশে অনেক উত্সুক লোক তাকে দেখে এবং তাকে চীনের বৈশিষ্টময় খাবার খাওয়ায় । যখন কার্ল পরিবারের সাহায্য দরকার , চীনারা সবসময় তাদেরকে সাহায্য করে । যদিও তখন চীনে বিদেশি খুব কম এবং ভাষা হল তাদের যোগাযোগের বাধা । তবে তারা ও চীনাদের মৈত্রী বাড়ানোর ওপর তা কোনো নেতিবাচক প্রভাব ফেলে নি । শ্রোতা বন্ধুরা হয়তো আপনারা বিশ্বাস করবেন না যে , কার্ল ৮ বছর বয়সের আগে ইংরেজী ভাষা শেখেন নি । তিনি বলেন , তারা বাবা মা যদিও চীনে এত বেশি বছর থাকেন , বিশেষ করে আমার মা , তবে তারা এখনোও ভালোভাবে চীনা ভাষা বলতে পারেন না , তারা আশা করেন তাদের ছেলে সুন্দরভাবে চীনা ভাষা বলতে পারবে ।
কার্ল আরো ভালো শিক্ষা গ্রহণের জন্য তার বাবা মা তাকে পেইচিংয়ের একটি বোর্ডিং স্কুলে দিয়েছেন । যাতে কার্ল দ্রুতভাবে চীনের পরিবেশের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে এবং এ দেশকে আরো বেশি উপলব্ধি করতে পারেন । বোর্ডিং স্কুলে লেখাপড়ার অভিজ্ঞতা কার্লের মনে খুব সুন্দর স্মরণ । যদিও তিনি একজন বিদেশি ছাত্র , তবে তিনি ও তার সহপাঠীর সম্পর্ক খুব ভালো । দেশ ও ভাষার পার্থক্য তাদের যোগাযোগের বাধা হয় নি । তার সহপাঠী কার্লকে অনেক সাহায্য করেছে । ফলে তিনি খুব দ্রুতভাবে চীনের জীবনের সঙ্গেমিশে যেতে পেরেছেন । শিক্ষক ও সহপাঠীর সাহায্যে কার্ল শ্রেষ্ঠ ফলাফল নিয়ে স্নাতক হয়েছেন । এর পরে কার্ল চীনে থাকেন । কারণ তিনি ইতোমধ্যেই নিজেকে একজন চীনা হিসেবে দেখেন । তার সঙ্গে চীনের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে ।
কার্লের ভাষার সুবিধা ও তার শিক্ষার প্রেক্ষাপটের কারণে তিনি খুব সহজেই একটি চাকরি পেতে পারেন । তবে নিজের সামর্থ্য আরো বাড়ানোর জন্য তিনি পরে যুক্তরাষ্ট্রে গিয়ে লেখাপড়া করেছেন । শিক্ষা ও পূর্ব এশিয়া গবেষণা বিষয়ক মাস্টার ডিগ্রী পাওয়ার পর নিজের সামর্থ্য কাজে লাগানোর জন্য তিনি আবার চীনে ফিরে এসেছেন । চীনে চাকরি খোঁজার সময় অন্য প্রার্থির চেয়ে তার বেশি সুবিধা ছিল , তিনি ইংরেজী ও চীন ভাষা সুন্দরভাবে বলতে পারেন । পরে তিনি পশ্চিমা দেশের তেল ও প্রাকৃতিক গ্যাস গ্রুপের পেইচিং কার্যালয়ের প্রতিনিধি হয়েছেন।
কার্ল বলেন , তিনি প্রায় সারা জীবন চীনে থেকেছেন । তিনি মনে করেন পেইচিং একটি চমত্কার শহর । এখানে জন্মগ্রহণ এবং চীনের সঙ্গে বড় হওয়ার জন্য তিনি মনে করেন খুব ভাগ্যবান । তিনি চীনের দ্রুত উন্নয়নকেও অনুভব করেছেন । চীনের উন্নয়ন বিশ্বের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে , তিনি বলেন , প্রতিদিন তিনি চীনের উন্নয়নের গতি উপভোগ করতে পারেন ।
কাজ না থাকলে কার্ল চীনের ইতিহাস ও সাহিত্য গবেষণা করতে পছন্দ করেন । তার ৯২ বছর বয়সী মাও এ শহরে থাকেন , এখন তার স্বাস্থ্যও খুব ভালো । তারা দু'জনই পুরোপুরি পেইচিংয়ের নাগরিক হয়েছেন । তাদের মতে , এখানে তাদের বাসা , তারা সারা জীবন ধরে পেইচিংয়ে থাকতে চান । তিনি বলেন , যেন আমার সবচেয়ে প্রিয় বই পড়া , এ শহরে থাকায় আমি হৃদয়ে উষ্ণ ও আনন্দ বোধ করি ।
|