লো ইংচেনের স্বামী লো চিনইয়ুং একজন সৈনিক ছিলেন । এক দিন দায়িত্ব পালনের সময় আহত হয়ে তিনি দু বছর ধরে অচেতন থাকেন । এই দু বছর সময়ের মধ্যে স্ত্রী লো ইংচেন এক দিনও স্বামীকে ত্যাগ করেননি । তিনি স্বামীর যত্ন নেন । তাকে খাওয়ান । তাকে মালিশ করে দেন । তার সঙ্গে কথা বলেন ……। অবশেষে স্বামী মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরে আসেন ।
লো ইংচেন স্বামী লো চিনইয়ুংকে সঙ্গে নিয়ে পেইচিংয়ে তার আরোগ্যের চেষ্টা করে যাচ্ছেন। সাক্ষাত্কার দেয়ার আগে তিনি সংবাদদাতার কাছে ছোটো একটি অনুরোধ করেন যে, রাত সাড়ে দশটার পর তার ভাড়া বাড়িতে তিনি সাক্ষাত্কার দেবেন । কারণ প্রতি দিন সকাল ৭টা থেকে রাত ১০টা পর্যন্ত তিনি হাসপাতালে স্বামীকে দেখাশোনা করেন । তিনি চান না সাক্ষাত্কারের কারণে স্বামীর চিকিত্সা ব্যাহত হয় ।
"ইয়ুং , পড়ে যেও না । অটল থাকার চেষ্টা করো । অতিক্রম করা যায় না এমন কোনো অসুবিধা থাকবে না । আমি সব সময় তোমার পাশে আছি । আমি সব সময় তোমাকে সমর্থন করি । তুমি আমার কথা শুনছো?"
" আমি যে প্রচেষ্টা চালাচ্ছি তা সবই তোমাকে ফিরিয়ে আনার জন্যই, তোমাকে দাঁড় করাব আমি । আমি কখনো প্রচেষ্টা ছাড়ব না । ইয়ুং, চেষ্টা করো , কখনো আস্থা হারিও না।"
" আমরা বলেছিলাম , চুল সাদা না হওয়া পর্যন্ত আমরা দুজন সারা জীবনে এক সঙ্গে থাকব । কখনো ছাড়াছাড়ি হবে না । ইয়ুং , আমার হাত ধরো, কখনো ছেড়ো না । এটা আমার বৃহত্তম এবং একমাত্র আশা । আমাকে কথা দাও । জানি না , তোমাকে ছাড়া আমি কিভাবে দিন কাটাব ।"
কথাগুলো লো ইংচেনের ডাইরী থেকে উদ্ধৃত করা হয় । স্বামী লো চিনইয়ুং অজ্ঞান হওয়ার ৬০০ দিনের মধ্যে লো ইংচেন প্রায় ৬০০টি ডাইরী লিখেছেন । প্রায় দু বছর সময়ের মধ্যে লো ইংচেন মনোযোগের সঙ্গে স্বামী লো চিনইয়ুংর যত্ন করেন। নিজের ভালবাসা দিয়ে মৃত্যুপ্রায় অচেতন স্বামীকে ফিরিয়ে আনেন । এখন লো চিনইয়ুংর অবস্থা অনেক ভাল হয়েছে । আগের চাইতে এখন অনেক সচেতন হয়েছেন । স্পষ্টভাবে কথা বলতে না পারলেও তিনি এখন সংক্ষিপ্ত হাঁ বা না করে নিজের অর্থ ব্যক্ত করতে পারছেন । তাকে অতীতের কথা জিজ্ঞেস করলে তিনি সংক্ষিপ্ত উত্তর দিতে পারেন এবং কলম দিয়ে নিজের মনের কথা প্রকাশ করতে পারেন ।
"জ্ঞান ফিরে আসার পর সে কলম দিয়ে প্রথমটিযে কথাটি লিখেছে তা হল, লো ইংচেন, আমি তোমাকে ভালবাসি । অক্ষরগুলো তেমন সুন্দর না বা স্পষ্ট না হলেও আমি যে মুগ্ধ হয়েছি তা ভাষায় প্রকাশ করতে পারি না ।" লো চিনইয়ুংয়ের জ্ঞান ফিরে আসার কথা স্মরণ করলে লো ইংচেন এখনো আবেগপূর্ণ । লো চিনইয়ুংয়ের জ্ঞান যে ফিরে এসেছে সেকথাটা তিনিই প্রথমই লক্ষ্য করেছেন । আসলে অচেতন মানুষ শুধু কাঠের মতো বিছানায় শুয়ে থাকতে পারে তা নয় , তারা চোখ মিটমিট করতে এবং হাঁচি দিতেও জানে । তাদের শারীরিক প্রতিক্রিয়া আছে । এক দিন লো ইংচেন আগের মতো স্বামী লো চিনইয়ুংয়ের সঙ্গে কথা বলছিলেন । তাদের আগের কথা বলছিলেন । কয়েকটা কথা বলার পর লো ইংচেন এমন একটি কথা বলতেন , আমার কথা বুঝতে পারলে তুমি চোখ মিটমিট করো। আগে স্ত্রীর কথা শুনে লো চিনইয়ুংয়ের কোনো প্রতিক্রিয়া ছিল না । কিন্তু এই দিন স্ত্রীর কথা শোনার পর লো চিনইয়ুং হঠাত্ চোখ মিটমিট করলেন । লো ইংচেন এত আনন্দিত হন যে , সেই সময় আনন্দে আমার গোটা শরীর কেঁপে উঠল । আমার হৃদয়ের স্পন্দন বেড়ে গেলো । আমি বারবার নিজেকে বললাম , খুব সম্ভব এটা আকস্মিক ঘটনা । কিন্তু বারবার পরীক্ষা করে আমি বুঝলাম , আমার প্রিয় স্বামীর জ্ঞান সত্যি ফিরে এসেছে ।
লো চিনইয়ুংয়ের অবস্থা দিন দিন ভাল হয়ে যাচ্ছে বটে , কিন্তু যখন হাসপাতাল থেকে বাসায় ফিরে যায় তখন লো ইংচেনের মন যেন ভারি ভারি লাগে । সব সময় স্বামীর কাছে থাকতে না পারার কারণে তিনি খুব চিন্তিত । আহত হওয়ার দেড় বছরে লো চিনইয়ুং গুরুতর অবস্থায় ছিলেন । লো ইংচেন স্বামীকে হারানোর ভয় করতেন । লো চিনইয়ুংয়ের প্রাণ রক্ষা পেয়ে গেলো । স্বামী চিরকালের জন্য ঘুমিয়ে পড়বে এবং ঘুম থেকে আর জেগে উঠবে না বলে লো ইংচেন ভয় পেতেন। স্বামীর অবস্থা এখন দিন দিন ভাল হয়ে উঠছে দেখে লো ইংচেন আবার ভয় করেন , আরোগ্যের জন্য প্রশিক্ষণ নিতে স্বামী দৃঢ়সংকল্প হবে কি না । তার আরও ভয় যে , পুরোপুরি সচেতন হওয়ার পর নিজের স্বাস্থ্যের অবস্থা এবং অন্য লোকের তুলনায় নিজের দুর্দশালক্ষ্য করার পর স্বামীর মানসিক চাপ হলে তাকে কি করতে হবে ।
তিন বছর ধরে লো চিনইয়ুং ও লো ইংচেন দম্পতির কাহিনী অনেক মায়ামমতাপূর্ন লোককে আকৃষ্ট করেছে । যারা নিজেকে সাহায্য করেছেন তাদের কথা স্মরণ করে লো ইংচেন খুব ধন্য মনে করেন । হতাশ এবং অসহায় অবস্থারসময় তারা তাকে সান্তনা দিতেন । চিঠি, ইমেল এবং হাসপাতালে লো চিনইয়ুংকে দেখার মাধ্যমে তাদের সহানুভূতি ব্যক্ত করেন । তারা কে আমি জানি না । তবে গভীর রাতে যখন আমি নিঃসঙ্গ হয়ে ভয় পাই তখন আমি বারবার তাদের চিঠি ও ইমেল পড়ি এবং এগুলো থেকে উষ্ণতা লাভ করি । আমি জানি ,আমি একা নই । আমার পাশে জানা অজানা অনেক লোক আমাকে সমর্থন করছেন এবং আমার সঙ্গে আছেন । আমি চেষ্টা চালাতে থাকব , কখনো পরিত্যাগ করব না ।
এ জন্য লো ইংচেন সারা দেশের শ্রেষ্ঠ নারী হিসেবে নির্বাচিত হয়েছেন । এ সম্পর্কে লো ইংচেন বলেন , আমার মতো অনেক লোক আছেন । সৌভাগ্য যে , আমার নাম আজ সবার কাছে পরিচিত । যদি আমার এই পুরস্কার অন্য কাউকে দিতে পারি, তাহলে আমার মতো অন্য একজন এই পুরস্কার পেতে পারবেন বলে আমি আশা করি । আমি যে কাজ করেছি বা করছি তা শুধু স্ত্রী হিসেবে আমার করণীয় দায়িত্ব । আমি যে পুরস্কার পেয়েছি তা শুধু আমার নয় আমার মতো সকল স্ত্রীর জন্য ।
এখন স্বামীকে কি কথা সবচেয়ে বেশি বলতে চান প্রশ্নের উত্তরে লো ইংচেন হেসে হেসে বলেন, তাকে আমার অনেক কথা বলার আছে । কিন্তু যদি সে আরোগ্য হয়ে ওঠে এবং চিরকালই আমার সঙ্গে সামনে এগিয়ে যেতে যায় এবং দুজন আনন্দ ও সুষ্ঠুভাবে জীবিত তাকতে পারি তাহলেই আমি সন্তুষ্ট । যদি আমার স্বামী অব্যাহতভাবে মাদকদ্রব্য এবং অপরাধীদের দমন করতে পারে তাহলে আমি বিনাশর্তে তাকে সমর্থন করতে থাকব ।
|