রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন তেহরানে অনুষ্ঠিত ক্যাসপিয়ান সাগরের তীরবর্তী দেশগুলোর নেতৃবৃন্দের দ্বিতীয় সম্মেলনে অংশ নেয়ার জন্য ১৬ অক্টোবর সকালে তেহরানে পৌঁছান। পুতিন হচ্ছেন জি-৮'র মধ্যে ইরান সফরকারী প্রথম রাষ্ট্রপ্রধান। তিনি হচ্ছেন ১৯৪৩ সালে প্রাক্তন সোভিয়েট ইউনিয়নের নেতা জোসেফ স্তালিনের ইরান সফরের পর ইরান সফরকারী রাশিয়ার প্রথম প্রেসিডেন্ট। ইরানের পরমাণু সমস্যা দিন দিন স্পর্শকাতর হয়ে ওঠায় তিনি ইরান সফর করেন বলে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় তাঁর এবারের সফরের উপর ব্যাপক দৃষ্টি রেখেছে।
ইরান মনে করে, পুতিনের এবারের সফর তার জন্য খুব গুরুত্বপূর্ণ। ইরানের তথ্য মাধ্যম ভাষ্য হচ্ছে আন্তর্জাতিক অবরোধ ভেঙ্গে দেয়ার এটি একটি নতুন প্রচেষ্টা এবং ইরানের জন্য একটি ইতিবাচক সুযোগ। ইরানের তথ্য মাধ্যমের ভাষ্য অনেকটা যৌক্তিক। কারণ, রাশিয়া দৃঢ়তার সঙ্গে কঠোর ব্যবস্থার নেয়ার পাশাপাশি ইরানের উপর শাস্তি আরোপ করারও বিরোধিতা করে। পাশাপাশি ইরান যুক্তরাষ্ট্রকে সতর্ক করে দিয়ে বলেছে, ইরানের পরমাণু স্থাপনার উপর সামরিক হামলা চালানো ভুল হবে। পুতিন বলেন, ইরানের গোপনীয়তা রক্ষা করে পরমাণু অস্ত্রের গবেষণা ও তৈরী করা সংক্রন্ত পশ্চিমা দেশগুলোর অনুমানের সঙ্গে বাস্তবতার স্পষ্টত কোন প্রমাণ নেই। কারণ, রাশিয়া একটি বড় দেশ এবং জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের স্থায়ী সদস্য দেশ। তার এ ধরণের মনোভাব নিঃসন্দেহ ইরানের জন্য অনুকূল।
কিন্তু অনেকের মতে, যদিও পরমাণু সমস্যার ব্যাপারে রাশিয়া ইরানের পক্ষে অনেক কাজ করেছে, তবুও রাশিয়া এবং ইরানের সম্পর্ক এখনো ততো ঘনিষ্ঠ নয়। ইরান প্রকল্পের ফি বকেয়া রেখেছে বলে রাশিয়া সতর্ক করে দিয়ে বলেছে, তারা বুশার-এ পরমাণু বিদ্যুত্ কেন্দ্রের নির্মাণ শেষ করার সময় পিছিয়ে দিয়েছে। আসলে এ বছরের শরতকালে এই কেন্দ্রের কাজ শেষ হওয়ার কথা ছিল। রাশিয়া তার প্রযুক্তিবিদগণকে দেশে ফিরিয়ে নিয়েছে। কিন্তু ইরানী কর্তৃপক্ষ প্রকল্পের ফি বকেয়ার কথা অস্বীকার করে অভিযোগ করেছে, পশ্চিমা দেশগুলোর চাপেই রাশিয়া এ ধরণের আচরণ করছে। কিন্তু তারপরও ইরান ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণের গতি দ্রুততর করে নিজেই পরমাণু জ্বালানী গবেষণা এবং তৈরী করছে। ইরান আরো মনে করে, রাশিয়া হচ্ছে তার এক অনির্ভরশীল অথচ সহযোগিতার অংশীদার। রাশিয়া ইরানের এ আচরণে খুব ক্ষুব্ধ। রাশিয়া বহুবার ইরানকে ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ তত্পরতা বন্ধ করার তাগিদ দিয়েছে। যাতে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের উদ্বেগ নিরসন করা যায়। কিন্তু ইরানের বক্তব্য হচ্ছে, পরমাণু প্রযুক্তির উন্নয়ন হচ্ছে তার বৈধ অধিকার।
দেখা গেছে, পরমাণু সমস্যায় ইরানের কঠোর মনোভাব প্রদর্শন রাশিয়াকে বিভ্রান্তিতে ফেলেছে। এখন পর্যন্ত ইরানের উপর শাস্তি আরোপ করা সংক্রান্ত আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের চাপ অনেক বেশি। জার্মানীর প্রধানমন্ত্রী অ্যান্জেলা মার্কেল ১৫ অক্টোবর ওয়াইজবাদেনে বলেন, ইরান সরকার তার পরমাণু পরিকল্পনায় অবিচল রয়েছে। আমাদেরকে এ হুমকির ব্যাপারে সজাগ থাকতে হবে। পাশাপাশি তিনি জোর দিয়ে বলেছেন, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় আলোচনার মাধ্যমে পরমাণু সমস্যা সমাধানের প্রচেষ্টা চালাচ্ছে। কিন্তু ইরান সরকার এ ব্যাপারে আপোশ না করলে ইরানকে নতুন দফা শাস্তির সম্মুখীন হতে হবে। সেপ্টেম্বর মাসের শেষ নাগাদ নিরাপত্তা পরিষদের পাঁচটি স্থায়ী সদস্য দেশ এবং জার্মানীকে নিয়ে এ ছয়টি দেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রীগণ নিউইয়র্কে ইরানের পরমাণু সমস্যার ওপর আলোচনা করেছেন। কিন্তু তাঁরা ইরানের উপর শাস্তি আরোপ করা সংক্রান্ত জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের প্রস্তাবে মতৈক্য পৌঁছাতে পারেন নি। তাঁরা শুধু সিদ্ধান্ত নিতে পেরেছে যে, আগামী নভেম্বর মাসে ইরানের পরমাণু সমস্যা সংক্রান্ত ই ইউ এবং আন্তর্জাতিক আণবিক সংস্থার নতুন রিপোর্ট প্রদানের পর তার ওপর আলোচনা অনুষ্ঠিত হবে। সে সময় ইরান তার পরমাণু পরিকল্পনা সম্পর্কিত অমীমাংসীত সমস্যাগুলোর সমাধানে এগিয়ে না আসলে রাশিয়ার পক্ষে ইরানকে কোন প্রকার সমর্থন করা সম্ভব হবে না। নতুন দফা আলোচনার আগে পুতিনের ইরান সফরের উদ্দেশ্য হলো পরমাণু সমস্যার ব্যাপারে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সঙ্গে সহযোগিতার জন্য ইরানকে নমনীয় করা। তিনি সম্ভবতঃ আগামী বছর বুশার পরমাণু বিদ্যুত্ কেন্দ্র শেষ করার মাধ্যমে ইরানকে সাহায্য করে পরমাণু সমস্যায় ইরানের সঙ্গে আপোশের উদ্যোগ নেবেন। কিন্তু ইরান তাঁর এই প্রস্তাব গ্রহণ করবে কিনা, তা এখনো বলতে গেলে অনিশ্চিত। (লিলি)
|