গ্রামীণ ডাক্তার লিউ ইউয়ুনলিয়েন ৪১ বছরে প্রায় তিন লাখ রোগীর জন্য চিকিত্সা করেছেন ।
লিউ ইউয়ুলিয়েন দেখতে খুব সুন্দর । বয়স পঞ্চাশেরও বেশি । তার পরও তার দেহের পাতলা গঠন, শরীরে সুন্দর সুন্দর পোশাক এবং হাসি হাসি মুখ । একবার দেখলে ভোলা যায় না ।
চীনের কানসু প্রদেশে লিউ ইউয়ুলিয়েনের জন্ম । ১৫ বছর বয়সে তিনি বাবা মার সঙ্গে সিনচিয়াংয়ে আসেন । সে সময় তাঁর পরিবার খুবই গরিব ছিল । বাবা মার স্বাস্থ্য ভাল ছিল না । ভাই বোন ছোট ছিল । বড় মেয়ে হিসেবে তার কাঁধেই সংসারের ভারী বোঝা ।
লিউ ইউয়ুলিয়েন বলেন , ছোটবেলায় তার অনেক স্বপ্ন ছিল । যখন তিনি বাবা মার সঙ্গে রেলগাড়ি করে সিনচিয়াং যেতে যেতে দেখলেন অনেক মানুষের সাহায্য দরকার । তিনি ভাবলেন , আমি বড় হলে রেলগাড়ির কর্মী হব এবং সাহায্য দরকার এমন সব লোককে সাহায্য করব । আবার খারাপ লোক দেখলে তার পুলিশ হওয়ার ইচ্ছা জাগে ।তিনি ভাবতে থাকেন , পুলিশ হয়ে আমি এই সব অপরাধীকে শাস্তি দেবো । কিন্তু লেখাপড়া করে চিত্রশিল্পী হওয়াটা তার জীবনের লক্ষ্য । তিনি রং তুলি দিয়ে সুন্দর জীবন ফোটাতে চান ।
পরিবারের অসুবিধা কাটিয়ে ওঠার জন্য ১৫ বছর বয়সী লিউ ইউয়ুলিয়েন বাধ্য হয়ে স্কুল ছেড়ে গ্রামের উত্পাদন টিমের সঙ্গে কাজে যোগ দেন । কয়েক মাস পর উত্পাদন টিম তাকে গণ কমিউনের ক্লিনিকে প্রশিক্ষণ নিতে পাঠায় । এর পর তাঁর গ্রামীন চিকিত্সকের জীবন শুরু হয় ।
লিউ ইউয়ুলিয়েন যে গ্রামে বসবাস করেন সেই গ্রাম উইগুর জাতি অধ্যূষিত এলাকা । ৯৮ ভাগ গ্রামবাসী হলেন স্থানীয় উইগুর জাতির লোক । তাদের মধ্যে বেশির ভাগ শুধু উইগুর ভাষা বলতে পারেন । প্রথম দিকে ভাষার সমস্যায় তার অনেক ঝামেলা ও কষ্ট হতো । তিনি জানালেন , তারা কি বলতো , আমি কিছুই বুঝতে পারতাম না । আমি কি বলি , তাও তারা বুঝতেন না । কথা না বুঝলে মত বিনিময় করা যায় না । কথা না বুঝলে রোগীদের অবস্থা জানা যায় না এবং চিকিত্সা করা যায় না। তাই আমি সিদ্ধান্ত নিয়ে উইগুর ভাষা শিখতে শুরু করে দিলাম ।
শিক্ষক না থাকলে বুদ্ধিমতী লিউ ইউয়ুলিয়েন নিজে নিজেই শিখতে থাকেন । রোগীদের চিকিত্সা করার সময় হান ভাষা বলতে পারেন এমন উইগুর জাতির ভাইবোনের কাছ থেকে তিনি দু একটা কথা শিখে নিতেন । সেগুলো খাতায় লিখে বারবার মুখস্থ করেন । পাঁচ-ছয় মাস পর লিউ ইউয়ুলিয়েন বলা ও বোঝার মতো উইগুর ভাষা আয়ত্ত করে ফেললেন।
লিউ ইউয়ুলিয়েন একজন ভাল ডাক্তার । কিন্তু তিনি মনে করেন , স্বামীর জন্য তিনি ভাল স্ত্রী নন এবং সন্তানের জন্য ভাল মা নন । কেউ ভাবতেই পারেন না যে , তিনি ৬টি সন্তান হারানোর কষ্ট ও বেদনা পার হয়ে এসেছেন । কাজের কারণে তাকে প্রত্যেক দিন মরুভূমির মধ্য দিয়ে আসা-যাওয়া করতে হয় । অতিরিক্ত ক্লান্তিতে তার দুবার গর্ভপাত হয় । কয়েক বছর পর তার তৃতীয় সন্তানের জন্ম হল । কিন্তু কিছু দিনের মধ্যে সেই সন্তান অকালে মৃত্যুবরণ করল । ১৯৭৭ সালে লিউ ইউয়ুলিয়েনের ষষ্ঠ সন্তান—একটি স্বাস্থ্যবান মেয়ে জন্ম নিল । কিন্তু দুর্ভাগ্য আবার তার ওপরে আঘাত হানল । লিউ ইউয়ুলিয়েনের এই আদুরে মেয়েটিও তাকে ছেড়ে চলে গেল । মেয়ের বয়স যখন ১১ মাস তখন একদিন এক গ্রামবাসী রোগে আক্রান্ত হলো। খবর পেয়ে লিউ ইউয়ুলিয়েন তার চিকিত্সা করতে যাওয়ার জন্য তৈরি হলেন । কিন্তু ১১ মাসের মেয়েকে কথায় রেখে যাবেন ? উপায় না থাকায় তিনি মেয়েকে বিছানায় বেঁধে রেখে গেলেন । তিনি স্বপ্নেও ভাবতে পারেননি যে , যখন তিনি গ্রামবাসীটির চিকিত্সা করছিলেন তখন তার ১১ মাসের মেয়েটি ডাইরিয়ায় আক্রান্ত । বাড়ি কেউ ছিল না । ডাইরিয়ায় ধুঁকে ধুঁকে মেয়ে মারা গেল ।
গত ৪১ বছরে লিউ ইউয়ুলিয়েন একদিন ছুটি কাটাননি । খুব ভোরবেলায় তিনি ক্লিনিকে গিয়ে দিনের প্রস্তুতি নিতে শুরু করেন । একজন দায়িত্বশীল ডাক্তার বলে গত ৪১ বছরে তিনি চিকিত্সায় কোনো ভুল করেননি । কোনো চিকিত্সা প্রার্থীকে হতাশ করেন নি । গত ৪১ বছরে তিনি প্রায় প্রত্যেক দিন রাত ১১টায় বাড়ি ফিরে যেতেন । তিনি বলেন , এ ব্যাপারে স্বামীর কাছে তিনি চিরকালই ঋণী। বহু বছর ধরে স্বামী সবসময় তার পাশে দাঁড়িয়ে সবধরণের সমর্থন করে আসছেন । স্বামীর সমর্থনেই তিনি এতোটা সফল হতে পেরেছেন ।
বহু বছর ধরে অনিয়মিত খাওয়ার অভ্যাস এবং মরুভূমির মধ্য দিয়ে আসা-যাওয়ার কারণে লিউ ইউয়ুলিয়েনের পাথকস্থলীর প্রদাহ ও কোমর ব্যথা হয় । কিন্তু পাকস্থলীর প্রদাহ বা কোমর ব্যথা তার কাজের ওপর কোনো প্রভাব ফেলতে পারেননি । এমনকি গ্রামবাসীদের প্রতি তার ভালবাসা এতোটুকুও কমাতে পারেনি । তিনি বলেন , আমি ভালভাবে জীবনযাপন করব । কারণ নিজের স্বাস্থ্য ভাল থাকলেই কেবল আমি ভালভাবে গ্রামবাসীদের চিকিত্সা করতে পারি ।
|